বাজেটের পদে পদে বিপত্তি

আগামী অর্থবছরের বাজেটে অর্থমন্ত্রী ব্যবসা-বাণিজ্যে শুল্ক-করে কিছুটা ছাড় দিলেও ব্যবসায়ীরা কিন্তু আগের চেয়ে বেশি নজরদারিতে থাকবেন। আবার ব্যবসায়ীদেরও বেশি শর্ত মানতে হবে। বিষয়টা অনেকটা এমন, যেন বাজেটের পদে পদে রয়েছে ব্যবসায়ীদের বিপদ।

 গত সপ্তাহে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের ঘোষিত ২০২০-২১ অর্থবছরের নতুন বাজেট অনুযায়ী রাজস্ব কর্মকর্তারা চাইলে যেকোনো ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানে হানা দিতে পারবেন। ভ্যাট নিয়ে মামলা করতে চাইলে ব্যবসায়ীদের আগের চেয়ে দ্বিগুণ অর্থ খরচ করতে হবে। আবার শিল্পপণ্য আমদানিতে ভ্যাটের আগাম কর দিতে হলে নানা ধরনের কাগজপত্র জমা দেওয়া বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। মাসের পর মাস আটকে থাকতে পারে উপকরণ কর রেয়াতের টাকা।

প্রস্তাবিত বাজেটের অর্থবিল দেখে এসব পরিবর্তন চিহ্নিত করা হয়েছে। এসব পরিবর্তনে ব্যবসায়ীদের আরও বেশি ভোগান্তি পোহাতে হবে বলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানিয়েছেন।

অনুমতি ছাড়াই হানার সুযোগ

নতুন বাজেট পাস হলে মূল্য সংযোজন কর (মূসক) বা ভ্যাট আদায়ের জন্য এনবিআরের ভ্যাট বিভাগের মাঠপর্যায়ের কর্মীরাই অনুমতি ছাড়া (রাজস্ব কর্মকর্তা) হানা দিতে পারবেন যেকোনো ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে। তাঁরা চাইলে ওই সব প্রতিষ্ঠানের নথিপত্র যাচাই করতে পারবেন। এ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কমিশনারের আগাম অনুমোদন লাগবে না। মাঠপর্যায়ের কর্মীদের ক্ষমতা বৃদ্ধি পাওয়ায় তাঁদের স্বেচ্ছাচারী হওয়ার সুযোগ বাড়বে বলে অনেকে মনে করছেন। এত দিন সহকারী কমিশনার পর্যন্ত এই ক্ষমতা ছিল।

নতুন বাজেটে এমন সুযোগ রাখা হয়েছে বলে জানিয়েছেন দুজন হিসাববিদ। তাঁরা বলছেন, ভ্যাট আইনে (২০১২) এ বিধান ছিল না। বাজেটে সংশোধনী প্রস্তাবে এই ক্ষমতা দেওয়ার বিষয়টি রাখা হয়েছে। এতে ব্যবসায়ীদের হয়রানি বাড়বে। নতুন ভ্যাট আইনের অন্যতম প্রধান দর্শন অনুযায়ী, হয়রানি কমাতে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের অনুমোদন ছাড়া মাঠপর্যায়ের কর্মীদের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে ‘রেইড’ দেওয়া ও নথিপত্র যাচাই বা জব্দ করার সুযোগ রহিত করা হয়েছিল।

 এই বিষয়ে জানতে চাইলে দ্য ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড অ্যাকাউনট্যান্টস অব বাংলাদেশের (আইসিএবি) সাবেক সভাপতি মো. হুমায়ুন কবির বলেন, অতীতের অভিজ্ঞতা ভালো ছিল না বলেই নতুন ভ্যাট আইনে মাঠপর্যায়ে ক্ষমতাটি দেওয়া হয়নি। এটা নতুন আইনের চেতনার সঙ্গে যায় না।

মামলায় দ্বিগুণ খরচ

এবারের বাজেটে আপিলাত ট্রাইব্যুনাল ও আপিল কমিশনারেটে আপিল দায়েরের ক্ষেত্রে দাবিকৃত ভ্যাটের ১০ শতাংশের পরিবর্তে ২০ শতাংশ অর্থ পরিশোধের বিধান প্রস্তাব করা হয়েছে। উদাহরণ দিয়ে বলা যায়, কোনো ব্যবসায়ীর ভ্যাট রিটার্ন বা অন্য কোনো উপায়ে পর্যালোচনা করে ভ্যাট কর্মকর্তারা দাবি করলেন, ওই ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ১ কোটি টাকার ভ্যাট বাড়তি পাওনা আছে। এত দিন ওই ভ্যাটদাতা চাইলে দাবিকৃত ভ্যাটের ১০ শতাংশ বা ১০ লাখ টাকা জমা করে আপিল দায়ের করতে পারেন। নতুন প্রস্তাবে ওই ব্যবসায়ীকে ২০ লাখ টাকা জমা দিতে হবে। এনবিআরের কর্মকর্তাদের দাবি, এতে অযৌক্তিক ভ্যাট মামলা দায়ের করার প্রবণতা কমবে।

>

নতুন বাজেটে ভ্যাটে নানা পরিবর্তন আনা হয়েছে
এতে এমন কিছু পরিবর্তন আছে, যা ব্যবসায়ীদের ভোগান্তি বাড়াতে পারে
রাজস্ব কর্মকর্তারা অনুমতি ছাড়াই ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে হানা দিতে পারবেন
ভ্যাট বিরোধ নিষ্পত্তি করতে দ্বিগুণ অর্থ জমা দিতে হবে
ব্যবহারের আগে উপকরণে রেয়াত নয়
৪ শতাংশ আগাম কর সুবিধা পেতে নানা শর্ত

 এবারের অর্থবিলে ভ্যাট আইনের ১২১ ও ১২২ ধারায় অর্থ পরিশোধের পরিমাণ দ্বিগুণ করে পরিবর্তন আনার প্রস্তাব করা হয়েছে। পরিবর্তনটি কার্যকর হলে ভ্যাট আইনের ১২১ ধারাটি এমন হবে—ভ্যাট কর্মকর্তা ব্যতীত সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি তর্কিত আদেশের বিরুদ্ধে ৯০ দিনের মধ্যে দাবিকৃত করের ২০ শতাংশ জমা দিয়ে আপিল কমিশনারের কাছে আপিল করতে পারবেন। একইভাবে ১২২ ধারার অধীনে আপিলাত ট্রাইব্যুনালে আপিল করলেও ২০ শতাংশ দিয়ে আবেদন করতে হবে।

এদিকে এনবিআরের ভ্যাট বিভাগের একজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, ব্যবসায়ীরা দাবিকৃত ভ্যাটের টাকা যাতে আদায় করা না যায়, সে জন্য ১০ শতাংশ টাকা জমা করে বছরের পর বছর রাজস্ব আটকে রাখেন। ফলে এনবিআর আর রাজস্ব পায় না।

 এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, শুল্ক-কর নিয়ে বর্তমানে ২২ হাজারের বেশি মামলা আছে। এসব মামলার বিপরীতে অনাদায়ি পড়ে আছে ৩২ হাজার কোটি টাকার বেশি রাজস্ব।

 অ্যাসোসিয়েশন অব মোবাইল টেলিকম অপারেটরস অব বাংলাদেশ (অ্যামটব) বলেছে, মূসক বা ভ্যাট সম্পর্কিত বিরোধ নিষ্পত্তিতে প্রস্তাবিত হারে অর্থ আগাম জমা নেওয়া হলে উচ্চ আদালতে একটি মামলা নিষ্পত্তি করতে মোট ৫০ শতাংশ অর্থ জমা দিতে হবে। গত মঙ্গলবার বাজেট প্রতিক্রিয়া তুলে ধরার এক অনুষ্ঠানে অ্যামটবের মহাসচিব এস এম ফরহাদ বলেন, ‘এতে কোম্পানির বিপুল অর্থ আটকে থাকার আশঙ্কা রয়েছে।’

ব্যবহারের আগে রেয়াত নয়

নতুন ভ্যাট আইনের ৪৭ নম্বর ধারায় পরিবর্তনের প্রস্তাব করা হয়েছে। সেখানে বলা আছে, কোনো নিবন্ধিত ব্যক্তি করযোগ্য সরবরাহের নিমিত্ত কোনো নির্দিষ্ট কর মেয়াদে যে পরিমাণ উপকরণ ব্যবহার করেন, ওই ব্যক্তির প্রাপ্য উপকরণ কর রেয়াত সেই পরিমাণের ভিত্তিতে নিরূপণ হবে।

এর মানে হলো, কোনো ব্যবসায়ী যদি ১০০ টাকার উপকরণ কিনে প্রতি কর মেয়াদে (প্রতি মাসে) যতটুকু উপকরণ ব্যবহার করবেন, ঠিক ততটুকুর রেয়াত নিতে পারবেন। এবারের বাজেটে রেয়াত নেওয়ার সময় দুই কর মেয়াদের পরিবর্তে চার কর মেয়াদ করা হয়েছে। এতে ব্যবসায়ীর কিছু সুবিধা হলেও অসুবিধা আছে। যেমন একটি ওষুধ কোম্পানি এক বছরের উৎপাদনের ১ কোটি টাকার কাঁচামাল আমদানির বিপরীতে ১২ লাখ টাকার ভ্যাট দিল। নতুন নিয়ম অনুযায়ী, প্রতি মাসে যতটুকু কাঁচামাল ব্যবহার করা হবে, সেই পরিমাণ রেয়াত নিতে পারবে প্রতিষ্ঠানটি। আগের স্তরে দেওয়া ১২ লাখ টাকার সমপরিমাণ রেয়াত নিতে ওই কোম্পানির ১২ মাস সময় লাগবে। এতে দীর্ঘদিনের জন্য ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের টাকা আটকে থাকার সম্ভাবনা আছে। এ ছাড়া ৪ কর মেয়াদের মধ্যে রেয়াত নিতে হবে—এমন বিধান থাকায় যেসব প্রতিষ্ঠান ৬ মাস কিংবা এক বছরের উপকরণ কেনে, তাদের কী হবে, তা স্পষ্ট নয়।

দলিল-দস্তাবেজ দাখিলের ঝক্কি

এবারের বাজেটে উৎপাদনমুখী শিল্পপণ্য আমদানির ক্ষেত্রে ভ্যাটের আগাম কর ৫ শতাংশের পরিবর্তে ৪ শতাংশ করা হয়েছে। পণ্য খালাসের সময় ওই আমদানিকারককে বিভিন্ন ধরনের কাগজপত্র জমা দিতে হবে। যেমন মূসক নিবন্ধন ফরমের অনুলিপি; যেখানে উৎপাদন হবে সেখানকার ভ্যাট বিভাগীয় দপ্তরের উৎপাদনসংক্রান্ত তথ্য-উপাত্ত; বিল অব এন্ট্রি দাখিলের সময় ওই প্রতিষ্ঠানের হালনাগাদ শিল্প আইআরসির কপি এবং আগের ১২ কর মেয়াদের (১২ মাসের) মূসকসংক্রান্ত দাখিল পেশের প্রমাণপত্র।

উল্লেখ্য, বর্তমানে সারা দেশে ৪ হাজার ৮৯৪টি আইআরসি সনদ নেওয়া উৎপাদনমুখী শিল্পপ্রতিষ্ঠান আছে।

শামস মাহমুদ, সভাপতি, ডিসিসিআই
শামস মাহমুদ, সভাপতি, ডিসিসিআই


অভিমত
ব্যবসায় সমস্যা বাড়তে পারে
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) মাঠপর্যায়ের কর্মীরা আগে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের নথিপত্র তদারকি করতে গেলে কর কমিশনারের অনুমোদন লাগত। এখন যদি অনুমোদন না লাগে, তাহলে ব্যবসায়ীদের হয়রানি বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে।

আমরা অনলাইনে রিটার্ন দেওয়ার কথা বলছি, যাতে কর কর্মকর্তাদের সঙ্গে ব্যবসায়ীদের দেখা না হয়। এখন যদি নতুন করে মাঠপর্যায়ে অনুমতি ছাড়া নথিপত্র যাচাইয়ের সুযোগ দেওয়া হয়, তাহলে তা সমস্যা বাড়াবে।

আমরা চাই, মাঠপর্যায়ের কর্মীদের এ ধরনের পদক্ষেপ নেওয়ার ক্ষমতা শুধু জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের অনুমোদন সাপেক্ষে থাকা উচিত। এখন যে পদক্ষেপটি নেওয়া হয়েছে, তা কর বাড়ানোর জন্য বলে মনে হচ্ছে। কিন্তু আমরা স্বাভাবিক সময়েই মাঠপর্যায়ে এত ক্ষমতা দেওয়ার বিষয়টি গ্রহণযোগ্য মনে করতাম না।

বর্তমান করোনা পরিস্থিতিতে ব্যবসা-বাণিজ্যের অবস্থা ভালো নয়। উল্টো সরকারের রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা অনেক বেশি। আমরা আশঙ্কা করছি, হয়রানি অনেক বাড়বে। তাই মাঠপর্যায়ে এত ক্ষমতা না দেওয়াই সুবিবেচনাপ্রসূত কাজ হবে।

বিরোধ দেখা দিলে সেটা নিষ্পত্তির বিষয়টিও কঠিন করে ফেলা হয়েছে। মূসক নিয়ে বিরোধে মামলা করতে গেলে ১০ শতাংশের বদলে ২০ শতাংশ টাকা জমা দিতে হবে। এরপর কয়েকটি স্তর পেরিয়ে উচ্চ আদালতে একটি মামলা নিষ্পত্তি করতে গেলে ৫০ শতাংশ অর্থ জমা দিতে হবে। এটা কোম্পানির তারল্যসংকট বাড়াবে। এমনিতেই কোম্পানিগুলো পরিচালন মূলধনের অভাবে রয়েছে। এ ছাড়া মামলায় জিতলেও জমা দেওয়া টাকা ফেরত পাওয়ার বিষয়টিও স্পষ্ট নয়।

আমরা আশা করি, সরকার বিষয়গুলো বিবেচনা করবে।