ডিম-মুরগির দামে ব্যাপক ওঠানামা

ডিম ও মুরগির দাম একবার মাটিতে নামছে, তো আবার আকাশে উঠছে। করোনা সংকট শুরুর সময়ে মার্চে দেশের সব খাদ্যপণ্যের দাম বাড়ছিল। তখন একমাত্র ডিম ও মুরগির দাম কমে যায়। ফেব্রুয়ারির তুলনায় অর্ধেকে নেমে আসে। উৎপাদন খরচের অর্ধেকেরও কম দামে বিক্রেতারা এ দুটি পণ্য বিক্রি করেছেন। কিন্তু গত এক সপ্তাহে দেশে বেশির ভাগ নিত্যপণ্যের দাম যখন কিছুটা কমতির দিকে, তখন ডিম ও মুরগির দাম বাড়ছে।

সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাবে, গত এক মাসে ডিমের দাম হালিতে পাঁচ টাকা আর মুরগির মাংসের দাম কেজিতে ১০ টাকা বেড়ে গেছে। প্রতি সপ্তাহে এই দুটি পণ্যের দাম ১ থেকে ৩ টাকা করে বাড়ছে। এই হিসাবে বাজারে একেকটি ডিম ৯ টাকা ও মুরগির মাংস ১৬০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে।

অন্যদিকে, গত এক সপ্তাহে এক থেকে দুই দিনের মুরগির বাচ্চার দাম বাড়তে বাড়তে ৫৫ থেকে ৬০ টাকায় পৌঁছেছে। ফলে এসব বাচ্চা উৎপাদনকারী খামার ভালো লাভ করছে। তবে দুই মাস আগেও এসব খামারি বিপদে ছিলেন। মার্চ থেকে মে মাস পর্যন্ত তাঁরা উৎপাদিত মুরগির বাচ্চার অর্ধেকের বেশি বিক্রি করতে পারেননি। একেকটি বাচ্চার উৎপাদন খরচ ৩০ থেকে ৩৫ টাকা হলেও তখন বিক্রি হয়েছে ৫ থেকে ১০ টাকায়। এসব খামারের প্রায় ৪৫ শতাংশ বন্ধ হয়ে গেছে।

পোলট্রিশিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, মুরগির বাচ্চার দাম হঠাৎ বেড়ে যাওয়ার ফলে সামনে মুরগি ও ডিমের বাজারে তার প্রভাব পড়বে। কারণ, এখন যেসব পরিণত মুরগি বাজারে বিক্রি হচ্ছে, তা বাচ্চা হিসেবে ৩০ থেকে ৩৫ টাকা করে কেনা ছিল। তাতেই গত এক মাসে মুরগির দাম ১৪০ থেকে থেকে বেড়ে ১৫০ টাকা হয়ে গেছে। তাই এখন বাড়তি দামে কেনা বাচ্চা বড় করে বিক্রি করতে গিয়ে আরও বেশি দাম চাইতে পারেন খামারিরা।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে বাংলাদেশ পোলট্রি কো-অর্ডিনেশন কমিটির (বিপিআইসিসি) সভাপতি মশিউর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘করোনা সংকটের কারণে আমাদের এই খাতের ৬৫ হাজার উদ্যোক্তার সাড়ে ৭ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। বিশেষ করে ছোট ও মাঝারি খামারিদের ৪০ থেকে ৪৫ শতাংশ পুঁজি হারিয়ে পথে বসে গেছে। এর ফলে উৎপাদনও অনেক কমে গেছে। এখন মুরগির মাংস ও ডিমের চাহিদা কিছু বেড়ে যাওয়ায় দাম বাড়ছে। তবে এখনই যদি এসব খামারিকে কিছুটা পুঁজিও যদি না দেওয়া যায়, তাহলে সামনে আরও বিপদ বাড়বে।’

চলতি মাসে বিআইডিএস থেকে দেশের ক্ষুদ্র এবং মাঝারি উদ্যোক্তারা করোনার কারণে কী ধরনের সংকটে আছেন এবং সেখান থেকে কীভাবে তাঁদের উদ্ধার করা যায়, তা নিয়ে একটি গবেষণা করা হয়েছে। বিআইডিএসের গবেষণা ফেলো মনজুর হোসেনের নেতৃত্বে ওই গবেষণায় বলা হয়েছে, দেশের জিডিপির ২৫ শতাংশ আসে পোলট্রির মতো মাঝারি ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের কাছ থেকে। এই খাত পুঁজির সংকটে পড়লে দেশের ডিম ও মুরগির মতো নিত্যপণ্যের সরবরাহ ব্যবস্থা ভেঙে পড়বে। এতে মানুষের পুষ্টি ও খাদ্যনিরাপত্তায় নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। আর সরকার যে কৃষি খাতের জন্য প্রণোদনা সহায়তা ঘোষণা করা করেছে তা যদি এই খাতের উদ্যোক্তাদের না দেওয়া হয়, তাহলে এই ডিম ও মুরগির উৎপাদন আগের অবস্থায় ফিরে আসবে না।

মনজুর হোসেনের মতে, পোলট্রি খাতের ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের ৭০ শতাংশ ব্যাংকঋণসহ অন্যান্য সহায়তা ছাড়াই খামার গড়ে তুলেছেন। তাঁদের সঙ্গে ব্যাংকের লেনদেনের অভ্যাসও নেই। ফলে সরকার ব্যাংকের মাধ্যমে এসব খামারিকে সহায়তা দেওয়ার যে উদ্যোগ নিয়েছে, তাতে এসব ছোট ও মাঝারি খামারিদের ৭০ থেকে ৮০ শতাংশই ঋণ পাবে না। ফলে পুঁজি হারানো এসব উদ্যোক্তা আবার উৎপাদনে যেতে পারেবেন না। ফলে ডিম ও মুরগির মতো অত্যাবশ্যকীয় খাদ্যপণ্যের উৎপাদন বাড়িয়ে দাম স্বাভাবিক করা যাবে না।

মনজুর হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, এসব খামারিকে উৎপাদনে ফিরিয়ে আনতে হলে ক্ষুদ্র ঋণদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে কম সুদে ঋণের ব্যবস্থা করতে হবে। এসএমই খাতে অর্থায়নকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকেও এ কাজে যুক্ত করা যেতে পারে। তবে ব্যাংকের মাধ্যমে সহায়তা দিলে এদের বেশির ভাগই সহায়তা না পেয়ে এই খাত থেকে চলে যাবেন।

এ ব্যাপারে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম প্রথম আলোকে বলেন, ‘সারা দেশের ক্ষতিগ্রস্ত খামারিদের একটি তালিকা আমরা করছি। সরকার কৃষি খাতের জন্য যে প্রণোদনা দিয়েছে, তার বাইরে আরও পোলট্রি, প্রাণিসম্পদ ও মৎস্য খাতের জন্য আমরা সহযোগিতা চাইছি। সরকার থেকে তহবিল পেলে আমরা এসব উদ্যোক্তাকে সহযোগিতা দিতে পারব।’

বিপিআইসিসি সূত্রে জানা গেছে, গত ফেব্রুয়ারিতে একেকটা ডিম ৮ টাকা করে বিক্রি হয়েছে। মুরগির কেজি ১৪০ আর মুরগির বাচ্চা ৪৫ টাকায় বিক্রি করেছিলেন ব্যবসায়ীরা। মার্চে তা কমে অর্ধেকে নেমে আসে। একেকটা ডিম ৪ থেকে ৫ টাকায়, ব্রয়লার মুরগির কেজি ৪৪ থেকে ৫৫ টাকায় করে বিক্রি হয়।

মার্চ থেকে মে পর্যন্ত পোলট্রি শিল্পের উদ্যোক্তারা পানির দরে ডিম, মুরগি ও বাচ্চা বিক্রির ফলে পুঁজি হারিয়ে ফেলেন। দেশে এমনিতেই নানা অর্থনৈতিক সংকটের কারণে মুরগির খামারের সংখ্যা কমছে। গত পাঁচ বছরে খামারের সংখ্যা ৮৫ হাজার থেকে কমে গত মার্চে ৬৫ হাজারে নেমে আসে। গত দুই মাসে আরও ৩০ হাজার খামারি তাঁদের পুঁজি হারিয়ে বন্ধ হয়ে গেছে।

এ ব্যাপারে বাংলাদেশ পোলট্রি প্রফেশনালস বাংলাদেশের সমন্বয়ক অঞ্জন মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, ‘ক্ষুদ্র ও মাঝারি খামারিদের বেশির ভাগই পারিবারিক সঞ্চয় ও প্রবাসী আয় দিয়ে এসব খামার গড়ে তুলেছে। করোনার কারণে আমাদের বেশির ভাগ খামারির পথে বসার মতো অবস্থা হয়েছে। পুঁজি হারানোর কারণে আমাদের বেশির ভাগ খামারের উৎপাদন অর্ধেকে নেমে এসেছে। সরকার যদি খামারিদের বাঁচাতে ও বাজারে সরবরাহ ব্যবস্থা ঠিক রাখতে চায়, তাহলে খামারিদের সহায়তা দিতে হবে।’