কাঁচা চামড়া রপ্তানির সুপারিশ

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি
>দেশে ১৯৯০ সাল থেকে কাঁচা চামড়া রপ্তানি বন্ধ। পচে যাওয়া ঠেকাতে রপ্তানি খুলে দেওয়ার সুপারিশ ট্যারিফ কমিশনের।

তিন দশক ধরে দেশে যে সুযোগ বন্ধ রয়েছে, তা এবার খুলে দেওয়ার সুপারিশ করল বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন। সংস্থাটি বলছে, এবার ঈদুল আজহায় পশুর কাঁচা চামড়া নষ্ট হয়ে যাওয়ার হাত থেকে রক্ষা করতে ন্যূনতম দাম নির্ধারণ করে রপ্তানির সুযোগ দেওয়া যেতে পারে।

কমিশনের এই সুপারিশ এল গত বছরের অভিজ্ঞতায়। গত বছর পবিত্র ঈদুল আজহায় দেশের চামড়ার একটি অংশ পচে যায়। এর বড় কারণ ছিল চামড়া কিনতে অনীহা। দেশের চামড়া প্রক্রিয়াকারী ট্যানারি মালিকেরা গত বছর চামড়া কেনার জন্য বাজারে পর্যাপ্ত টাকা ছাড়েননি। এ জন্য তাঁরা ব্যাংকঋণ না পাওয়াকে দায়ী করেছিলেন। চাহিদা কম থাকায় দামও তলানিতে নেমে যায়। অনেকে চামড়া মাটিতে পুঁতে ফেলেন। অনেক জায়গায় বাড়তি দামে লবণ কিনে সংরক্ষণ না করায় পচে যায়। এবারও পরিস্থিতির উন্নতির তেমন কোনো আশা নেই।

এমন পরিস্থিতিতে ট্যারিফ কমিশন তাদের সুপারিশে বলেছে, চামড়ার দাম কমিয়ে নির্ধারণ করা হোক। গত বছর প্রতি বর্গফুট গরুর চামড়ার নির্ধারিত দর ছিল ৪৫ থেকে ৫০ টাকা। এবার কমিশন তা ৩০ থেকে ৪০ টাকা নির্ধারণের প্রস্তাব দিয়েছে। এ ছাড়া ছাগলের চামড়ার দর প্রতি বর্গফুট ১৮ থেকে ২০ টাকার জায়গায় ১৫ থেকে ২৫ টাকা নির্ধারণের কথা বলা হয়েছে কমিশনের প্রস্তাবে।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে ট্যারিফ কমিশনের প্রতিবেদনটি পাঠিয়েছেন কমিশনের সদস্য (বাণিজ্য নীতি) আবু রায়হান আলবেরুনী। জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ন্যূনতম দাম ঠিক করে রপ্তানির সুযোগ দেওয়া যেতে পারে। এতে দেশের মানুষ ও খামারিরা উপকৃত হবে। চামড়ার চাহিদা তৈরি হবে।’

কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়, চামড়া দিয়ে যেসব পণ্য তৈরি হতো, সেখানে এখন সিনথেটিক বস্ত্র ও কৃত্রিম চামড়ার ব্যবহার বেড়েছে। এতে বিশ্বব্যাপী চামড়ার দাম কমেছে। আন্তর্জাতিক বাজারে এখন প্রতি বর্গফুট লবণযুক্ত কাঁচা চামড়ার দাম ৫০ সেন্ট থেকে দেড় মার্কিন ডলার। প্রতি ডলার ৮৬ টাকা ধরে প্রতি বর্গফুট লবণযুক্ত কাঁচা চামড়ার দাম দাঁড়ায় ৪৩ থেকে ১২৯ টাকা।

প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের হিসাবে, দেশে ঈদুল আজহায় ১ কোটি ১০ লাখের মতো পশু জবাই হয়। এগুলোর মধ্যে ৪০ থেকে ৪৫ লাখ গরু-মহিষ। ঈদুল আজহায় জবাই হওয়া গরুর স্বাস্থ্য ভালো থাকে। চামড়ার মান খুব ভালো হয়। তাই ট্যানারিগুলো মোট চামড়ার ৫০ শতাংশই সংগ্রহ করে ঈদুল আজহায়। প্রতিবছরই ঈদুল আজহার আগে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও ব্যবসায়ীরা বৈঠক করে চামড়ার একটি দাম ঘোষণা করেন। এ বছর চামড়ার দাম নির্ধারণে গত সপ্তাহে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে একটি বৈঠক হয়েছিল। কিন্তু তাতে দাম ঘোষণা করা হয়নি।

বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএ) সাধারণ সম্পাদক মো. সাখাওয়াত উল্লাহ প্রথম আলোকে জানান, ১৯৯০ সালে বাংলাদেশ থেকে প্রাথমিকভাবে প্রক্রিয়া করা পশম ছাড়ানো (ওয়েট ব্লু) চামড়া রপ্তানি বন্ধ রয়েছে। ওই সময় দেশে মূল্য সংযোজনের লক্ষ্যে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এরপরই ব্যবসায়ীরা আধুনিক যন্ত্রপাতি এনে চামড়া প্রক্রিয়াকরণের দ্বিতীয় ধাপ ‘ক্রাস্ট’ ও তৃতীয় ধাপ ‘ফিনিশড লেদার’ উৎপাদন শুরু করেন।

কাঁচা চামড়া রপ্তানির সুপারিশের বিষয়ে সাখাওয়াত বলেন, এ বিষয়ে তাঁরা আনুষ্ঠানিকভাবে কিছুই জানেন না।

১৯৯০ সালে কাঁচা চামড়া রপ্তানি বন্ধের সিদ্ধান্তের সুফল বাংলাদেশ পেয়েছিল। ধীরে ধীরে প্রক্রিয়া করা চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের রপ্তানি বাড়তে থাকে। এ খাতে প্রচুর বিনিয়োগও আসে। দেশে গত এক দশকে অনেকগুলো রপ্তানিমুখী ও অভ্যন্তরীণ বাজারমুখী চামড়াজাত পণ্যের কারখানা হয়েছে।

সাভারের হেমায়েতপুরে চামড়াশিল্প নগরে জমি পাওয়া ১৫৫টি ট্যানারির ১২৫টির মতো উৎপাদনেও গেছে। সমস্যা হলো, চামড়াশিল্প নগরে কেন্দ্রীয় বর্জ্য পরিশোধনাগার (সিইটিপি) এখনো কার্যকর নয়। চামড়াশিল্পের পরিবেশদূষণের কারণে বৈশ্বিকভাবে স্বনামধন্য ব্র্যান্ডগুলো বাংলাদেশি চামড়ার তৈরি পণ্য কেনে না। দেশীয় সুপরিচিত রপ্তানিকারকেরা চামড়া আমদানি করে সেটা দিয়ে পণ্য তৈরি করে রপ্তানি করেন।

বাংলাদেশ থেকে চীন, হংকং, দক্ষিণ কোরিয়া, ইতালি, জাপান ও স্পেনের মতো দেশে ‘ক্রাস্ট’ ও ‘ফিনিশড লেদার’ রপ্তানি হতো। সেখানেও ধস নেমেছে। শুরুটা হয়েছিল চীনকে দিয়ে। যুক্তরাষ্ট্র চীনের ওপর শুল্ক বাড়ানোয় তারা বাংলাদেশি চামড়া নেওয়া কমিয়েছে। দামও কমিয়ে দিয়েছে।

চামড়া খাত নিয়ে কাজ করা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের শিক্ষক এম আবু ইউসুফ প্রথম আলোকে বলেন, ‘গত বছর আমাদের যে অভিজ্ঞতা, তাতে মান রক্ষাকরে রপ্তানি করতে পারলে খারাপ হবে না। এখানে যেহেতু চাহিদা কম, সেহেতু আমাদের অসুবিধাও হবে না।’ তিনি বলেন, ভারতে ও চীনে বাংলাদেশের কাঁচা চামড়ার কিছু চাহিদা থাকতে পারে।

বাংলাদেশ রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ৪০ কোটি ডলারের চামড়া রপ্তানি হয়েছিল। সেটা চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরের ১১ মাসে নেমেছে ৯ কোটি ডলারে। আগ্রহোদ্দীপক বিষয় হলো, ভারতে চামড়া রপ্তানি বাড়ছে।

অবশ্য এ সুপারিশের তীব্র বিরোধিতা করেন বাংলাদেশ ফিনিশড লেদার, লেদারগুডস অ্যান্ড ফুটওয়্যার এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএফএলএলএফইএ) চেয়ারম্যান মহিউদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, ‘চামড়া রপ্তানির জন্য ফাইটোস্যানিটারি সার্টিফিকেটসহ যেসব মান অনুসরণ করতে হয়, সেটা সম্ভব নয়। কারণ, দেশে গরু আধুনিক জবাইখানায় জবাই হয় না। আর যদি চামড়া ভারতে পাঠাতে চান, সেটা ভিন্ন কথা। তাহলে চামড়াশিল্প নগর কেন করলেন? এ খাতকে না বাঁচিয়ে রপ্তানির চিন্তা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।’