লাভ-লোকসান যা-ই হোক, এই কর দিতে হবে

করোনাকালে নতুন বাজেট বড় ধরনের দুঃসংবাদ নিয়ে এল ব্যক্তিমালিকানাধীন (প্রোপ্রাইটরশিপ) ব্যবসার জন্য। এত দিন কোম্পানির জন্য যে ন্যূনতম আয়কর ছিল, তা এবার আরোপ হচ্ছে ব্যক্তিমালিকানাধীন ব্যবসার ক্ষেত্রেও। 

দেশের ব্যক্তিমালিকানাধীন যেসব ব্যবসায় বছরে তিন কোটি টাকা বা তার বেশি পণ্য বিক্রি হয়, তাদের ওপর শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ ন্যূনতম আয়কর আরোপ করেছে সরকার। এর ফলে যাদের দৈনিক কেনাবেচা (বছরে ৩০০ কার্যদিবস ধরে) এক লাখ টাকা, তাদের কমপক্ষে দেড় লাখ টাকা আয়কর দিতে হবে। 

লাভ-লোকসান যা–ই হোক, ব্যবসায়ীদের এই কর দিতে হবে। অর্থাৎ আপনার ব্যবসায় যদি বড় লোকসানও হয়, তবু আপনাকে আয়কর দিতে হবে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানিয়েছেন, এতে বিপাকে পড়বেন মূলত বড় দোকানদার, পাইকারি ব্যবসায়ী, কোম্পানির পরিবেশক ও উৎপাদনশীল খাতের ব্যক্তিমালিকানাধীন কারখানার মালিকেরা। 

অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল জাতীয় সংসদে গত বৃহস্পতিবার যে বাজেট প্রস্তাব পেশ করেন, তার অর্থবিলে ন্যূনতম এ করের কথা বলা আছে। এত দিন মোবাইল অপারেটরদের ওপর ২ শতাংশ, তামাক ব্যবসায়ীদের ওপর ১ শতাংশ ও অন্যান্য সব কোম্পানি বা ফার্মের ক্ষেত্রে শূন্য দশমিক ৬ শতাংশ ন্যূনতম কর ছিল। ফলে লাভ-লোকসান যা-ই হোক, তাদের মোট বিক্রির ওপর একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ কর দিতে হতো। 

অর্থবিলে বলা হয়েছে, মোবাইল অপারেটর ও তামাকজাত পণ্যের ব্যবসার বাইরে অন্য সব ব্যক্তিমালিকানাধীন ব্যবসার ক্ষেত্রে এই আয়কর দিতে হবে। অবশ্য মোবাইল অপারেটর ও তামাকের ক্ষেত্রে কর আরও বেশি, সেটা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। অবশ্য উৎপাদনশীল খাতে কারখানা চালু হওয়ার প্রথম তিন বছর ছাড় মেলে। এ ক্ষেত্রে করহার হবে শূন্য দশমিক ১০ শতাংশ। 

>ব্যক্তিমালিকানাধীন ব্যবসায় বছরে তিন কোটি টাকা বা তার বেশি লেনদেন হলেই শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ আয়কর, লাভ-লোকসান যা-ই হোক।

এই কর কেন, জানতে চাইলে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কর্মকর্তারা বলেন, ব্যবসায় লোকসান দেখিয়ে অনেক ব্যবসায়ী আয়কর দেন না। আবার অনেকে সামান্য আয় দেখিয়ে সামান্য কর দেন। তাঁদের কাছ থেকে রাজস্ব আদায়ের জন্য এই ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। তাঁরা আরও বলছেন, ব্যবসায়ীদের মুনাফার হার বিবেচনা করে সামান্য হারে ন্যূনতম কর আরোপ করা হয়েছে। 

এদিকে পাইকারি ব্যবসায়ী ও পরিবেশকেরা বিষয়টি নিয়ে খুবই উদ্বিগ্ন। উদ্বিগ্ন কোম্পানিগুলোও। তাঁদের আশঙ্কা, পরিবেশকেরা এখন বাড়তি কমিশন দাবি করবেন। 

নিত্যব্যবহার্য পণ্য বিপণনকারী একটি কোম্পানির একজন শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তা জানান, তাঁদের একজন পরিবেশক মাসে ৪০ লাখ টাকার কেনাবেচা করলে গড়ে ৫ শতাংশ হারে কমিশনে তাঁর মোট লাভ হয় ২ লাখ টাকা। এটা থেকে তার গুদামভাড়া, অন্তত পাঁচজন কর্মীর বেতন, কয়েকটি ভ্যানের ভাড়া ও ব্যাংকঋণের সুদ দিয়ে কোনোভাবেই ৫০ হাজার টাকার বেশি টেকে না। এখন যদি তাঁকে ৫০ হাজার টাকার মধ্যে ২০ হাজার টাকাই কর দিতে হয়, তাহলে পরিবেশকেরা কমিশন বাড়ানোর দাবি করবে, যা শেষ পর্যন্ত পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেবে। 

বাংলাদেশ ইলেকট্রিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মীর নিজাম উদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘এটা ব্যবসায়ীদের ওপর করের বোঝা ও হয়রানি বাড়াবে। আমাদের বেচাকেনা তিন কোটি টাকা হয়েছে, নাকি এর কম হয়েছে, তা নির্ধারণ করবে কে?’ তিনি বলেন, ‘বেশির ভাগ ব্যবসায়ী এখন ১০ থেকে ৩০ হাজার টাকা আয়কর দেন। সেটা যদি ন্যূনতম দেড় লাখ টাকা হয়, তাহলে তা অসহনীয় হবে। এখন ব্যবসার যে পরিস্থিতি, আমরা টাকা কোথা থেকে দেব?’

আয়করের সাধারণ নীতি হলো, ব্যবসায়ী আয় করবেন, সেটার ওপর নির্দিষ্ট হারে কর দেবেন। কিন্তু দেশে আয়কর আদায়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড উৎস ও সাধারণভাবে আরোপের ওপর অধিকমাত্রায় নির্ভরশীল। পণ্য ও কাঁচামাল আমদানিতে ও কেনাবেচায় ব্যবসায়ীদের উৎসে আয়কর দিতে হয়। অভিযোগ রয়েছে, এ করটি ব্যবসায়ীরা সাধারণ মানুষের ওপর চাপান। 

যেমন আপেল, কমলা, মাল্টা ও আঙুর আমদানিতে অগ্রিম আয়কর ৫ শতাংশ। এটাসহ মোট করভার ৮৯ শতাংশ। আমদানিকারকেরা জানান, এক কেজি আপেলে মোট কর দাঁড়ায় ৪০-৪৫ টাকা। এটা ধরেই তাঁরা দাম ঠিক করেন। এর মানে হলো, ব্যবসায়ীদের যে ৫ শতাংশ অগ্রিম আয়কর, সেটাও বহন করতে হয় সাধারণ মানুষকে। দিন দিন এই উৎসে কর আদায়ের প্রবণতা বাড়ছে। এতে পণ্যের মূল্যস্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। 

জানতে চাইল বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘এটা সত্যি যে ব্যবসায়ীরা প্রচুর ফাঁকি দেন। এ জন্য ব্যাংক ব্যবস্থায় লেনদেনকে উৎসাহ দেওয়া দরকার। কিন্তু আমরা উল্টো ব্যাংকে টাকা রাখলে কর বসাচ্ছি।’ তিনি বলেন, ন্যূনতম কর মাঠপর্যায়ে দুর্নীতি আরও বাড়াবে। এখন দরকার ত্রিপক্ষীয় কমিটি করে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে লেনদেন পর্যবেক্ষণ ও সে অনুযায়ী কর আদায়ের ব্যবস্থা করা। 

আহসান মনসুর বলেন, ‘অনেক ক্ষেত্রে উৎসে আয়কর ক্রেতার ওপর চাপে। যেটা আসলে ক্রেতার বহন করার কথা নয়। এ ধরনের কর আরোপ করা ঠিক নয়। কিন্তু দেশে তা দিন দিন বাড়ছে।’ 

অভিমত

এটা মারাত্মক ব্যাপার 

গোলাম মাওলা
গোলাম মাওলা

আমরা আজ (সোমবার) এটা নিয়েই বৈঠক করলাম। এটা মারাত্মক ব্যাপার। আমরা যাঁরা তেল-চিনির ব্যবসায়ী, তাঁরা অনেক টাকা লেনদেন করি, কিন্তু মুনাফা কম। সাড়ে আট লাখ টাকা বিনিয়োগ করে লাভ হয় ৪০০ থেকে ৪৫০ টাকা।

ধরেন, বিকেলে পণ্য কিনলাম, রাতে বিশ্ববাজারে দাম বাড়ল, সেটা আমার ভাগ্য। আবার বিশ্ববাজারে কমে গেল, সেটা দুর্ভাগ্য। কিন্তু সাধারণভাবে লাভের হার খুব কম। আমরা মোট লেনদেনের ওপর শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ কর কোথা থেকে দেব।

সরকার যদি চায়, আমরা এই টাকা দিতে পারব। কিন্তু পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকবে। নইলে কোথা থেকে আমরা এই টাকা দেব। 

নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের ব্যবহারের ধরনটা ভিন্ন। এ ক্ষেত্রে বিপুল টাকা লেনদেন হয়। কিন্তু মুনাফার হার খুব কম। সে ক্ষেত্রে এখন যে হারে ন্যূনতম করের কথা বলা হচ্ছে, তা ব্যাপক চাপ তৈরি করবে।

আমরা বিষয়টি অর্থমন্ত্রীর দৃষ্টিতে আনতে চাই। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশনের (এফবিসিসিআই) সহায়তা নেব। 

লোকসান হলেও কর দিতে হবে, এটা কোনো স্বাধীন দেশে থাকা উচিত নয়।