করোনায় ঘুরছে বাইসাইকেলের চাকা

করোনাভাইরাস অনেক পণ্যের চাহিদা কমিয়ে দিলেও বাড়িয়ে দিয়েছে বাইসাইকেল বিক্রি। সংক্রমণের ঝুঁকি এড়াতে গণপরিবহনে উঠছেন না অধিকাংশ মানুষ। গন্তব্যে পৌঁছাতে তাই বিকল্প বাহন হিসেবে তাঁদের অনেকে বাইসাইকেল বেছে নিচ্ছেন। এর ফলে দেশের অভ্যন্তরে দুই চাকার পরিবেশবান্ধব এ যানটির চাহিদা বাড়ছে ক্রমেই।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, বাচ্চাদের বাইসাইকেল সব সময়ই কমবেশি বিক্রি হয়। পাশাপাশি ছাত্রছাত্রী ও স্বাস্থ্যসচেতন মানুষজন সাইকেল কিনে থাকেন। তবে করোনাকালে কর্মজীবী মানুষজনের কাছেও বাহনটি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। সে কারণে গত মাস থেকে ৪ হাজার থেকে ২০ হাজার টাকা দামের বাইসাইকেলের বিক্রি বেশ বেড়েছে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দেশে বছরে প্রায় ১৫ লাখ বাইসাইকেলের চাহিদা রয়েছে। সেই চাহিদার ৭০ শতাংশ মেটাচ্ছে আমদানি হওয়া বাইসাইকেল। আর বাকি ৩০ শতাংশের জোগান দিচ্ছে দেশের কয়েকটি প্রতিষ্ঠান। যদিও তাদের রপ্তানি বাজারের দিকে বেশি নজর। সব মিলিয়ে দেশে বাইসাইকেলের বাজারের আকার প্রায় ১ হাজার ২০০ কোটি টাকার।

দেশে বাইসাইকেলের বড় পাইকারি বাজার পুরান ঢাকার বংশাল। এখানকার বেশ কয়েকজন ব্যবসায়ী চীন ও ভারত থেকে সাইকেলের যন্ত্রাংশ আমদানি করে সংযোজন করেন। বংশালে পাইকারি ও খুচরা বিক্রির জন্য প্রায় ৩০০টি দোকান রয়েছে। তবে করোনায় বাইসাইকেলের বিক্রি বৃদ্ধি নিয়ে এখানের ব্যবসায়ীরা একেকজন একেক ধরনের তথ্য দিলেন।

বংশালের বাইসাইকেলের প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ীদের মধ্যে অন্যতম সিরাজুল ইসলাম। সিরাজ সাইকেল ইন্ডাস্ট্রি নামের প্রতিষ্ঠানের এই কর্ণধার প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাইসাইকেলের খুচরা বিক্রি খুব বেশি বাড়েনি। দিনে ৫-৬টির বেশি বিক্রি হচ্ছে না। তবে মফস্বলে চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় পাইকারি বিক্রি বেড়েছে।’

জানতে চাইলে বাংলাদেশ বাইসাইকেল মার্চেন্ডস অ্যাসেম্বলিং অ্যান্ড ইমপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিবিএমএআইএ) যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ইমরান আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, করোনার কারণে অনেক কর্মজীবী মানুষ গণপরিবহন এড়িয়ে চলছেন। তাঁদের একটি অংশ বাইসাইকেল কিনছেন। তাতে আমদানি হওয়া বাইসাইকেল বিক্রি ১০-১৫ শতাংশ বেড়েছে। তবে সারা দেশে শক্তিশালী নেটওয়ার্ক থাকায় দেশীয় উদ্যোক্তাদের বিক্রি অনেক বেড়েছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।

অপর এক প্রশ্নের জবাবে ইমরান আহমেদ বলেন, বংশালের ব্যবসায়ীরা চীন ও ভারত থেকে আমদানি করা বাইসাইকেলের যন্ত্রাংশ দেশে সংযোজন করে বিক্রি করেন। তবে আগামী ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে এসব যন্ত্রাংশ আমদানিতে শুল্ক ৭-১০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। তাতে করে আমদানি করা বাইসাইকেলের দাম বাড়তে পারে।

অন্যদিকে করোনায় বিক্রি বাড়েনি বলে দাবি করে বিবিএমএআইএর সাধারণ সম্পাদক হাবিবুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা আশা করেছিলাম বিক্রি বাড়বে। তবে বাস্তবে বিক্রি বাড়েনি।’ বর্তমানে যেসব বাইসাইকেলের চাহিদা বেশি, সেগুলোর সরবরাহ নেই বলেও অভিযোগ করেন তিনি।

>

দেশে বছরে প্রায় ১৫ লাখ বাইসাইকেলের চাহিদা রয়েছে
তার ৭০ শতাংশ আমদানি করা বাইসাইকেলের দখলে।

বাংলাদেশ থেকে বাইসাইকেল রপ্তানিতে নেতৃত্ব দিচ্ছে মেঘনা গ্রুপ। ১৯৯৬ সালে ঢাকার তেজগাঁওয়ে সরকারি বাইসাইকেল তৈরির প্রতিষ্ঠানটি কিনে নেয় তারা। তিন বছর পর রপ্তানি শুরু করে। বর্তমানে ট্রান্সওয়ার্ল্ড বাইসাইকেল, ইউনিগ্লোরি ও মাহিন সাইকেল ইন্ডাস্ট্রিজ নামের তিনটি ইউনিটে সাইকেল উৎপাদন করছে মেঘনা গ্রুপ। তা ছাড়া সাইকেলের বিভিন্ন সরঞ্জাম, টায়ার ও টিউব উৎপাদনও করে তারা। সব মিলিয়ে ৭০ শতাংশ যন্ত্রপাতি দেশেই তৈরি করে। রপ্তানির পাশাপাশি বেশ কিছুদিন ধরে দেশের বাজারেও বাইসাইকেল বিক্রি করছে প্রতিষ্ঠানটি।

জানতে চাইলে মেঘনা গ্রুপের পরিচালক মো. লুৎফুল বারী প্রথম আলোকে বলেন, ‘এ করোনাকালে সামাজিক দূরত্ব মেনে চলতে অনেকেই সাইকেলকে বাহন হিসেবে বেছে নিচ্ছেন। এ কারণে সাইকেল কেনায় আগ্রহ কিছুটা বেড়েছে সাম্প্রতিক সময়ে। তার সঙ্গে চলতি মাস থেকে বেড়েছে বিক্রিও। তবে মাস শেষ হলে বলা যাবে বিক্রি কত শতাংশ বৃদ্ধি পেল।’ বর্তমানে ৮-১২ হাজার টাকা দামের সাইকেল বেশি বিক্রি হচ্ছে বলে জানান লুৎফুল বারী।

অপর এক প্রশ্নের জবাবে লুৎফুল বারী বলেন, ‘দেশের পাশাপাশি করোনার কারণে পর্তুগালসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশেও বাইসাইকেলের চাহিদা বেড়েছে। এ জন্য নতুন নতুন ক্রয়াদেশও আসতে শুরু করেছে। আশা করছি, শিগগিরই বাইসাইকেল রপ্তানি বাড়বে।’

প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান রংপুর মেটাল ইন্ডাস্ট্রিজ দুরন্ত ব্র্যান্ড নামের বাইসাইকেল প্রস্তুত ও বিক্রি করছে। বর্তমানে দেশে দুরন্তের ৯০টি বিক্রয়কেন্দ্র রয়েছে। তা ছাড়া ডিলার প্রতিষ্ঠানও তাদের বাইসাইকেল বিক্রি করে। ২০১৪ সাল থেকে রপ্তানিও করছে প্রতিষ্ঠানটি। হবিগঞ্জে তাদের কারখানায় বছরে ৫ লাখ বাইসাইকেল উৎপাদিত হয়।

জানতে চাইলে প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের বিপণন পরিচালক কামরুজ্জামান কামাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘আগে শুধু তরুণেরা বাইসাইকেল কিনলেও বর্তমানে করোনার কারণে কর্মজীবী নানা বয়সের লোকজনও কিনছেন। সে কারণে গত মাসে আমাদের বাইসাইকেল বিক্রি ৫০ শতাংশ বেড়েছে। চলতি মাসেও ভালো বিক্রি হচ্ছে। বিক্রয়কেন্দ্রের পাশাপাশি অনলাইনেও বাইসাইকেল বিক্রি হচ্ছে।’

কামরুজ্জামান কামাল আরও বলেন, ‘ইউরোপের দেশগুলোতে লকডাউন উঠে যাচ্ছে। আশা করছি, সামনের দিনগুলোতে সাইকেল রপ্তানিও বাড়বে। অন্যদিকে দেশেও গণপরিবহন এড়িয়ে চলার প্রবণতা বেড়েছে। অনেকেই বিকল্প যান হিসেবে বাইসাইকেল বেছে নেওয়ায় সামনের দিনগুলোতে বিক্রি আরও বাড়বে বলে মনে হচ্ছে।’