বাজেটে আপনি তাহলে কোথায়

>অর্থমন্ত্রী নতুন অর্থবছরের জন্য বাজেট দিয়েছেন। টাকার অঙ্কে বাজেটটি বিশাল, ৫ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকার। কিন্তু এই বাজেটে আপনি কোথায়, আপনার জন্য কী আছে এখানে, বাজেট কেন আপনার জন্য গুরুত্বপূর্ণ—এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছেন শওকত হোসেন

বাংলাদেশের আড়াই বাজেটের সমান বেজোসের সম্পদ

জেফ বেজোস
জেফ বেজোস

সবার আগে একটু বুঝে নিই বাজেটটা আসলে কত বড়। বিশ্বের সেরা ধনী এখন আমাজনের জেফ বেজোস। গতকাল রোববার তাঁর সম্পদের পরিমাণ ছিল ১৬০ দশমিক ০১ বিলিয়ন ডলার। আর বাংলাদেশের টাকায় রূপান্তর করলে হয় ১৩ লাখ ৬০ হাজার ৮৫০ কোটি টাকা। এর অর্থ, একা জেফ বেজোসের সম্পদই আছে গোটা বাংলাদেশের প্রায় আড়াইটা বাজেটের সমান। সুতরাং বলাই যায়, ১৬ কোটি দেশের মানুষের জন্য ৫ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকার বাজেট মোটেই কিন্তু বড় নয়। 

ধরা যাক অর্থমন্ত্রীরা বাজেট আর দেবেন না। বরং বাজেটে যে অর্থ বরাদ্দ রাখেন, তা মাথাপিছু ভাগ করে দেবেন। তাতে মাথাপিছু পড়বে ৩৫ হাজার টাকা। বাজেটে যদি মানুষের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন না হয়, যদি অপ্রয়োজনীয় ও গুরুত্বহীন কাজে বেশির ভাগ অর্থ ব্যয় হয়, উন্নয়ন দৃশ্যমান না হয়, অনুৎপাদনশীল খাতে ব্যয় বাড়তেই থাকে, সরকারি সেবা পেতে হয়রানি হয়, তাহলে কিন্তু মানুষ ভাবতেই পারে, এর চেয়ে বরং মাথাপিছু অর্থ ভাগ করে দেওয়াই ভালো। একজন যোগ্য অর্থমন্ত্রীর কাজ আসলে এটাই—বাজেটের মাধ্যমে সম্পদ বণ্টন, একটি প্রগতিশীল কর ব্যবস্থার প্রবর্তন এবং বিনিয়োগ বাড়ানোর মাধ্যমে কর্মসংস্থান সৃষ্টি। একটি বাজেটের মূল লক্ষ্য তো এসবই। 

বাজেট হচ্ছে একটি দেশের সম্ভাব্য আয়-ব্যয়ের হিসাব। সরকারকে দেশ চালাতে হয়, সরকারের হয়ে যাঁরা কাজ করেন তাঁদের বেতন দিতে হয়, আবার নাগরিকদের উন্নয়নের জন্য রাস্তাঘাট, হাসপাতাল, স্কুল বানানোসহ নানা ধরনের উদ্যোগ নিতে হয়। সুতরাং একটি নির্দিষ্ট অর্থবছরে কোথায় কত ব্যয় হবে, সেই পরিকল্পনার নামই বাজেট। 

জেমস উইলসনকে এখনো অনুসরণ 

জেমস উইলসন
জেমস উইলসন

১৭২০ সালে ব্রিটেনের পার্লামেন্টে প্রথম জাতীয় বাজেট ও রাজস্বনীতি উত্থাপন করেছিলেন স্যার রবার্ট ওয়ালপোল। সেই থেকে বাজেট দেওয়া শুরু। আর ভারতীয় উপমহাদেশের প্রথম বাজেট দেওয়া হয় ১৮৬০ সালের ৭ এপ্রিল, সিপাহি বিদ্রোহের পর ভারতের শাসনভার চলে যাওয়ার পর। জেমস উইলসন ভারতে ব্রিটিশ সরকারের হয়ে ১৮৬০-৬১ অর্থবছরের সেই বাজেটটি দিয়েছিলেন। সেই যে ওয়েস্ট মিনস্টার সরকার পদ্ধতির আওতায় সরকারের আয়-ব্যয় ব্যবস্থাপনার বাজেট দেওয়া শুরু, আজও সেই ধারা বজায় আছে বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানে। এই জেমস উইলসনই লন্ডনের প্রভাবশালী ইকোনমিস্ট পত্রিকা ও স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা। আরেকটা তথ্য দিই, বাজেট পেশের পরপরই তিনি ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান কলকাতাতেই। 

দেশভাগের পর পাকিস্তান আমলে ১৯৪৮-৪৯ অর্থবছরের প্রথম বাজেট দিয়েছিলেন হামিদুল হক চৌধুরী। এই পাকিস্তান আমলেই, মুসলিম লীগ সরকারের সময় অর্থবছর গণনা এপ্রিল-মার্চ থেকে সরে এসে জুলাই-জুন করা হয়। সেই ধারা বাংলাদেশে রয়ে গেছে। তবে ভারত এখনো এপ্রিল-মার্চ ধরে অর্থবছর বিবেচনা করে। আমরা সবাই জানি, স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম বাজেট উপস্থাপন করেছিলেন দেশের প্রথম অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ। আর অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের দেওয়া এবারের বাজেটটি ছিল বাংলাদেশের ৪৯তম বাজেট। ক্রিকেটপ্রেমী অর্থমন্ত্রী অর্ধশতক থেকে মাত্র এক রান দূরে। 

১৯৭২ সালের ৩০ জুন রেডিও-টেলিভিশনের মাধ্যমে অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ একই সঙ্গে ১৯৭১-৭২ ও ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণা করেছিলেন। এখন পর্যন্ত তিনিই বাজেট দেওয়া একমাত্র পূর্ণাঙ্গ রাজনীতিবিদ অর্থমন্ত্রী। সেই থেকে এখন পর্যন্ত ১৩ জন অর্থমন্ত্রী বা অর্থ উপদেষ্টা দেশের ৪৯টি বাজেট দিলেন। 

সংবিধানে বাজেট নেই, আছে আর্থিক বিবৃতি ও অর্থবিল

জাতীয় সংসদে বাজেট উপস্থাপন করছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। ছবি: পিআইডি
জাতীয় সংসদে বাজেট উপস্থাপন করছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। ছবি: পিআইডি

সংবিধানে কিন্তু বাজেট নেই। আর জাতীয় সংসদে সরাসরি বাজেট পাস বলতেও কিছু নেই। বরং একটি আর্থিক বিবৃতি উপস্থাপনের কথা বলা আছে, আর আছে অর্থবিল পাসের কথা। যেমন বার্ষিক আর্থিক বিবৃতি বিষয়ে সংবিধানের ৮৭(১)-এ বলা আছে, প্রত্যেক অর্থবছরের জন্য সরকারের অনুমিত আয় ও ব্যয়-সংবলিত একটি বিবৃতি সংসদে উপস্থাপিত হবে। আর একেই বার্ষিক আর্থিক বিবৃতি বলা হবে। 

আর অর্থবিলের সংজ্ঞা আছে সংবিধানের ৮১(১)-এ। সেখানে বলা আছে, অর্থবিলে থাকবে কোনো কর আরোপ, নিয়ন্ত্রণ, রদবদল, মওকুফ বা রহিত করা; সরকার কর্তৃক ঋণ গ্রহণ বা কোনো গ্যারান্টি দান, কিংবা সরকারের আর্থিক দায়দায়িত্ব সম্পর্কিত আইন সংশোধন; সংযুক্ত তহবিলের রক্ষণাবেক্ষণ, অনুরূপ তহবিলে অর্থ প্রদান বা অনুরূপ তহবিল হতে অর্থ দান বা নির্দিষ্টকরণ; সংযুক্ত তহবিলের ওপর দায় আরোপ কিংবা অনুরূপ কোনো দায় রদবদল বা বিলোপ ইত্যাদি। কর আরোপ নিয়েও সংবিধানে গুরুত্বপূর্ণ একটি ধারা রয়েছে। যেমন ৮৩ ধারায় সংসদের আইন ব্যতীত করারোপে বাধার কথা বলা আছে। সেখানে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে, একটি সংসদের কোনো আইনের দ্বারা বা কর্তৃত্ব ব্যতীত কোনো কর আরোপ বা সংগ্রহ করা যাবে না। 

আবার কর প্রস্তাব বিষয়ে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ আইন আছে, সেটার কথাও বলতে হয়। কেননা, প্রতিবছরই এ নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে বিপত্তি দেখা দেয়। তবে এবারের ঘটনাটি ছিল নজিরবিহীন। কেননা, তা করেছে একটি সরকারি সংস্থা। যেমন এবারের বাজেট উপস্থাপনের একদিন পরে, ১৩ জুন বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) জ্যেষ্ঠ সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ ফারহান আলম অপারেটরগুলোকে একটি ই-মেইল পাঠান। সেই বার্তায় বাজেট পাসের আগেই মোবাইলের কথা বলা ও ইন্টারনেটে বাড়তি শুল্ক কেন আরোপ করা হয়েছে, তা জানতে চাওয়া হয়। এ জন্য নজিরবিহীন কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও বলা হয়। ই-মেইলে বিটিআরসি আরও বলেছে, বাজেটে মোবাইল সেবার ওপর যে সম্পূরক শুল্ক বাড়ানো হয়েছে, তা ১ জুলাই থেকে কার্যকর হওয়ার কথা। 

রাজস্ব প্রস্তাব কার্যকরসংক্রান্ত আইনটি হচ্ছে ১৯৩১ সালের। প্রভিশনাল কালেকশন অব ট্যাক্সেস আইন অনুযায়ী বলা থাকে কখন কোন কর প্রস্তাব কার্যকর হবে। সাধারণত আমদানি ও সম্পূরক শুল্কসহ বিভিন্ন কর প্রস্তাব বাজেট পেশের সঙ্গে সঙ্গে কার্যকর হয়, যাতে কেউ মজুত বা অপব্যবহার না করতে পারে। উদাহরণ দিয়ে বলা যায়, চিনির ওপর কার বাড়ানোর প্রস্তাব থাকলে তা যদি ১ জুলাই থেকে কার্যকর করে তাহলে, এ সময়ের মধ্যে মজুত করার প্রবণতা বাড়বে। 

আর চিঠি পাঠানোর আগে বিটিআরসির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা যদি এবারের অর্থবিলটা এনবিআরের ওয়েবসাইট থেকে দেখে নিতেন, তাহলে উদাহরণ সৃষ্টিকারী এ রকম একটা চিঠি লিখতে হতো না। 

‘হাউ টু লাই উইথ স্ট্যাটিসটিকস’

ইংরেজিতে বলা হয়, মিথ্যা তিন রকম—মিথ্যা, ডাহা মিথ্যা আর স্ট্যাটিসটিকস বা পরিসংখ্যান। ড্যারেল হাফ নামের একজন সাংবাদিক ১৯৫৪ সালে একটি তুমুল বিখ্যাত বই লিখেছিলেন। নাম হাউ টু লাই উইথ স্ট্যাটিসটিকস। সেখানে তিনি দেখিয়েছিলেন পরিসংখ্যান ব্যবহার করে সরকার থেকে শুরু করে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান কীভাবে অসত্য ও বিভ্রান্তিকর তথ্য দিয়ে থাকে। আর নারায়ণ দাশশর্মা নামের একজন একবার লিখেছিলেন, ‘বিলেতের পাঞ্চ পত্রিকা একবার গড়ের পায়ে গড় করে লিখেছিল, “সরকারি পরিসংখ্যান থেকে জানতে পারলুম, এ দেশের প্রত্যেকটি পূর্ণবয়স্কা স্ত্রী লোকের গড়পড়তা ২.২টি করে সন্তান আছে; আমরা বলি কি, ওই দশমিক ভগ্নাংশ বাচ্চা নিয়ে মেয়েদের নিশ্চয়ই ভারী অসুবিধে হচ্ছে, সরকার থেকে সাহায্যটাহায্য দিয়ে আরও দশমিক আট সন্তান প্রসব করার জন্য ওদের উৎসাহ দেওয়া উচিত, যাতে করে প্রত্যেকটি মায়ের ছেলেপুলের সংখ্যা ভাঙাচোরা না থেকে গোটা গোটা হতে পারে।” এমন একটা সংগত প্রস্তাবে কেন যে ব্রিটিশ সরকার কান দেয়নি, আমি তো কিছুতেই ভেবে পাই না।’

নতুন বাজেটের কথাই ধরা যাক। অর্থমন্ত্রী বক্তৃতায় বলেছেন, দীর্ঘ প্রতীক্ষিত ভ্যাট আইনের সফল বাস্তবায়ন এবং দেশের অর্থনীতি সুদৃঢ় অবস্থানে থাকবে ধরে নিয়ে চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরের রাজস্ব আহরণ ও ব্যয়ের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হলেও বিশ্বব্যাপী মহামারি সৃষ্টিকারী কোভিড-১৯-এর প্রভাবে রাজস্ব আয় ও ব্যয় উভয়ই প্রত্যাশিত মাত্রার চেয়ে উল্লেখযোগ্য হারে কম হবে। অর্থমন্ত্রী এ নিয়ে আরও জানান, ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সময়ে যে রাজস্ব আদায় হয়েছে, তা বার্ষিক লক্ষ্যমাত্রার ৩৮ দশমিক ৩২ শতাংশ এবং একই সময়ে সরকারি ব্যয় বরাদ্দের ৩৫ দশমিক ৮৪ শতাংশ। 

আমরা জানি, গত মার্চ থেকেই অর্থনীতির দুরবস্থা বেড়েছে বেশি। আয় কমে গেছে সব ক্ষেত্রে। আর বাজেট বক্তৃতায় তা স্বীকার করে নিয়েছেনও অর্থমন্ত্রী। তারপরও সংশোধিত বাজেটে তিনি রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা কমিয়েছেন মাত্র ২৯ হাজার ৭৪৬ কোটি টাকা আর ব্যয়ের লক্ষ্য কমান ২১ হাজার ৬১৩ কোটি টাকা। এই তাহলে অর্থমন্ত্রীর ভাষায় ‘প্রত্যাশিত মাত্রার চেয়ে উল্লেখযোগ্য হারে কম’। 

সমস্যা এখানেই। কেননা, এর ওপর ভিত্তি করেই তো নতুন অর্থবছরের বাজেট তৈরি করা হয়েছে। বাস্তবতা বলছে, অর্থনীতি পর্যুদস্ত, আয় কমে গেছে, বিশ্ব অর্থনীতি মন্দা, শিগগিরই ভালো হওয়ার লক্ষ্মণ নেই। আবার এমন নয় যে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত অর্থনীতির সূচকগুলো খুব ভালো ছিল। অর্থমন্ত্রী প্রবাসী আয়ে ২ শতাংশ হারে নগদ প্রণোদনা দিয়েছিলেন। তার সরাসরি প্রভাবও ছিল। এর বাইরে আর প্রায় সব সূচকই ছিল নিম্নমুখী। তারপরও নতুন বাজেটে রাজস্ব আয় ও ব্যয়ে বড় ধরনের প্রবৃদ্ধির কথা বলা হয়েছে। আর প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য রাখা হয়েছে ৮ দশমিক ২ শতাংশ। অর্থনীতির অবস্থা যাই হোক না কেন, উচ্চাশার যেসব পরিসংখ্যান রয়েছে, তাতে বাজেটের বিশ্বাসযোগ্যতা নষ্ট হয়। বিশেষ করে মহামারির এই কঠিন এক সময়ে। এ সময়ে বড় বড় পরিসংখ্যান নয়, বরং জীবন ও জীবিকার প্রতিই সবার আগ্রহ। 

এখন কেউ বলতেই পারেন, এই বাজেট সফল করা কেবল বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) পক্ষে সম্ভব। অবশ্য এবার এ কাজটি করেছে অর্থ বিভাগ।

কর যখন আপনার বোঝা

করের দুই ভাগ থাকে। যেমন প্রত্যক্ষ কর ও পরোক্ষ কর। সংজ্ঞাটা এ রকম—একটি দেশের নাগরিকের আয় ও সম্পদের ওপর নির্দিষ্ট হারে আদায় করা সরকারি রাজস্ব হচ্ছে প্রত্যক্ষ কর। প্রত্যক্ষ কর হচ্ছে মূলত আয়কর, সম্পদ কর, ভ্রমণ কর ইত্যাদি। প্রত্যক্ষ করের দায়ভার সরাসরি নাগরিককেই বহন করতে হয়।

পরোক্ষ করও জনগণকেই দিতে হয়; যেমন মূল্য সংযোজন কর বা ভ্যাট। পণ্য ও সেবা উৎপাদন ও বিক্রির সময় যা দিতে হয়। এ ছাড়া আছে আমদানি, রপ্তানি ও অভ্যন্তরীণ ব্যবসায়-বাণিজ্যের ওপর আরোপ করা কর। সাধারণত পরোক্ষ কর পণ্য উৎপাদন বা বিক্রির সময় মূল্যের সঙ্গে সংযোজন করা থাকে। ক্রেতাকেই তা দিতে হয়, ব্যবসায়ী বা বিক্রেতারা সেই কর রাষ্ট্রের কোষাগারে জমা দেন। 

একটি প্রগতিশীল করব্যবস্থায় অন্তত ৫০ শতাংশ হতে হয় প্রত্যক্ষ কর। অথচ বাংলাদেশে পরোক্ষ করের পরিমাণ অনেক বেশি, ৬৫ শতাংশ। আর প্রত্যক্ষ কর ৩৫ শতাংশের মতো। এই পরিস্থিতিকে মোটেই একটি প্রগতিশীল বা গণতান্ত্রিক করব্যবস্থা বলা যায় না। এর অর্থ হচ্ছে, যাঁরা বেশি আয় করেন, তাঁরা সে অনুযায়ী কর দেন না। কর ফাঁকি এ ক্ষেত্রে একটি বড় সমস্যা। অন্যদিকে, পরোক্ষ করের ক্ষেত্রেও এই সমস্যা প্রকট। সাধারণ জনগণ পণ্য বা সেবা কেনার সময় কর দেন ঠিকই, কিন্তু তা শেষ পর্যন্ত রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা হয় না। দুর্নীতি এর বড় কারণ। এর সঙ্গে কর আদায়কারী কর্মকর্তাদের বড় ধরনের যোগসাজশ থাকে। 

আমরা জানি, কর-জিডিপি অনুপাতের দিক থেকে বাংলাদেশ একদম নিচের সারিতে আছে। বছরের পর বছর ধরে বাংলাদেশ প্রায় একই স্থানে। প্রতি বাজেটে কর-জিডিপি অনুপাত বাড়ানোর কথা বলা হলেও তা সফল হয় না। যাঁরা কর দেন না বা ফাঁকি দেন, তাঁদের করের আওতায় আনা তেমন সম্ভব হয় না। বাড়ে না করের আওতা। ফলে যাঁরা নিয়মিত কর দেন, তাঁদের ওপরেই চাপ বাড়ে। 

প্রত্যক্ষ করের ক্ষেত্রে আরেকটি বড় দুর্বলতা হচ্ছে, এর বড় অংশই আদায় হয় উৎসে। এ জন্য তেমন কোনো শ্রম দিতে হয় না এনবিআরকে। বিশেষ করে ব্যাংকের মাধ্যমে লেনদেন হলেই তা স্বয়ংক্রিয়ভাবে সরকারের কাছে চলে যায়। সহযোগী দৈনিক বণিক বার্তায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদন অনুসারে, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে এনবিআর আয়কর খাতে যে পরিমাণ রাজস্ব আহরণ করেছে, তার বড় অংশই এসেছে উৎসে কর বাবদ। এর হার ছিল প্রত্যক্ষ কর বাবদ পাওয়া মোট রাজস্বের ৬১ দশমিক শূন্য ৯ শতাংশ। এরপর সবচেয়ে বেশি এসেছে অগ্রিম আয়কর হিসাবে, ২৩ দশমিক ৫৭ শতাংশ। আর রিটার্নের ভিত্তিতে আয়কর আদায় হয় ৮ দশমিক ৩৪ শতাংশ, প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানি থেকে ২ দশমিক ১৯ শতাংশ এবং কোম্পানি ব্যতীত আদায় ১ দশমিক ৭৪ শতাংশ। 

আর উৎসে আদায়ের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আসে ঠিকাদারদের কাছ থেকে। বিল দেওয়ার সময়েই এই কর কেটে রাখা হয়। মোট উৎসে করের মধ্যে এর হার ২১ দশমিক ৯৬ শতাংশ। এ ছাড়া, আমদানিকারকদের কাছ থেকে ১৯ দশমিক ৬৭ শতাংশ, সঞ্চয়ী ও স্থায়ী আমানতের সুদ থেকে ১৫ দশমিক ৫৫ শতাংশ, সম্পত্তি হস্তান্তর খাত থেকে ৫ দশমিক ৭৮ শতাংশ, রপ্তানি বাবদ এসেছে ৭ দশমিক ৯২ শতাংশ, বেতন থেকে ৪ দশমিক ৫৯ শতাংশ, লভ্যাংশ থেকে ২ দশমিক ৭১ শতাংশ এবং প্রবাসী আয় খাতে উৎসে কর আদায় হয় ২ দশমিক ৪৩ শতাংশ। 

বাজেট কতটা আপনার 

বাজেটজুড়ে অনেক ধরনের পরিসংখ্যান থাকে। তবে সেই পরিসংখ্যানের ভিড়ে হারিয়ে যায় বাজেটের আসল তথ্য। তা ছাড়া, সাধারণ মানুষের কাছে ভারী ভারী পরিসংখ্যানের মূল্য কতটা, সেটিও বড় প্রশ্ন। বরং বাজেটে তাদের জন্য কী আছে, সেটাই মূল কথা। তারপরও বাজেট পরিসংখ্যান একবারেই উড়িয়ে দেওয়া যাবে না। আবার ছোট-বড় যেমনই হোক, এই বাজেট কিন্তু আপনার। আপনি যে টাকা নানা উপায়ে রাষ্ট্রের কোষাগারে জমা দিয়েছেন, সেই অর্থ দিয়েই কিন্তু বাজেটটি করা হয়েছে। 

উদাহরণ দিই। এবার বাজেটে রাজস্ব আয় ধরা হয়েছে ৩ লাখ ৭৮ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) আপনার কাছ থেকে আদায় করবে ৩ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ নতুন অর্থবছরে বাংলাদেশের নাগরিকদের কাছ থেকে পৌনে ৪ লাখ কোটি টাকার কিছু বেশি অর্থ আদায় করবে সরকার। এর মধ্যে সরাসরি আপনার কাছ থেকে আদায় প্রায় ৩৫ শতাংশ, বাকি পরোক্ষ আদায়। যা শেষ পর্যন্ত আপনার পকেট থেকেই যাবে। 

দেশে কর শনাক্তকরণ নম্বর বা টিআইএনধারীর সংখ্যা এখন ৪৬ লাখের বেশি। তবে তাঁরা সবাই কর দেন না। আয়কর দেন প্রায় ২২ লাখ করদাতা। সংখ্যাটা খুবই কম। অর্থাৎ এনবিআর সবার কাছ থেকে আয়কর আদায় করতে পারছে না। ফলে রাজস্ব আহরণের চাপ পড়ে সব ধরনের মানুষের ওপর। এই চাপটা বেশি অনুভব করেন সীমিত আয়ের মানুষেরা। ভ্যাট বা আমদানি শুল্ক সরকার যা আদায় করে, সেই অর্থ যায় ভোক্তাদের পকেট থেকেই। সুতরাং পুরো বাজেট আসলে সাধারণ মানুষের দেওয়া কর দিয়েই তৈরি। 

সরকার আপনার জন্য উন্নয়ন করে। উন্নয়ন প্রকল্প এমনভাবে নেওয়া হয়, যাতে এর ফল সবাই পায়। রাস্তাঘাট হলে চলাচলে সুবিধা হবে, উৎপাদিত পণ্য আনা–নেওয়া যাবে সহজে, বিদ্যুৎকেন্দ্র মানেই আরও বেশি আলো, পদ্মা সেতু হয়ে গেলে দক্ষিণাঞ্চলের সঙ্গে অন্য সব এলাকার যোগাযোগ সহজ হবে, সেখানে শিল্প গড় উঠবে, তাতে কাজ পাবে অনেক মানুষ। তবে সমস্যা হয় তখনই, যখন কম গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প নেওয়া হয়, রাস্তাটি কাজে লাগে ক্ষমতাশালীদের কেবল, কিংবা প্রকল্পের কেনাকাটার নামে চলে দুর্নীতি। আবার আপনার দেওয়া করের টাকাটা ঠিকমতো ব্যয় হলো কি না, সেই জবাবদিহির জায়গা নেই। এ কারণেই বাজেটটা শেষ পর্যন্ত আমার-আপনার হয়ে ওঠে না। 

অথচ আপনার দেওয়া কর থেকে নতুন অর্থবছরে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা হিসেবে দেওয়া হবে প্রায় ৬৭ হাজার কোটি টাকা, অবসরভাতা হিসেবে আরও প্রায় ২৮ হাজার কোটি টাকা, সরকার যে ঋণ করে বাজেটের ঘাটতি পূরণ করে, সেই সুদ পরিশোধে ব্যয় করবে প্রায় ৬৪ হাজার কোটি টাকা, সাহায্য মঞ্জুরি খাতেও খরচ করবে প্রায় ৬৩ হাজার কোটি টাকা। সরকারের অনুন্নয়ন খাতে এই বিপুল খরচের বিপরীতে আপনি সরকারের কাছ থেকে কী সেবাটা পাচ্ছেন, হয়রানি কতখানি হচ্ছেন, এর প্রতিকার কী—আপনার কিন্তু তা জানা নেই। দেশের বাজেট ব্যবস্থাপনার বড় সংকট এটাই। 

মাথায় কত প্রশ্ন আসে

সারা বিশ্ব যখন অর্থনীতি সামলাতে ব্যস্ত, আমাদের সব আগ্রহ তখন জিডিপি প্রবৃদ্ধি কত হবে তা নিয়ে। প্রতিবারই তা–ই হয়, বাদ যায়নি করোনাকালেও। এমনও হয় যে বাজেটের মূল আলোচনা বাদ দিয়ে আমরা সবাই জিডিপি নিয়েই কেবল কথা বলছি। সেটা অর্থমন্ত্রীর জন্য সুবিধা। অনেক বাস্তব সমালোচনা থেকে দূরে থাকতে পারেন। এবারও যেমন, বিপর্যস্ত অর্থনীতির মধ্যেও ৮ দশমিক ২ শতাংশ প্রবৃদ্ধির আকাঙ্ক্ষা নিয়ে কম কথা হচ্ছে না। 

বাজেট আলোচনা অন্য খাতে নেওয়ার আরেকটি মোক্ষম অস্ত্র হচ্ছে, কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া। বাজেটে অর্থমন্ত্রীরা প্রায়ই এই সুযোগ দিয়ে থাকেন। দেশে বিপুল পরিমাণ কালোটাকার অস্তিত্ব আছে বলে সবাই বিশ্বাস করেন। কিন্তু স্বাধীনতার পর ১৬ বার সুযোগ দেওয়া হলেও টাকাসাদা হয়েছে ১৬ হাজার কোটি টাকার বেশি না। তারপরও অর্থমন্ত্রীরা কাজটি আগ্রহ নিয়ে কেন করেন, সেটি একটা বড় প্রশ্ন। 

আবার এবার বাজেটে নগদ অর্থও সাদা করার সুযোগ রাখা হয়েছে। অর্থাৎ বালিশের নিচে রাখা টাকাও সাদা করা যাবে। আবার ব্যাংকে রাখা টাকার ওপর আবগারি শুল্ক বাড়ানো হয়েছে। এমনিতেই আমানতের সুদের হার কমানো হয়েছে। এর অর্থ টাকা বালিশের নিচেই রাখো।

এখন করোনার সময়ে সামাজিক দূরত্ব মেনে চলাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। দেখা না হলেও কথা তো বলতেই হবে। অথচ বাজেটে কথা বলার ওপরও শুল্ক বাড়ানো হয়েছে। সম্ভবত সহজ পথে রাজস্ব আয় বাড়ানোই এ উদ্দেশ্য।

বাজেটে অর্থমন্ত্রী বলেছেন, স্বাস্থ্য খাতকে এবার অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। তবে সেটা কীভাবে, তা পুরো বাজেট বক্তৃতা পড়েও উদ্ধার করা গেল না। কারণ, বরাদ্দের দিক থেকে এই খাত নবম। পরে মনে হলো, অতীতের কোনো বক্তৃতাতেই বাজেটের কাঠামো নিয়ে বলার পরে স্বাস্থ্য খাত নিয়ে বক্তৃতা শুরু হয়নি। এবার হলো। এটাই মনে হয় অগ্রাধিকার।

সমস্যার নাম যখন ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ

বড় প্রবৃদ্ধি আনতে হলে প্রয়োজন বড় বিনিয়োগ। ছবি: সংগৃহীত
বড় প্রবৃদ্ধি আনতে হলে প্রয়োজন বড় বিনিয়োগ। ছবি: সংগৃহীত

এবারের বাজেট উপস্থাপনের সময় অর্থনৈতিক সমীক্ষা পাওয়া যায়নি। ফলে অর্থনীতির অনেক হালনাগাদ তথ্যই পাওয়া যায়নি। তবে মধ্যমেয়াদি সামষ্টিক অর্থনৈতিক নীতি বিবৃতি প্রকাশ করা হয়েছে। সেখানে পাওয়া গেল বিনিয়োগের তথ্য। তবে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) তুলনায় বেসরকারি বিনিয়োগের তথ্য দেখে অনেকেই বিশ্বাস করতে পারেননি। দেখা গেছে, ২০১৯-২০ অর্থবছরে বেসরকারি বিনিয়োগের হার মাত্র ১২ দশমিক ৭ শতাংশ, যা আগের অর্থবছরে ছিল ২৪ দশমিক ২ শতাংশ। অনেকেই ভেবেছিলেন, এটি ছাপার ভুল। পরে অবশ্য ভুল ভাঙে সবার। প্রশ্ন হচ্ছে, বেসরকারি বিনিয়োগ হঠাৎ এত কমে গেল কীভাবে? তবে এটা ঠিক যে বেসরকারি বিনিয়োগে মন্দা ছিল। তবে সেটি ঠিক ১২ দশমিক ৭ শতাংশ কীভাবে হলো, সেটা একটা প্রশ্ন।

অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নির্ধারণের ক্ষেত্রে বেশ কিছু মডেল রয়েছে। এর মধ্যে হ্যারড-ডোমার মডেল এবং সলো মডেলই বেশি ব্যবহার হয়ে থাকে।

সলো মডেল মতে, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি তিনটি চালিকাশক্তির মাধ্যমে নির্ধারিত হয়। যেমন মোট পুঁজি, কাজে নিয়োজিত লোকের সংখ্যা এবং উৎপাদন পদ্ধতির দক্ষতা। আর হ্যারড-ডোমার মডেলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য সঞ্চয় ও বিনিয়োগের সম্পর্কের কথাই বলা হয়। মডেল অনুযায়ী, মোট পুঁজি ব্যবহার করে সব দেশে একই পরিমাণ উৎপাদন হয় না। পুঁজি ব্যবহারের দক্ষতা সব দেশের এক নয়। একে বলা হয়, পুঁজি-উৎপাদন অনুপাত বা ক্যাপিটাল-আউটপুট রেশিও। অর্থাৎ একক পুঁজি ব্যবহার করে কত একক উৎপাদন পাওয়া যায় সেটি।

উন্নত অনেক দেশে এই অনুপাত ৫ পর্যন্ত হয়। তবে বাংলাদেশে তা প্রায় ৪ শতাংশ। এই অনুপাত রাতারাতি বাড়ানো সম্ভব হয় না। 

এবার তাহলে বাংলাদেশ প্রসঙ্গে আসা যাক। সংশোধিত হিসেবে বেসরকারি বিনিয়োগের হার ১২ দশমিক ৭ শতাংশ। আর সরকারি বিনিয়োগ ৮ দশমিক ৬ শতাংশ। দুটো মিলিয়ে ২০ দশমিক ৮ শতাংশ। আর পুঁজি-উৎপাদন অনুপাত ৪ ধরলে হয় ঠিক ৫ দশমিক ২ শতাংশ। বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী বলেছেন, চলতি অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি হবে ৫ দশমিক ২ শতাংশ। অর্থাৎ অর্থ বিভাগ স্রেফ অঙ্ক মিলিয়েছে, আর কিছু না। 

আবার নতুন অর্থবছরের জন্য বিনিয়োগের লক্ষ্য হচ্ছে ৩৩ দশমিক ৫ শতাংশ। ৪ অনুপাত ধরলে হয় প্রায় ৮ দশমিক ৪। আর অর্থমন্ত্রী বলেছেন ৮ দশমিক ২ শতাংশের কথা। একটু তো সংশোধন হবেই, তাই না? 

ঘাটতি অর্থায়ন কেন গুরুত্বপূর্ণ

আয় ও ব্যয় সমান হলে সেটি সুষম বাজেট। সমান না হলে বাজেটটি অসম বাজেট। এই অসম বাজেট আবার দুই রকমের, উদ্বৃত্ত ও ঘাটতি বাজেট। সাধারণত উন্নত দেশগুলো বাণিজ্য চক্র মেনে সুষম বাজেট করে। অর্থাৎ অর্থনীতির ওঠানামার সঙ্গে সমন্বয় করে একটি নির্দিষ্ট অর্থবছরের বাজেট তৈরি করা হয়। অনেক উন্নত দেশ আইন করেও সুষম বাজেট তৈরি করে। 

সাধারণত অর্থনীতি ভালো অবস্থায় থাকলে সুষম বাজেট করা হয়, খারাপ হলে অর্থনীতিকে উদ্দীপনা দিতে তৈরি হয় ঘাটতি বাজেট। একটা সময় ছিল যখন ঘাটতি বাজেটকে ক্ষতিকর ও সরকারের দুর্বলতাও ভাবা হতো। এখন অর্থনীতিবিদেরা মনে করেন, বাংলাদেশের মতো দরিদ্র দেশে কিছুটা ঘাটতি থাকা ভালো। এতে অব্যবহৃত সম্পদের ব্যবহার বাড়ে, ঘাটতি পূরণের চাপ থাকে। তাতে অর্থনীতিতে উদ্দীপনা সৃষ্টি হয়। ঘাটতি বেশি থাকাটা আবার ভালো নয়। আর আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) প্রেসক্রিপশন হচ্ছে, এই ঘাটতি জিডিপির ৫ শতাংশের মধ্যে রাখতে হবে। বাংলাদেশ এটি অনুসরণ করে আসছে। আর বাংলাদেশ প্রতিবছরে তা বজায় রাখতে পারছে মূল এডিপি পুরোপুরি বাস্তবায়ন করতে না পারার কারণে। ফলে আয় কম হলেও ব্যয় ঠিকই কম হয়। তাতে ঘাটতি ৫ শতাংশের মধ্যেই থাকে। 

বাজেট ঘাটতি দুই ভাবে পূরণ করা হয়। বৈদেশিক উৎসের মধ্যে আছে বৈদেশিক ঋণ। সরকার বিভিন্ন দাতা সংস্থা ও দেশ থেকে সহজ শর্তে ঋণ নেয়। এই উৎস থেকে বেশি ঋণ নিয়ে ঘাটতি পূরণ করা অর্থনীতির জন্য বেশি সহনীয়। এতে সুদহার কম এবং পরিশোধ করতে অনেক সময় পাওয়া যায়। অভ্যন্তরীণ উৎস বা দেশের ভেতর থেকে থেকে সরকার দুই ভাবে ঋণ নেয়। যেমন ব্যাংকিং ব্যবস্থা ও ব্যাংকবহির্ভূত ব্যবস্থা। ব্যাংকবহির্ভূত ব্যবস্থা হচ্ছে সঞ্চয়পত্র বিক্রি। এর মাধ্যমে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে ঋণ নেয় সরকার। অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে বেশি ঋণ নেওয়ার দুটি বিপদ আছে। এর মধ্যে ব্যাংকিং ব্যবস্থা থেকে সরকার বেশি ঋণ নিলে বেসরকারি খাতের জন্য অর্থ থাকবে কম। ফলে বিনিয়োগ কমে যায়। আর ব্যাংকবহির্ভূত ব্যবস্থা থেকে ঋণ নিলে বেশি হারে সুদ দিতে হয়। এতে সুদ পরিশোধে সরকারকে বেশি পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ রাখতে হয়। ফলে পরের অর্থবছরের বাজেট বেড়ে যায়। সরকার বেশি পরিমাণ ঋণ নিলে মূল্যস্ফীতিও দেখা দিতে পারে। 

করোনার বাধ্যবাধকতায় এবার বাজেট ঘাটতি রাখা হয়েছে ৫ দশমিক ৮ শতাংশ। এবার তা ৬ শতাংশ ছাড়িয়ে গেলেও আইএমএফ হয়তো আপত্তি করবে না। তবে বৈদেশিক উৎস থেকে অর্থ পেলে সেটাই হবে সবচেয়ে ভালো। কেননা, ব্যাংকের ওপর প্রণোদনা বাস্তবায়নের চাপ আছে। বাড়াতে হবে বেসরকারি বিনিয়োগ। সুতরাং এখানে সরকারের হাত না দেওয়াই ভালো।