ছোট উদ্যোক্তাদের ঋণ পাওয়া কঠিন, ব্যাংকের অনাগ্রহ

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

দেশের কুটির ও ক্ষুদ্র শিল্প উদ্যোক্তাদের ঋণ প্রাপ্তি বর্তমানে অনেক বেশি দুষ্প্রাপ্য হয়ে উঠেছে। ব্যাংক খাতে ঋণের সুদহার ৯ শতাংশ বেঁধে দেওয়ায় ব্যাংকগুলো এখন ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের ঋণ দিতে চাইছে না। একই কারণে মাঝারি উদ্যোক্তারাও আগের মতো ঋণ পাচ্ছেন না। ফলে সব মিলিয়ে বিপাকেই পড়েছে দেশের কুটির, ক্ষুদ্র, ছোট ও মাঝারি শিল্প (সিএমএসএমই) প্রতিষ্ঠানগুলো।

গত এপ্রিল থেকে ক্রেডিট কার্ড ছাড়া সব ধরনের ঋণের সুদহার ৯ শতাংশ নির্ধারণ করে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। ঋণের সুদহার কমার পাশাপাশি কমেছে আমানতের সুদহার। এতে ব্যাংকের আমানতেও টান পড়েছে। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে করোনার ধাক্কা। এ ধাক্কায় অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বড়, ছোট, মাঝারি—সব ধরনের প্রতিষ্ঠান।

করোনার অর্থনৈতিক ক্ষতি পোষাতে সরকার কুটির, ক্ষুদ্র, ছোট ও মাঝারি খাতের জন্য ২০ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা
করেছে। সুদ কম হওয়ায় এ প্যাকেজের আওতায় ঋণ নিতে আগ্রহী উদ্যোক্তারা। কিন্তু গ্রাহকের আগ্রহে তেমন সাড়া দিচ্ছে না ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো। যতটুকু ঋণ দেওয়া হচ্ছে, তা থেকে ক্ষুদ্র ও ছোটরা বঞ্চিতই থাকছে, পাচ্ছেন মাঝারি শ্রেণির উদ্যোক্তারা। এ অবস্থায় ক্ষুদ্র ও ছোটরা যাতে ঋণ পায় তার জন্য ২০ হাজার কোটি টাকা ঋণের ১০ হাজার কোটি টাকা পুনঃ অর্থায়ন করবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এ ঋণের সুদের মাত্র ৪ শতাংশ দিতে হবে উদ্যোক্তাদের, বাকি ৫ শতাংশ সুদ সরকার দেবে।

সিএমএসএমই খাতের ঋণে গতি ফেরাতে তদারকি বাড়িয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। গত সপ্তাহে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে পাঠানো চিঠিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলেছে, প্রণোদনা প্যাকেজের আওতায় ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ঋণ বিতরণ কার্যক্রমে আশানুরূপ গতি নেই। তাই তদারকি জোরদার করার আবশ্যকতা দেখা দিয়েছে। এ ছাড়া এই খাতের ঋণ বাড়াতে ঋণ নিশ্চয়তা কর্মসূচি (ক্রেডিট গ্যারান্টি স্কিম) চালুর উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

তবে এতেও ঋণ খুব বেশি বাড়বে বলে মনে করেন না ব্যাংকাররা। তাঁরা বলছেন, ব্যাংকগুলোর তহবিল খরচ কমপক্ষে ৬ শতাংশ। পরিচালনা খরচ ও প্রশাসনিক ব্যয় আরও ৫ শতাংশ। তাতে ছোট ছোট ঋণ দিয়ে ব্যাংকগুলো খরচ পোষাতে পারবে না। আবার এ ধরনের ঋণের একটি অংশ প্রত্যন্ত অঞ্চলে দিতে হয়। তাতে খরচ আরও বেশি পড়ে। তাই এসএমই খাতের ঋণের একটি বড় অংশই পাবেন শহরের প্রতিষ্ঠিত উদ্যোক্তারা। কারণ, এতে পরিচালনা খরচ কম।

ব্র্যাক ব্যাংকের ঋণের বড় অংশই এসএমই খাতে। জানতে চাইলে ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক সেলিম আর এফ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘৯ শতাংশ সুদে ক্ষুদ্র ও ছোট উদ্যোক্তাদের ঋণ দেওয়া সম্ভব নয়। কারণ, এসব ঋণের খরচ অনেক বেশি। আমরা ১৩-১৪ শতাংশে ঋণ দিতাম, উদ্যোক্তারাও ভালো ব্যবসা করছিল। এখন তারা ব্যাংক থেকে ঋণ না পেলে ২৫ শতাংশ সুদে এনজিও থেকে নেবে। এতে তারা লোকসানে পড়ে যাবে। যার প্রভাব পড়বে দেশের কর্মসংস্থানেও।’

>আজ বিশ্ব এসএমই দিবস
কম সুদে ঋণ পেতে এসএমই খাতের উদ্যোক্তাদের আগ্রহ যত বাড়ছে, ঋণদাতা ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো তত দূরে সরে যাচ্ছে।

সম্প্রতি বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) এক জরিপে উঠে এসেছে, দেশের এমএসএমই খাতে সব মিলিয়ে ১৩ লাখ ইউনিট রয়েছে। মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপির ২৫ শতাংশ আসে এই খাত থেকে। আবার শিল্প খাতের কর্মসংস্থানের ৮৬ শতাংশই এই খাতে, যা সংখ্যায় প্রায় ১ কোটি। এই খাত মাসে প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকার পণ্য উৎপাদন করে, মজুরি দেয় প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকা। তবে এই খাতের মাত্র ৩৮ শতাংশ প্রতিষ্ঠান ব্যাংকঋণ পায়।

এসএমই ফাউন্ডেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সফিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ব্যাংকগুলো ক্ষুদ্র ও ছোট উদ্যোক্তাদের ঋণ
দেবে না। এ জন্য বিসিক, এসএমই ফাউন্ডেশন ও ক্লাস্টারগুলোকে সঙ্গে নিয়ে নতুন পরিকল্পনা করতে হবে।

ভৈরবের উদ্যোক্তা মাজহারুল ইসলাম জুতা তৈরি করেন। দেশের বিভিন্ন বাজারে তাঁর তৈরি জুতা বিক্রি হয়। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের মতো ব্যবসায়ী ব্যাংকে যেতে পারে না। তাই ক্ষুদ্র ঋণদাতা প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নিতে হয়। তারাও ঋণ দিতে চায় না।’

 বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, সরকারের প্রণোদনা প্যাকেজের আওতায় গত মে পর্যন্ত পাঁচটি ব্যাংক এই খাতে ২০০ কোটি টাকার ঋণ অনুমোদন করেছে। ব্যাংক পাঁচটি হলো শাহজালাল, অগ্রণী, বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক (বিকেবি), মার্কেন্টাইল ও দি সিটি ব্যাংক।

সিটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাসরুর আরেফিন প্রথম আলোকে বলেন, খুচরা, ক্ষুদ্র ও ছোট ঋণে খরচ পড়ে ১৩ শতাংশ। কেন ব্যাংক তা ৯ শতাংশে দেবে? লোকসান হলেও সিটি ব্যাংক এ খাতে ৪০ কোটি টাকার ঋণ অনুমোদন করেছে। বেছে বেছে ভালো উদ্যোক্তাদের দেওয়া হচ্ছে।

প্রণোদনা প্যাকেজের আওতায় সিএমএসএমই খাতে সবচেয়ে বেশি ঋণ দিতে পারবে ইসলামী ব্যাংক। ব্যাংকটি ২ হাজার ৭৫ কোটি টাকা ঋণ দিতে পারবে।

জানতে চাইলে ইসলামী ব্যাংকের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক আবু রেজা মো. ইয়াহিয়া প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা যাচাই-বাছাই
করে এ খাতের ঋণ অনুমোদন করছি। এ জন্য সময় লাগছে।’

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে দেশে এসএমই খাতে মোট ঋণের পরিমাণ ২ লাখ ১৯ হাজার ২৯৩ কোটি টাকা। একজন উদ্যোক্তা সর্বোচ্চ ৭৫ কোটি টাকা পর্যন্ত এসএমই ঋণ নিতে পারেন।