সরকার বিদেশি ঋণ বেশি নিতে পারছে না

ঋণ করা নিয়ে একটি সংস্কৃত প্রবাদ বেশির ভাগ শিক্ষিত বাঙালিরই জানা। সেটি হচ্ছে, ‘ঋণং কৃত্বা ঘৃতং পিবেৎ, যাবৎ জীবেৎ সুখং জীবেৎ’ । যার অর্থ ঋণ করে হলেও ঘি খাও, যত দিন বাঁচো সুখে বাঁচো। কিন্তু ঋণ করে ঘি কেনা গেলেও ঋণের বোঝার ভার একেবারে কম নয়।

 ব্যক্তিজীবনে ঋণের দায়ে জর্জরিত মানুষ যেমন শেষ পর্যন্ত সুখে থাকতে পারেন না। তেমনি রাষ্ট্রীয় জীবনেও ঋণের অনেক খারাপ উদাহরণ আছে। এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার কিছু দেশকে চরম রাজনৈতিক অস্থিরতা মোকাবিলা করতে হয়েছে এই ঋণফাঁদে পড়ে। বড় ধরনের মূল্য দিতে হয়েছে শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান, মিয়ানমার, অ্যাঙ্গোলা, ঘানা—এসব দেশকে।

 কিন্তু ঋণ তো লাগবেই। সংসার চালাতে গেলে ঘরের কর্তার যেমন কম–বেশি ঋণ মাঝেমধ্যে হলেও করতে হয়। তেমনি রাষ্ট্রেরও। ঋণ ছাড়া একটি বছরও সরকারের পক্ষে চলা কঠিন। সরকার দুইভাবে ঋণ নেয়, দেশের ভেতর থেকে ও বিদেশ থেকে। বিদেশ মানে কোনো দেশ হতে পারে, আবার আন্তর্জাতিক সংস্থাও হতে পারে।

 দেশের ভেতর থেকে বেশি ঋণ নিলে সরকারকে সুদ গুনতে হয় বেশি। তবে বিদেশি ঋণ নিলে সুদ কম পড়ে, তা পরিশোধ করার সুযোগও পাওয়া যায় দীর্ঘ সময় ধরে। বিশেষজ্ঞরা তাই সস্তায় বিদেশি ঋণ নেওয়ার পরামর্শ দেন সব সময়।

মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) তুলনায় ঋণের পরিমাণের দিক থেকে বাংলাদেশ এখনো ভালো অবস্থানে রয়েছে। ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রেও বাংলাদেশের সুনাম রয়েছে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরের হিসাবে ঋণ-জিডিপি অনুপাত ৩৩ দশমিক ২ শতাংশ।

 কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে ধারাবাহিকভাবেই বাংলাদেশ খুব বেশি বিদেশি ঋণ নিতে পারছে না। চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটের ঘাটতি ধরা হয়েছে জিডিপির ৬ শতাংশ বা ১ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে বিদেশ ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রাই ৮৮ হাজার ৮২৪ কোটি টাকা। যার মধ্যে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) প্রকল্প সাহায্য ৬৭ হাজার ১০২ কোটি টাকা, এডিপিবহির্ভূত প্রকল্প ঋণ ৪ হাজার ৭২২ কোটি টাকা এবং বিশেষ উন্নয়ন সহায়তা বা ঋণ ১৭ হাজার কোটি টাকা। সরকার ধরে নিচ্ছে, এসব ঋণ নিয়ে আগের ঋণের সুদ পরিশোধ করা হবে ১২ হাজার ৮২০ কোটি টাকা। সে হিসাবে নিট ঋণ মিলবে ৭৬ হাজার ৪ কোটি টাকা।

>

বিদেশি ঋণকে সস্তা ঋণ বলা হয়
এ ঋণের সুদের হার যেমন কম, পরিশোধও করা যায় দীর্ঘ বছর ধরে

 বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর প্রথম আলোকে বলেন, কোভিডের কারণে বিদায়ী অর্থবছরে বিদেশি ঋণপ্রাপ্তিতে কিছুটা অগ্রগতি দেখা গেছে। বাজেট সহায়তা হিসেবে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ও বিশ্বব্যাংকসহ আরও কয়েকটি সংস্থা ভালোই অর্থ দিয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, ২০২০-২১ অর্থবছরে কী হবে? বেশির ভাগ অর্থই যেহেতু প্রকল্পের সঙ্গে সম্পর্কিত, ফলে প্রকল্প বাস্তবায়নে সমস্যা হলে বিদেশি ঋণ পেতেও সমস্যা হবে।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) সূত্রে জানা গেছে, বিদেশি ঋণ ২০০৯-১০ অর্থবছরে ছিল জিডিপির ১৮ দশমিক ৬ শতাংশ। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে তা ১১ দশমিক ৩ শতাংশে নেমে এলেও ২০১৮-১৯ অর্থবছরে একটু বেড়ে ১২ দশমিক ১ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। ইআরডির ১০ বছরের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০১১-১২ থেকে ২০১৪-১৫ অর্থবছর পর্যন্ত প্রতিবারই নিট বিদেশি ঋণের পরিমাণ ওই বছরের সুদের চেয়েও কম।

জানতে চাইলে ইআরডি সচিব ফাতিমা ইয়াসমিন গতকাল শনিবার প্রথম আলোকে বলেন, বিদায়ী ২০১৯-২০ অর্থবছরের হিসাবটি এখনো তৈরি হয়নি। তাই বিদায়ী অর্থবছরের বাজেটে সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রার হিসাব থেকে বিদেশি ঋণ কতটুকু শেষ পর্যন্ত পাওয়া গেল, তা এখনো বলা যাচ্ছে না।

স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে বের হয়ে বাংলাদেশ এখন নিম্ন–মধ্যম আয়ের দেশ। এ কারণে বিদেশি ঋণের সুদহার কিছুটা বেড়েছে। কোভিড-১৯–এর ধাক্কা ঠিকভাবে সামলানো গেলে ২০২৪ সালে বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশ হবে। তখন বাংলাদেশের জন্য বিদেশি ঋণ আর সস্তা থাকবে না। এই কয়েকটি বছর তাই দীর্ঘমেয়াদি সস্তা ঋণের সুযোগটি নিয়ে রাখা উচিত বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

সাবেক ইআরডি সচিব মোহাম্মদ মেজবাহউদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, সক্ষমতার অভাবের কারণেই বিদেশি ঋণ নেওয়া যায় না। যে প্রকল্প সরকারি ও বিদেশি অর্থায়নে বাস্তবায়িত হওয়ার কথা, দেখা গেছে সরকারি অর্থ ঠিকই ব্যয় হয়ে গেছে কিন্তু বিদেশি অর্থায়নের প্রক্রিয়াই শুরু করা যায়নি।