করোনায় জয়নালের স্বপ্নভঙ্গ, আয়-ব্যয়ে মন্দা

সূত্র: এনবিআর ও আইএমইডি
সূত্র: এনবিআর ও আইএমইডি

জয়নাল আবেদীন একটি বড় প্রতিষ্ঠানে ভালো বেতনে চাকরি করেন। পরিবার নিয়ে উত্তরায় ভাড়া ফ্ল্যাটে থাকেন। দুই ছেলেকে ভালো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়ান। বছরে পরিবার নিয়ে এখানে-সেখানে ঘুরতে যেতেন। প্রতি মাসে অন্তত দুবার পরিবার নিয়ে দামি রেস্তোরাঁয়ও খেতেন। গত বছর পর্যন্ত সবই এভাবেই চলছিল। এ বছর অফিসের পদোন্নতির তালিকায়ও ছিলেন। ভেবেছিলেন, পদোন্নতি পেলে দেশের বাইরে পরিবারে নিয়ে ঘুরতে যাবেন। ঈদের বোনাসের টাকায় ঘরের পুরোনো সোফাসেট পাল্টাবেন।

কিন্তু করোনা জয়নাল আবেদীনের সব পরিকল্পনা তছনছ করে দিল। ঈদে বোনাস পেলেন না। বার্ষিক বেতন বৃদ্ধি-পদোন্নতিও স্থগিত এ বছর। এখন দুশ্চিন্তা বেতন কমানো নিয়ে। ঘোরাঘুরি, রেস্টুরেন্টে খেতে যাওয়া, সোফাসেট পাল্টানোর পরিকল্পনা আগেই বাদ দিয়েছেন। এখন বেতন কমার দুশ্চিন্তায় সংসারের খরচও কাটছাঁট শুরু করেছেন। বেশি ভাড়ার ফ্ল্যাট ছেড়ে একটু কম ভাড়ার ফ্ল্যাটে উঠবেন কি না ভাবছেন।

জয়নাল সাহেবের মতো একই অবস্থা চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেটের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদেরও। আয়-ব্যয়ের হিসাব মিলছে না। যত খরচের কথা মাথায় রেখে আয়ের চিন্তা করা হয়েছিল, সেখানে গন্ডগোল লাগিয়ে দিয়েছে করোনা। নতুন ভ্যাট আইনের মাধ্যমে বেশি রাজস্ব আদায়ের স্বপ্ন ছিল রাজস্ব কর্মকর্তাদের। অর্থবছরের শেষভাগে এসে সেখানে কেবলই হতাশা।

চলতি অর্থবছরের জন্য সোয়া পাঁচ লাখ কোটি টাকার রাষ্ট্রীয় খরচ তথা বাজেট দেওয়া হয়েছিল। আর তাতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) আয়ের লক্ষ্য দেওয়া হয়েছিল সোয়া তিন লাখ টাকার বেশি। রাষ্ট্রীয় খরচের একটি বড় অংশ বেতন–ভাতা, ঋণ ও সুদ পরিশোধে ব্যয় করতেই হবে। এর বাইরে ২ লাখ ১৪ হাজার কোটি টাকা বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) খরচ করার কথা। বড় প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন হবে, মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি আরও বাড়বে—এটাই ছিল সরকারের স্বপ্ন।

>করোনা সংকট তছনছ করে দিয়েছে সরকারের আয়-ব্যয়ের হিসাব। গত ১১ মাসে রাজস্ব আদায় ও বার্ষিক উন্নয়নে অর্থ ব্যয় আগের চেয়ে কমেছে।

কিন্তু করোনা যেমন জয়নাল সাহেবের বোনাস, ইনক্রিমেন্ট ও পদোন্নতি বন্ধ করে দিয়েছে, তেমনি এনবিআরের বাড়তি রাজস্ব আদায়ের স্বপ্নও কেড়ে নিয়েছে। দোকানপাট বন্ধ থাকায় ও আমদানি কমে যাওয়ায় শুল্ক-কর আদায় কমেছে। বড় বড় প্রকল্পের গতি কমে গেছে। অর্থবছর শেষে সরকার বাজেটের অর্থের যোগ-বিয়োগের হিসাব হয়তো ঠিকই মিলিয়ে দেবে, কিন্তু করোনার ক্ষত সহজে মেলানো যাবে বলে মনে হয় না।

সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান প্রথম আলোকে বলেন, এ বছর রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য অর্জিত হবে না। করোনার কারণে ব্যবসা-বাণিজ্য পরিস্থিতি আগামী অর্থবছরেও খারাপ থাকবে। তাই রাজস্ব আদায়ে সামনে বছরও বেগ পেতে হবে। আবার করোনার শুরুতে বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নে যথাযথ প্রস্তুতি নেওয়া হয়নি। এ কারণে এডিপির খরচ কমতে শুরু করে।

রাজস্ব আদায় কমতে পারে

গত এপ্রিল মাসজুড়েই সাধারণ ছুটি থাকায় দোকানপাট বন্ধ ছিল। মে মাসের শেষভাগে সীমিত পরিসরে দোকানপাট ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান খুলেছে। ফলে, পাইকারি ও খুচরা পর্যায়ে বেচাকেনা বন্ধ থাকায় স্থানীয় পর্যায়ে ভ্যাট আদায় তেমন হয়নি। ওই দুই মাসে মাত্র ১২ হাজার কোটি টাকার ভ্যাট আদায় হয়েছে। অথচ প্রতি মাসে সাড়ে নয় হাজার কোটি টাকার ভ্যাট আদায়ের সংশোধিত লক্ষ্য রয়েছে। এ বছর ভ্যাটের ১ লাখ ৮ হাজার ৬০০ কোটি টাকার লক্ষ্য অর্জনে এখন চলতি মাসেই আদায় করতে হবে ৩২ হাজার কোটি টাকা।

চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে আমদানি–রপ্তানি ব্যাপক হারে কমেছে গত এপ্রিল-মে মাসে। প্রতি মাসে যেখানে গড়ে ছয় হাজার কোটি টাকার শুল্ক-কর আদায় হতো, সেখানে গত দুই মাসের গড় দুই থেকে আড়াই হাজার কোটি টাকা। আমদানি-রপ্তানি ও ভ্যাট আদায় কমলে আয়করও কমবে—এটাই স্বাভাবিক।

করোনা এবার আরেকটি নজিরবিহীন ঘটনার সাক্ষী করিয়েছে শুল্ক-কর কর্মকর্তাদের। সেটি হলো জুলাই-মে মাসের হিসাবে আগেরবারের চেয়ে ৪ হাজার ৬৮৯ কোটি টাকা কম রাজস্ব আদায় হয়েছে। এ সময়ে আদায় হয়েছে ১ লাখ ৮৮ হাজার ৫১৩ কোটি টাকা। এখন সংশোধিত লক্ষ্য অর্জনে চলতি জুন মাসেই ১ লাখ ১২ হাজার কোটি টাকা আদায় করতে হবে। গত ১১ মাসের যা রাজস্ব আদায় হয়েছে, লক্ষ্য অর্জন করতে হলে তার অর্ধেকর বেশি আদায় করতে হবে এক মাসে।। জুন মাসে প্রায় ৪৬ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আদায় করতে হবে। এনবিআর এক মাসে এত টাকা কখনোই আদায় করতে পারেনি।

এডিপি

মার্চ, এপ্রিল ও মে—এই তিন মাসে পদ্মা সেতু প্রকল্পের অগ্রগতি মাত্র ৩ শতাংশ। চীনা প্রকৌশলীরা দীর্ঘদিন কাজে ফিরতে পারেননি। যখন ফিরেছেন, তখন আবার দেশের করোনা সংকট প্রকট। এ কারণে স্থানীয় শ্রমিকসংকট দেখা দেয়। তাই পদ্মা সেতুর অগ্রগতি কাঙ্ক্ষিত হারে হয়নি। একই অবস্থা মেট্রোরেল, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রেরও। এই মেগা প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়নের স্বাভাবিক গতি থামিয়ে দিয়েছে করোনা। তাই নির্দিষ্ট সময়ে এসব প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়া নিয়েও শঙ্কা তৈরি হয়েছে।

এ ছাড়া এপ্রিল-মে মাসে স্থানীয় পর্যায়ে রাস্তাঘাট নির্মাণের বেশির ভাগ প্রকল্পের কাজ করতে পারেননি ঠিকাদারেরা। ফলে সার্বিকভাবে এডিপির খরচেও বেসামাল অবস্থা। অর্থবছরের জুলাই-মে পর্যন্ত ১১ মাসের হিসাবে গতবারের চেয়ে এবার প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকা কম খরচ হয়েছে। গত এক দশকের মধ্যে সর্বনিম্ন ৫৭ শতাংশ এডিপি বাস্তবায়ন হয়েছে এবার, যা গতবারের চেয়ে ১০ শতাংশ কম।

করোনা পরিস্থিতি দীর্ঘ মেয়াদে চললে আগামী অর্থবছরে পরিস্থিতির খুব বেশি উন্নতি হবে না—এমন শঙ্কা প্রকাশ করছেন অর্থনীতিবিদেরা। জয়নাল সাহেব যেমন নিজের আয় কমে যাওয়ায় কম দামি ভাড়া বাসার কথা চিন্তা করছেন, জীবনযাত্রায় খরচ কমাতে চাইছেন, তেমনি অর্থনীতি বা ব্যবসা-বাণিজ্যে শ্লথগতি থাকলে রাজস্ব আদায় কম হবে, উন্নয়ন প্রকল্পে খরচে সাশ্রয়ী হতে হবে।

তাই সানেমের নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হানের পরামর্শ, কর্মসংস্থান হয়—এমন প্রকল্পেই বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। এ বছরের শিক্ষাকে কাজে লাগিয়ে আগামী বছরের জন্য একটি পরিকল্পনা এখনই করা উচিত।