চীনে বাংলাদেশের রপ্তানি কি আসলেই বাড়বে

চীন এক বছরে বাংলাদেশে যা রপ্তানি করে, বাংলাদেশ এক যুগেও তা রপ্তানি করতে পারেনি চীনে। উভয় দেশের এই বিশাল বাণিজ্য ব্যবধান কিছুটা কমে আসার সুযোগ তৈরি হয়েছে চীনের গত বুধবারের এক সিদ্ধান্তে।

তবে চীন এমন এক সময় বাংলাদেশকে ৯৭ শতাংশ পণ্যে শুল্কমুক্ত রপ্তানির সুযোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, বাংলাদেশ যখন স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে বের হয়ে যাওয়ার দ্বারপ্রান্তে। এলডিসির তালিকায় বাংলাদেশের থাকার কথা ২০২৪ সাল পর্যন্ত। সে হিসাবে চীনে শুল্কমুক্ত পণ্য রপ্তানির সুযোগ পাওয়া যাবে বড়জোর আর চার বছর।

তবু চীনের এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন রপ্তানিকারকেরা। যদিও তাঁরা কিছুটা অনিশ্চয়তার মধ্যে রয়েছেন। যদিও সুবিধার বিষয়টি পুরোপুরিই নির্ভর করছে বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি পণ্য শেষ পর্যন্ত চীনের তালিকায় আছে কি না, তার ওপর। গতকাল শনিবার পর্যন্ত চীন এ–বিষয়ক কোনো তথ্য বাংলাদেশ সরকারকে জানায়নি।

বাণিজ্যসচিব মো. জাফরউদ্দীন প্রথম আলোকে জানান, ‘চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য ব্যবধান অনেক বেশি। চীন যে ৯৭ শতাংশ পণ্যের ক্ষেত্রে শুল্কমুক্ত সুবিধা দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে, তা যুগান্তকারী পদক্ষেপ। আশা করছি বাণিজ্য ব্যবধানটা এবার কমে আসবে।’

২০১০ সালে ৬০ শতাংশ, ২০১৫ সালে ৯৫ শতাংশ এবং চলতি বছরের মাঝামাঝি এসে চীন সিদ্ধান্ত নিল, এলিডিসি দেশগুলো ৯৭ শতাংশ পণ্য চীনে শুল্কমুক্তভাবে রপ্তানি করতে পারবে। শুরুর দিকে ৩৩টি এলডিসির জন্য এ সুযোগ রাখলেও চীন পরে তা বাড়িয়ে ৪০টি দেশের জন্য করে।

কিন্তু চীনের শর্ত না মানায় বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত ৯৫ শতাংশের তালিকার মধ্যেই আসেনি। কারণ, চীনের ৬০ শতাংশ শুল্কমুক্ত তালিকায় বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি পণ্যগুলো নেই। ফলে গড়ে ১০ শতাংশের মতো শুল্ক দিয়েই দেশটিতে রপ্তানি করতে হচ্ছে বাংলাদেশকে।

>

চীন যেসব পণ্যে শুল্কমুক্ত রপ্তানি সুবিধা ঘোষণা করেছে, তাতে তৈরি পোশাকসহ বাংলাদেশের প্রধান পণ্যগুলো থাকছে কি না, এখনো নিশ্চিত নয়।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয় জানায়, ১৬ জুন চীন সিদ্ধান্ত নিয়েছে, আগামী ১ জুলাই থেকে চীনে শুল্কমুক্তভাবে রপ্তানি করা যাবে মোট ৮ হাজার ২৫৬টি পণ্য। এত দিন এই সুযোগ ছিল ৫ হাজার ১৬১টি পণ্যের ক্ষেত্রে।

প্রশ্ন হচ্ছে, হাজার হাজার পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা দিলেও বাংলাদেশের তাতে কী লাভ, যদি বাংলাদেশের প্রধান পণ্যই এর মধ্যে না থাকে? রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) সূত্রে জানা গেছে, বিশ্বে মাত্র ৭০০ ধরনের পণ্য রপ্তানি করে বাংলাদেশ।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, ইপিবি এবং রপ্তানিকারকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বর্তমানে ৫ হাজার ১৬১টি পণ্যের মধ্যে বাংলাদেশের প্রধান পণ্যগুলো নেই। তাই বাংলাদেশি প্রধান ১৭টি রপ্তানি পণ্যের একটি তালিকা চীনকে ২০১৮ সালে দিয়েছে বাংলাদেশ। ওই ১৭টি পণ্যের শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার চাওয়া হয় বাংলাদেশের পক্ষ থেকে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কোনগুলোকে চীন শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকারের তালিকায় রেখেছে, তা এখনো নিশ্চিত নয় কেউই।

ইপিবির ভাইস চেয়ারম্যান এ এইচ এম আহসান ও বাণিজ্যসচিব এ তালিকার অপেক্ষায় রয়েছেন বলে জানান।

সূত্রগুলো জানায়, চীন ২০১০ সালে থেকে এলডিসি দেশগুলোকে সীমিত সংখ্যার পণ্যে বাজারে প্রবেশাধিকার দিয়ে সবাইকে চুক্তি করতে বলে। বাংলাদেশ তখন চুক্তি করেনি। কারণ, বাংলাদেশ দেখেছে বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি পণ্যগুলোই চীনের নেতিবাচক তালিকায় (নেগেটিভ লিস্ট)।

চীনে প্রধানত তৈরি পোশাক, চামড়াজাত পণ্য, পাটজাত পণ্য, হিমায়িত মাছ, চিংড়ি, ব্যাঙ, কাঁকড়া, কুঁচে, কচ্ছপ, হালকা প্রকৌশল পণ্য, ক্যামেরার লেন্স, পাটগাছের গুঁড়া ইত্যাদি পণ্য রপ্তানি হয় বলে ইপিবি সূত্রে জানা গেছে। তবে মোট রপ্তানি কখনো বছরে ১০০ কোটি ডলারও হয়নি।

বাংলাদেশ-চায়না চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (বিসিসিসিআই) মহাসচিব এবং চীনে পণ্য রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান এগ্রো বিজনেস লিমিটেডের চেয়ারম্যান শাহজাহান মৃধা প্রথম আলোকে বলেন, ‘নিঃসন্দেহে সিদ্ধান্তটি রপ্তানি-সহায়ক হয়েছে। তবে যত দূর জানি, তালিকাটি এখনো তৈরি হয়নি। তালিকা না দেখে ঠিক বলা যাবে না আমাদের প্রধান রপ্তানি পণ্যগুলো এর মধ্যে আছে কি না। চূড়ান্ত মন্তব্য তখনই করা যাবে।’

বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশনের (এফবিসিসিআই) সাবেক উপদেষ্টা মনজুর আহমেদ বলেন, ‘হাজার হাজার পণ্যের শুল্কমুক্ত রপ্তানি সুবিধা দিলেও কোনো লাভ হবে না, যদি বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি পণ্য এর মধ্যে না থাকে। এখন তালিকা বের হওয়া পর্যন্ত আমরা অপেক্ষা করতে পারি। সুবিধা শেষ পর্যন্ত দেওয়া হলে এলডিসির মধ্যে থাকতে থাকতে রপ্তানিকারকদের সুযোগটি নেওয়া উচিত বলে পরামর্শ দেন তিনি।