চীন-ভারতের বাণিজ্যে কতটা প্রভাব ফেলবে সীমান্ত সংঘাত

ভারত ও চীনের সীমান্ত সংঘাতের বিরূপ প্রভাব দুই দেশের বাণিজ্যিক সম্পর্কে পড়বে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা। তাঁরা মনে করছেন, এই সংঘাতে ভারতীয় জনতার মধ্যে যে ক্ষোভ জন্মেছে, ভারত না চাইলেও এর আঁচ বাণিজ্যিক সম্পর্ককে নষ্ট করে দিতে সক্ষম। গতকাল বৃহস্পতিবার উইক এশিয়ার এক প্রতিবেদনে এ বিষয়ে বিশ্লেষণধর্মী প্রতিবেদন তুলে ধরা হয়।

ভারত ও চীনের মধ্যে সীমান্ত বিরোধ নিয়ে উত্তেজনার ফলে গত সোমবার লাদাখে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়। এর দায় ভারত ও চীন পরস্পরের ওপর চাপালেও উত্তেজনা প্রশমনে তারা সচেষ্ট হয়েছে। লাদাখের গলওয়ান অঞ্চলে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখায় ভারত ও চীনের সেনাদের মধ্যে হাতাহাতিতে ভারতের ২০ জন জওয়ানের মৃত্যু হয়। ৪৫ জন চীনা সৈনিক ওই সংঘর্ষে হতাহত হন বলে ভারতের দাবি। যদিও সরকারি পক্ষ থেকে বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়নি। চীনের পক্ষ থেকে সংঘাতের কথা বলা হলেও এই ঘটনায় হতাহত নিয়ে একটি শব্দও উচ্চারণ করা হয়নি।

২০ জওয়ানের মৃত্যুর বিষয়ে বিস্তারিত প্রকাশ করেছে ভারতীয় গণমাধ্যম। এতে বলা হয়, কয়েকটি লাশ বিকৃত করা হয়েছে। সেনারা মুগুর, পেরেকসহ লোহার রড ইত্যাদি হাতিয়ার নিয়ে হামলা চালায়। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পশ্চিম হিমালয়ের ওই উপত্যকার লাশ উদ্ধার এবং হতাহতের সংখ্যা নির্ধারণ করা চ্যালেঞ্জিং ছিল। তবে সেনাবাহিনী স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে, কোনো ভারতীয় সেনা নিখোঁজ নেই।

ভারতে সংবাদমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে, খাড়া পর্বতের প্রায় ১৪ হাজার ফুট (৪,২৬৭ মিটার) উচ্চতায় দুই দেশের সৈন্যদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছে এবং কিছু সৈন্য পা পিছলে খরস্রোতা গলওয়ান নদীতে পড়ে গেছেন, যেখানে তাপমাত্রা ছিল হিমাঙ্কের নিচে। একটিও গুলিবিনিময় না হওয়ার পরেও কীভাবে সংঘর্ষে ২০ জন ভারতীয় সৈন্যের প্রাণহানি ঘটল, তা নিয়ে বিভিন্ন মাধ্যমে ব্যাপক প্রশ্ন উঠতে শুরু করার পর দেশটির সেনাবাহিনী একটি অস্ত্রের ছবি প্রকাশ করে।

নিহত সেনাদের মরদেহ তাঁদের বাড়িতে পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গে শোকসমাবেশ ও বিভিন্ন এলাকায় বিক্ষোভ প্রদর্শন করা হয়। বোঝা যায়, কতটা ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছে মানুষের মনে। গুজরাটের একদল মানুষ চীনা ব্র্যান্ডের টেলিভিশন সেট ভাঙছে—এমন ধরনের একটি ছবি ভাইরাল হয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। এমনকি ভারতের কেন্দ্রীয় সামাজিক বিচার প্রতিমন্ত্রী রামদাস আটওয়ালে পর্যন্ত রেস্তোরাঁগুলোয় চাইনিজ খাবার বিক্রি নিষেধাজ্ঞার দাবি করেছেন।

লন্ডনের কিংস কলেজের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক হর্ষ পান্ত বলেছেন, ‘এই সংকট ভারত-চীন সম্পর্কের একটি প্রতিচ্ছবি। তিনি বলেন, ভারতের পুরো চীনা নীতি এই ধারণার ওপর ভিত্তি করে ছিল যে আমরা আমাদের সীমান্ত ইস্যু নিয়ে মাথা ঘামাব না। তবে এই অনুমান ভুল হয়েছে। যখন আপনার সীমানা উত্তপ্ত হবে, তখন আপনি চীনের সঙ্গে স্বাভাবিক সম্পর্ক রাখতে পারবেন না।’

ভারত ও চীন দুই দেশ একে অপরের ওপর চাপালেও উত্তেজনা প্রশমনে সচেষ্ট হয়েছে। গত বুধবার দুপুরে ভারত ও চীনের দুই পররাষ্ট্রমন্ত্রী যথাক্রমে এস জয়শঙ্কর ও ওয়াং ই নিজেদের মধ্যে ফোনে কথা বলেন। এর আগেই লাদাখে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখায় দুই দেশের সেনাবাহিনীর মধ্যে মেজর জেনারেল পর্যায়ে শান্তি বৈঠক শুরু হয়। বুধবারই চীন জানিয়ে দেয়, প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখায় আর কোনো সংঘর্ষ তারা চায় না। দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ঝাও লিজিয়ান বলেন, সমস্যার সমাধানে দুই দেশের সামরিক ও কূটনৈতিক স্তরে আলোচনা শুরু হয়েছে।

জয়শঙ্কর পরে এক টুইটে বলেন, ভারতীয় সেনারা সশস্ত্র ছিল। তবে দ্বন্দ্ব যাতে না বাড়ে, তাই প্রোটোকল ভেঙে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করেননি। গতকাল ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র অনুরাগ শ্রীবাস্তব বলেছেন, চীনা ও ভারতীয় কর্মকর্তারা নিয়মিত একে অপরের সঙ্গে কথা বলছেন।

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি একটি সংক্ষিপ্ত বিবৃতি জারি করে বলেছেন, ‘ভারত শান্তি চায়, তবে “উসকে দেওয়ার জন্য” যদি এই ঘটনা হয়, তবে আমরা উপযুক্ত জবাব দিতে সব ক্ষেত্রেই সক্ষম।’

সরকার বেইজিংয়ের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নেওয়ার আনুষ্ঠানিক ইঙ্গিত দেয়নি। কিন্তু তারা কিছু না করলেও ভারতের বিভিন্ন গণমাধ্যমে দুই দেশের মধ্যে ব্যবসায়িক স্বার্থ সীমাবদ্ধ করার দাবি উঠেছে। গণমাধ্যমে বলা হচ্ছে, সরকারি টেলিকম সরবরাহকারীরা যেন চীনা কোম্পানির তৈরি সরঞ্জাম ব্যবহার না করে।

আসলে গত ছয় বছর থেকে নয়াদিল্লি সি চিং পিনের নেতৃত্বাধীন চীনকে নিয়ে কাজ করতে এক নতুন পদ্ধতির ওপর জোর দিয়ে আসছে। গত ছয় বছরে নরেন্দ্র মোদি ও সি ১৮ বার সাক্ষাৎ করেন। এর মধ্যে দুটি অন্যতম অনানুষ্ঠানিক দ্বিপক্ষীয় শীর্ষ সম্মেলন ছিল। নয়াদিল্লির কূটনীতিকরা জোর দিয়েছিলেন যে, তাদের দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্ককে আরও শক্তিশালী করা এবং সীমান্ত সংঘাতের মতো বিষয়কে কেন্দ্রের মঞ্চে যেতে না দেওয়া।

এখন মাধব দাস নালাপাতের মতো নীতি বিশ্লেষকেরাও মনে করছেন, এর বদল হতে চলেছে। দীর্ঘদিন ধরে ভারত ভেবেছিল সীমান্ত বিরোধ দুই দেশের সম্পর্ককে ছাপিয়ে যাবে না। মণিপাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূরাজনীতি ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের লেখক এবং ইউনেসকো পিস চেয়ারপ্রাপ্ত মাধব বলেন, ‘মোদির ভাষণ ইঙ্গিত দেয় যে বাণিজ্যিক কার্যক্রম যথারীতি চলবে না। কারণ, এত কিছুর পরও চীন কখনোই ভারতের সঙ্গে সীমানা লঙ্ঘনের জন্য কোনো মূল্য দেয়নি।’

ভারতের বৈদেশিক নীতিগুলোতে দ্রুত পরিবর্তন হওয়ার পাশাপাশি বিশ্ব ব্যবস্থায় একটি পুনরুদ্ধার হবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা। হর্ষ পান্ত বলেন, ‘এ ঘটনায় ভারতের বৈদেশিক নীতি কিছুটা চাপ মুক্ত করে। চীন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র উভয়ের মধ্যে সমতা বজায় রাখার দ্বিধায় ভারত ক্রমাগত নিপীড়িত হয়ে আসছে। আমরা এখন চীনা কোম্পানির নেওয়া ফাইভ-জি নিয়ে আলোচনা উঠিয়ে রাখতে পারি। আমরা ইতিমধ্যে দেখছি যে চীনা কোম্পানিগুলি রাষ্ট্রীয় দরপত্র পাচ্ছে না এবং ভারতে চীনা বিনিয়োগের ক্ষেত্রেও বিধিনিষেধ রয়েছে। এসব বিষয়কে ত্বরান্বিত করবে।’