নারী নির্বাহীদের চোখে আগামী

>করপোরেটের নারী নির্বাহীরা করোনাকালে কাজ সামলাচ্ছেন ভালোভাবেই। কেউ অফিস করছেন বাসা থেকে, কেউ কেউ বাসা-অফিস মিলিয়ে। চাপ বেড়েছে। এরই মধ্যে আগামী দিনের পরিকল্পনাও সাজাতে হচ্ছে।

রূপালী চৌধুরী
ব্যবস্থাপনা পরিচালক, বার্জার পেইন্টস
কর্মীদের উৎপাদনশীলতা খারাপ হচ্ছে না। তবে মাঠপর্যায়ে বিপণন আর উৎপাদনকাজ বাসা থেকে সম্ভব নয়।

 উজমা চৌধুরী
পরিচালক, প্রাণ-আরএফএল
আগে বৈঠকের জন্য বিভিন্ন জায়গায় যেতে হতো, এখন হয় না। সময় অফিসের অন্য কাজে ব্যয় করা যাচ্ছে।

জেসমিন জামান
বিপণনপ্রধান, স্কয়ার টয়লেট্রিজ
চাপ আসলে বেশি। সেটা পুরোটা কাজের নয়, অনিশ্চয়তায় মানসিক চাপ। আমরা আসলে জানি না কী পরিস্থিতি দাঁড়াবে।

রেজওয়ানা খান
সিইও, স্টার কম্পিউটার
আমার মনে হয়, ভবিষ্যতে অনেক অফিস বাসায় থেকে কাজ করার সুযোগ দেবে। সেটা নারীদের জন্য ভালো হবে।

 শামীমা আক্তার
হেড অব করপোরেট অ্যাফেয়ার্স,ইউনিলিভার
বাসা থেকে কাজ করা ও ঘরের সহযোগীদের অনুপস্থিতির কারণে অবশ্যই বাসায় থেকে কাজ কয়েক গুণ বেশি।

মাহরুখ মহিউদ্দিন
ব্যবস্থাপনা পরিচালক, ইউপিএল
করোনা আসার আগে অনেক কিছুই অপরিহার্য মনে হতো। এখন মনে হচ্ছে, না হলেও চলে।

মাহিয়া জুনেদ
ডিএমডি, সিটি ব্যাংক
কলসেন্টারের জন্য ছয় হাজার বর্গফুট জায়গা ভাড়া নিয়ে সাজসজ্জায় বাড়তি ব্যয়ের দরকার কী, যদি বাসায় ভালো ব্যবস্থা থাকে?

করোনাকাল দেশের ব্যবসা ও করপোরেট জগতে যেসব পরিবর্তন নিয়ে আসবে, তার একটির কথা বললেন মাহরুখ মহিউদ্দিন। করপোরেটের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) বা বিভাগীয় প্রধান পদে কাজ করা আরও কয়েকজন নারী কর্মকর্তা জানাচ্ছেন আগামী দিন নিয়ে তাঁদের ভাবনা।

অবশ্য ভবিষ্যতের ভাবনা পরের কথা। আগে জানা দরকার নারী নির্বাহীরা করোনাকাল কীভাবে সামলাচ্ছেন, তাঁদের অভিজ্ঞতা কী?

মাহরুখ মহিউদ্দিন ছাড়াও প্র বাণিজ্যের সঙ্গে কথা বলেছেন বার্জার পেইন্টস বাংলাদেশের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রূপালী চৌধুরী, প্রাণ-আরএফএলের পরিচালক (করপোরেট ফাইন্যান্স) উজমা চৌধুরী, স্টার কম্পিউটার সিস্টেমের সিইও রেজওয়ানা খান, সিটি ব্যাংকের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক মাহিয়া জুনেদ, স্কয়ার টয়লেট্রিজের বিপণনপ্রধান জেসমিন জামান ও ইউনিলিভার বাংলাদেশ লিমিটেডের হেড অব করপোরেট অ্যাফেয়ার্স, পার্টনারশিপ অ্যান্ড কমিউনিকেশন শামীমা আক্তার।

রূপালী চৌধুরীর পরিবারে সিইও দুজন। তিনি নিজে। আর তাঁর স্বামী আবদুল হক, যিনি এসএমসি এন্টারপ্রাইজ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক। বার্জার আর এসএমসি এন্টারপ্রাইজ এখন পরিচালিত হচ্ছে গুলশানের একটি বাড়ির দুই কক্ষ থেকে। সকালে ঘুম থেকে উঠে নাশতা সেরে এক কক্ষে বসেন রূপালী চৌধুরী, আরেক কক্ষে আবদুল হক।

রূপালী চৌধুরী মনে করেন, এখন কর্মীদের উৎপাদনশীলতা খারাপ হচ্ছে না। তবে মাঠপর্যায়ে বিপণন আর উৎপাদনকাজ বাসা থেকে সম্ভব নয়। অনলাইন সভায় কর্মীদের শারীরিক ভাষাও বোঝা যায় না। বাসায় থাকলেও অনেক বেশি কাজ করতে হচ্ছে—উল্লেখ করেন তিনি।

নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ জোসেফ স্টিগলিজ ‘বদলে যাচ্ছে অর্থনীতি, বদলাতে হবে আমাদেরও’ শীর্ষক প্রজেক্ট সিন্ডিকেটের এক লেখায় বলেছেন, ‘একজন বিমানকর্মীকে রাতারাতি একজন জুম টেকনিশিয়ান হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব নয়। কিন্তু সেটিই এখন করতে হচ্ছে।’

জুমে কীভাবে বৈঠক করতে হয়, তা রূপালী চৌধুরীকে শিখতে হয়েছে। তিনি বলেন, ‘বাসাকেই অফিস বানিয়ে ফেলেছি। আগে অনেক কিছুই সহকারীর ওপর নির্ভর করতাম। এখন নিজেই শিখছি।’

প্রাণ-আরএফএলের উজমা চৌধুরী সরকার ঘোষিত সাধারণ ছুটির প্রথম দিকে কিছুদিন বাসা থেকে কাজ করেছেন। এখন নিয়মিত অফিসে যাচ্ছেন। তিনি দিনের কার্যক্রমে কয়েকটি পরিবর্তনের কথা জানালেন। বললেন, আগে প্রতিদিনই অংশীজনের সঙ্গে অফিসে গিয়ে বৈঠক করতে হতো। এখন সেখানে এসেছে প্রযুক্তি। সহকর্মীদের সঙ্গে বৈঠক করা ও নথিপত্র দেখার মাধ্যমে তাঁর সময়ের বড় অংশ কাটে। সেটা এখনো চলছে। তবে বৈঠকটি হয় সাধারণত ভার্চ্যুয়ালি।

উজমা চৌধুরী বলেন, ‘ব্যক্তিগত ক্ষেত্রে কাজের গতি বেড়েছে। আগে বৈঠকের জন্য বিভিন্ন জায়গায় যেতে হতো, এখন হয় না। সময় অফিসের অন্য কাজে ব্যয় করা যাচ্ছে।’

স্টার কম্পিউটার সিস্টেমের সিইও রেজওয়ানা খান বাসায় থেকেই অফিস করছেন। তাঁর মতে, কাজের চাপ একটু কম। কারণ, করোনাকাল তাঁদের কিছু কাজ আটকে দিয়েছে। তবে তাঁর জন্য অফিসের কোনো নির্দিষ্ট সময় নেই। বললেন, ‘অনেক সময় দেখা যায়, রাত তিনটায়ও বিদেশে থাকা কারও সঙ্গে অনলাইনে বৈঠকে বসতে হচ্ছে।’

মাহিয়া জুনেদও সাধারণ ছুটির শুরুর দিকে বাসা থেকে অফিস করেছেন। এখন তিনি নিজেসহ সিটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনার উচ্চপর্যায়ে যাঁরা রয়েছেন, তাঁরা মোটামুটি সবাই অফিস করেন। জুনেদ বললেন, ‘আমি মোটামুটি সপ্তাহে চার দিন অফিসে যাই। এক দিন বাসায় থাকলে অনলাইনে কাজ করি।’

অফিসেও কাজের ধরন ও আচরণে অনেক পরিবর্তন এসেছে। মাহিয়া জুনেদ বলেন, ‘ধরুন, একটি বৈঠক করব। সেখানে চার-পাঁচজন থাকা জরুরি। স্বাভাবিক সময়ে সহায়তাকারী হিসেবে আরও তিন-চারজন যোগ দিতেন। এখন সেটা বাদ।’ তিনি বলেন, ‘অফিসে চা-কফি, পানি; বাইরে থেকে এনে খাবার খাওয়া বন্ধ। পারতপক্ষে কেউ কারও কক্ষে যায় না। দরজায় উঁকি মেরে কথা বলে চলে যান।’

স্কয়ারের জেসমিন জামান অবশ্য বেশি চাপ নিতে নারাজ। তিনি বলেন, ‘আমি সতর্ক থাকি, তবে সবকিছু বন্ধ করে দিয়ে নয়। অফিসের খাবারই খাই।’ তিনি আরও বললেন, ‘এখন চাপ আসলে বেশি। সেটা পুরোটা কাজের নয়। অনিশ্চয়তায় মানসিক চাপ। আমরা আসলে জানি না কী পরিস্থিতি দাঁড়াবে।’

মাহরুখ মহিউদ্দিন পুরোটা সময় বাসা থেকে কাজ করেন। তাঁর মতে, ‘ওয়ার্ক ফ্রম হোম’ ব্যবস্থায় কিছু সুবিধা আছে, কিছু অসুবিধা আছে। অফিসে থাকলে ঝটপট বৈঠক করে ফেলা যায়, সেটা এখন সম্ভব নয়। অফিসে একটা কাজে বাকিদের সহায়তা পাওয়া যেত, এখন নিজেকেই করতে হয়। চাপ কতটুকু বেড়েছে, জানতে চাইলে মাহরুখ বলেন, কিছু ক্ষেত্রে কমেছে, কিছু ক্ষেত্রে বেড়েছে। যেমন যন্ত্রনির্ভর যোগাযোগ চাপ তৈরি করছে বলে মনে হয়।

নারীদের শুধু অফিস নয়, ঘর সামলানোর কাজটিও করতে হয় সমানতালে। যেমন ইউনিলিভার বাংলাদেশ লিমিটেডের হেড অব করপোরেট অ্যাফেয়ার্স, পার্টনারশিপ অ্যান্ড কমিউনিকেশন শামীমা আক্তার বলেন, ‘বাসা থেকে কাজ করা এবং ঘরের সহযোগীদের অনুপস্থিতির কারণে অবশ্যই কাজ কয়েক গুণ বেশি। নারী হিসেবে পারিবারিক ও অফিসের কাজ—দুটো ক্ষেত্রে সমানভাবে চালিয়ে যেতে কিছুটা বেগ পেতে হচ্ছে।’ অবশ্য অনেক বছর পর বিকেলে পরিবারের সঙ্গে কাটাতে পারছেন তিনি।

প্রত্যেকের কাছে একটা সাধারণ প্রশ্ন ছিল, সেটা হলো, করোনাকাল কী কী পরিবর্তন নিয়ে আসবে?

সাধারণ উত্তরগুলো মোটামুটি এ রকম: ১. করপোরেট অপ্রয়োজনীয় খাতে ব্যয় কমাবে। ২. অফিসের জায়গা বা স্পেস নিয়ে নতুন করে ভাববে ব্যবস্থাপনা; কারণ, জায়গার প্রয়োজন ততটা থাকবে না। ৩. করোনাকাল কেটে গেলেও কর্মীদের বাসা থেকে কাজ করার সুযোগ দেবে করপোরেটরা। ৪. ডিজিটাল ব্যবস্থা ও অনলাইন–নির্ভরতা বাড়বে। ৫. বিপণন কৌশলে কিছু পরিবর্তন আসবে। ৬. নতুন নতুন ব্যবসার দুয়ার খুলতে পারে। ৭. কোম্পানি করোনার মতো পরিস্থিতি সামাল দিতে ভবিষ্যতে প্রস্তুতি রাখবে।

এসব গেল সাধারণ মূল্যায়ন ও পূর্বাভাস। দেখা যাক সুনির্দিষ্টভাবে কে কী বলেছেন। অবশ্য মনে রাখতে হবে, নিজেদের সব কৌশল সবাই খোলাসা করে বলবেন না; বিশেষ করে বিপণন কৌশল তো নয়ই।

সিটি ব্যাংকের মাহিয়া জুনেদ বলেন, ‘ব্যাংকের কলসেন্টারের জন্য ছয় হাজার বর্গফুট জায়গা ভাড়া নিয়ে সাজসজ্জায় বাড়তি ব্যয়ের দরকার কী, যদি বাসায় ভালো ব্যবস্থা থাকে?’

এ জায়গায় বৈশ্বিক চিত্রটা একটু দেখে আসি। সংবাদ সংস্থা সিএনএন গত ২৫ জুন এক প্রতিবেদনে জানায়, বেশ কিছু বড় কোম্পানি করোনাকাল কেটে গেলেও কর্মীদের বাসা থেকে কাজের সুযোগ দেবে। এর মধ্যে রয়েছে ফেসবুক, টুইটার, শপিফাই (কানাডার ই-কমার্স কোম্পানি)সহ আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠান। ফেসবুক-টুইটার তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবসায় নিয়োজিত। তাদের পক্ষে কর্মীদের ‘ওয়ার্ক ফ্রম হোমের’ সুযোগ দেওয়া সহজ। তবে তার বাইরেও আছে। ফরাসি গাড়ি উৎপাদক পিএসএ বলছে, তারা উৎপাদনে যুক্ত কর্মী ছাড়া অন্যদের ‘ওয়ার্ক ফ্রম হোমের’ সুযোগ চালু করেছে। শুধু করোনাকাল নয়, পরবর্তী সময়ের জন্যও। এ জন্য অফিসের কর্মপদ্ধতি ‘রি-ডিজাইন’ করছে।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট ভিন্ন হতে পারে। কোম্পানি, ব্যবসার ধরনভেদে অভিজ্ঞতাও ভিন্ন হতে পারে। যেমন স্কয়ারের জেসমিন জামান মনে করেন, ‘অফিস পেশাদারি কাজের পরিবেশ দেয়, যা বাসায় পাওয়া যায় না। উৎপাদনশীলতা, নিপুণতা অফিসেই ভালো হয়।’

স্টার কম্পিউটারের রেজওয়ানা খান অবশ্য নারীদের ক্ষেত্রে ভালো একটি সুযোগ দেখছেন। তিনি বলেন, ‘এত দিন আমরা বাসায় থেকে কাজ করার বিষয়টি মানতে পারতাম না। আমার মনে হয়, ভবিষ্যতে অনেক অফিস বাসায় থেকে কাজ করার সুযোগ দেবে। সেটা নারীদের জন্য ভালো হবে।’

খুচরা পর্যায়ে পরিবর্তন কিন্তু এসে গেছে। ইউনিলিভারের শামীমা আক্তার জানান, খুচরা বিক্রেতারা এখন অ্যাপ ব্যবহার করে সরবরাহ আদেশ অনেক বেশি দিচ্ছেন। বিল প্রদান থেকে শুরু করে নথি এখন অনলাইনেই আদান-প্রদান হচ্ছে।

করোনা আঘাত করেছে সারা বিশ্বে। পরিবর্তনের ধারাও বিশ্বজুড়ে। বাংলাদেশে কি পরিবর্তন আসবে, তা সামনের দিনগুলোতেই জানা যাবে।