গণমাধ্যমে বিজ্ঞাপন বন্ধে বিএবির বিতর্কিত সুপারিশ

ব্যাংকমালিকদের নিজেদের সব সুযোগ-সুবিধা বহাল রেখে ব্যাংক কর্মকর্তাদের বেতন ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা কমানোর পরামর্শে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। এমনকি ব্যাংকমালিকেরা খরচ কমাতে সব ধরনের গণমাধ্যমে বিজ্ঞাপন বন্ধ রাখার কথাও বলেছেন। তবে ব্যাংক কর্মকর্তারা বলছেন, এ ধরনের পরামর্শ মানা হবে ব্যাংক ব্যবসার জন্য আরও ক্ষতিকর।

গত রোববার ব্যাংকমালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকস (বিএবি) জরুরি একটি বৈঠকে বসে ব্যাংকের খরচ বাঁচাতে ১৩ ধরনের পদক্ষেপ নেওয়ার সুপারিশ করে। এ বিষয়ে একটি চিঠিও তৈরি করা হয়। পরামর্শের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, ১৫ শতাংশ বেতন কমানো; কর্মীদের পদোন্নতি, বেতন বৃদ্ধি, প্রণোদনা বোনাস বন্ধ, নতুন শাখা, এজেন্ট ব্যাংকিং ও উপশাখা খোলা বন্ধ রাখা; সব ধরনের স্থায়ী সম্পদ ও আইটি পণ্য ক্রয় বন্ধ রাখা; কর্মীদের স্থানীয় ও বিদেশি প্রশিক্ষণ, বিদেশভ্রমণ, সব ধরনের সামাজিক দায়বদ্ধতা খরচ ও অনুদান বন্ধ রাখা এবং পত্রিকা ও টেলিভিশনে বিজ্ঞাপন প্রদান বন্ধ রাখা।

এ বিষয়ে বিভিন্ন ব্যাংকের চারজন ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) প্রথম আলোকে বলেছেন, বিজ্ঞাপন বা প্রচার-প্রচারণা তাঁরা গণমাধ্যমের স্বার্থে করেন না। এসব তাঁরা ব্যাংকের স্বার্থে করেন। ব্যবসা সম্প্রসারণ এবং সেবা ও পণ্য প্রচারের জন্য ব্যাংক বিজ্ঞাপন দেয়। আর এভাবে প্রচার না করলে ব্যবসা বাড়ানো সম্ভব হবে না।

ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন অ‌্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান, ইস্টার্ণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আলী রেজা ইফতেখার এ বিষয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিএবি কোনো সিদ্ধান্ত দেওয়ার সংস্থা নয়, তবে পরামর্শ দিতে পারে। এ দফায় ১৩টি পরামর্শ দিয়েছে। আমরা জানি যে প্রচারেই প্রসার। একটি ব্যাংক নতুন একটি পণ্য হলো, এই পণ্যের কথা যদি এখন আমি মানুষকে না জানাই, তাহলে তারা কীভাবে অবগত হবে।’

>

গত রোববার ব্যাংকমালিকদের সংগঠন বিএবি জরুরি একটি বৈঠকে বসে ব্যাংকের খরচ বাঁচাতে ১৩ ধরনের পদক্ষেপ নেওয়ার সুপারিশ করে।

এবিবির সাবেক চেয়ারম্যান, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের এমডি সৈয়দ মাহবুবুর রহমানও একইভাবে প্রথম আলোকে বলেন, প্রতিটি ব্যাংকের নিজস্ব পরিচালনা পর্ষদ আছে। পর্ষদ সিদ্ধান্ত নেবে বিজ্ঞাপন বাবদ খরচ করবে কি না। ব্যাংকগুলো নিজের প্রয়োজনেই প্রচার করে থাকে।

এবিবির ভাইস চেয়ারম্যান ও এনআরবি ব্যাংকের এমডি মেহমুদ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘ব্যাংকগুলো নিজেদের সেবার বৈচিত্র্য ও প্রচারের জন্য বিজ্ঞাপন দিয়ে থাকে। বেশি মানুষের কাছে পৌঁছাতে আমাদের কোনো না কোনো মাধ্যমে যেতেই হবে। এটা স্ব স্ব ব্যাংক ঠিক করবে।’

এদিকে সরকারের নানা মহলে গণমাধ্যমের কণ্ঠ রোধ করার নানা আয়োজন চলছে। বিজ্ঞাপন হচ্ছে সংবাদপত্রের আয়ের প্রধান উৎস। আর গত কয়েক বছরে এই সরকারের সময়ে নানাভাবে বিজ্ঞাপন বন্ধ করা হয়েছে। বিজ্ঞাপন না দিতে ভয়ভীতিও দেখানো হয়েছে। বিএবির এই পরামর্শ সংবাদপত্রকে দুর্বল করার চেষ্টার আরেকটি পর্ব বলেও মনে করা হচ্ছে। জানা গেছে, সরকারের কাছ থেকে সুযোগ-সুবিধা নেওয়া বিএবির কয়েকজন সদস্যই অতি উৎসাহী হয়ে এ পরামর্শ চাপিয়ে দিয়েছেন।

বিএবির চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদার অবশ্য এ বিষয়ে সরল একটি ব্যাখ্যা দিয়েছেন। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, পরামর্শ দেওয়া হয়েছে, কীভাবে খরচ কমানো যায়। এটা কাউকে মানতে হবে, এমন বাধ্যবাধকতা নেই। বর্তমান পরিস্থিতিতে টিকে থাকার জন্য এই পরামর্শ।

এদিকে ব্যাংকমালিকদের বিজ্ঞাপন বন্ধ রাখার পরামর্শে গণমাধ্যমেও বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন (ডিইউজে) সভাপতি কুদ্দুস আফ্রাদ ও সাধারণ সম্পাদক সাজ্জাদ আলম খান গতকাল বুধবার এ বিষয়ে এক বিবৃতিতে বলেন, গণমাধ্যমে ব্যাংকের বিজ্ঞাপন প্রদান বন্ধ রাখার ঘোষণা মূলত গণমাধ্যমের সম্প্রসারণ ও স্বাধীন মতপ্রকাশের পথে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করার শামিল। ডিইউজে নেতারা আরও বলেন, গণমাধ্যমের আয়ের অন্যতম প্রধান উৎস প্রধানত বিজ্ঞাপন। করোনা দুর্যোগের এই কঠিন সময়ে কোনো সংগঠন বা সংস্থা থেকে বিজ্ঞাপন বন্ধ করে দেওয়ার ঘোষণা গণমাধ্যমের জন্য সুবিবেচনাপ্রসূত আচরণ হবে না। দেশ ও জাতি গঠনে গণমাধ্যমের যে ভূমিকা রয়েছে, এই ঘোষণায় তা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ঘোষণা দিয়ে বিজ্ঞাপন বন্ধ করা গণমাধ্যমের সঙ্গে বৈরী আচরণের শামিল, যা খুবই হতাশা ও দুর্ভাগ্যজনক। এ ধরনের ঘোষণা থেকে বিএবিকে সরে আসার আহ্বান জানিয়েছেন ডিইউজে নেতারা।