প্রণোদনার টাকায় বেতন-ভাতা

টাকা। প্রতীকী ছবি
টাকা। প্রতীকী ছবি

করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত শিল্প ও সেবা খাত চালু রাখতে মূলধন দেওয়ার জন্য ৩০ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা তহবিল গঠন করেছিল সরকার। এখন সেই তহবিল থেকে রপ্তানিমুখী শিল্পকে দিতে হবে বেতন-ভাতা। এর মেধ্য বড় অংশই পোশাকশিল্প। আর এতে মূলধন হিসেবে কম অর্থ পাবে অন্য শিল্প ও সেবা খাত।

এর আগে সরকার রপ্তানিমুখী শিল্পের শ্রমিকদের বেতন-ভাতা দিতে পাঁচ হাজার কোটি টাকার তহবিল দিয়েছিল। দুই মাসের বেতন দিতেই সে তহবিলের প্রায় সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা খরচ হয়ে গেছে। জুনের বেতন দিতে প্রয়োজন ২ হাজার ৯০৩ কোটি টাকা। কিন্তু আর্থিক সংকটে সরকার নতুন করে আর টাকা দিতে পারছে না। এ জন্য ক্ষতিগ্রস্ত বড় শিল্প ও সেবা খাতের ৩০ হাজার কোটি টাকার তহবিল থেকেই জুনের বেতন দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।

দেশের ৩২ ব্যাংককে বাংলাদেশ ব্যাংক বেতন-ভাতা দেওয়ার নির্দেশনাও দিয়েছে। এতে ব্যাংকগুলো বড় শিল্প ও সেবা খাতে ঋণ দিতে যে সীমা অনুমোদন পেয়েছিল, তা হঠাৎ কমে যাচ্ছে। নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী রপ্তানিমুখী প্রতিষ্ঠান বেতন-ভাতা দিতে ৯ শতাংশ সুদে ঋণ নিতে পারবে। তার মধ্যে সরকার ৭ শতাংশ ভর্তুকি হিসেবে দেবে। শিল্পের মালিকদের আগের মতোই ২ শতাংশ সুদ দিতে হবে।

আগের পাঁচ হাজার কোটি টাকা প্রণোদনা তহবিল ছিল পুরোপুরি সরকারের টাকা। সেই তহবিল থেকে ব্যাংকগুলো বিনা সুদে টাকা নিতে পারত। আর শিল্পমালিকদের থেকে ২ শতাংশ পর্যন্ত মাশুল আদায়ের সুযোগ ছিল। আর এখন জুনের বেতন ব্যাংকের আমানত থেকে যাবে, যা কিনা ঋণ হিসেবে অন্য ব্যবসায়ীদের কাছে যেত। রাজস্ব আদায়ে বড় ঘাটতির কারণেই সরকারের তহবিলে টান পড়েছে। তাতে সরকারকেও এখন বেশি সুদ ভর্তুকি দিতে হবে।

তহবিলে টান ও নতুন সিদ্ধান্তের কারণে প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়নের মাঝপথে এসে সমস্যায় পড়েছে ব্যাংকগুলো। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের ৯০০ কোটি টাকা ঋণের সীমা দেওয়া হয়েছিল। কম সুদ হওয়ায় সব গ্রাহকই আগ্রহ দেখিয়েছিল। এখন হঠাৎ করেই এই সীমা থেকে ৯০ কোটি টাকা বেতন-ভাতায় দিতে হবে। তাতে সব গ্রাহকের ঋণের সীমা কমিয়ে আনতে হবে অথবা কাউকে কাউকে বাদ দিতে হবে।’

>সরকারের কাছে অর্থ নেই। তাই ক্ষতিগ্রস্ত শিল্পের জন্য রাখা মূলধন থেকে বেতন-ভাতা দিতে ব্যাংকগুলোকে নির্দেশনা দিয়েছে সরকার।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রপ্তানিমুখী প্রতিষ্ঠানের বেতন-ভাতা ঋণ দিতে এর আগে ৩২টি ব্যাংক সরকারের ৫ হাজার কোটি টাকার তহবিলের অর্থ নিয়েছে। যে ব্যাংক যত বেশি বেতন-ভাতার জন্য ঋণ দিয়েছে, সেই ব্যাংকের ঋণের সীমা কমছে তত বেশি। যেমন ইসলামী ব্যাংক বেতন-ভাতা প্রদানে সবচেয়ে বেশি টাকা ঋণ দিয়েছে। জুন মাসের বেতন-ভাতা ঋণের জন্য ব্যাংকটির চাহিদা ১৮১ কোটি টাকা। শিল্প ও সেবা খাতের ২ হাজার ৯৮২ কোটি টাকা ঋণ দেওয়ার সীমা পেয়েছিল ব্যাংকটি। এখন তা কমে যাবে। বাকি ব্যাংকগুলোরও তহবিলে টান পড়বে।

এদিকে এক সপ্তাহ হয়ে গেলেও পোশাকশ্রমিকেরা জুন মাসের বেতন কবে পাবেন, তা এখনো অনিশ্চিত। সময়মতো মজুরি না হওয়ার আশঙ্কাই বেশি বলে জানান নিট পোশাকশিল্পের মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর সহসভাপতি মোহাম্মদ হাতেম। আর তৈরি পোশাকশিল্পের মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সভাপতি রুবানা হক এ নিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, চলতি মূলধনের প্যাকেজ থেকে অর্থ দেওয়ার প্রক্রিয়া শেষ করতে কিছুটা সময় লাগতে পারে। তাতে পোশাকশ্রমিকেরা কত দিন পর মজুরি পাবেন, সে বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।

ব্যাংকগুলোর কাছে পাঠানো চিঠিতে বেশ কিছু শর্ত দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। যেমন ঋণের মেয়াদ হবে ২ বছর, প্রথম ৬ মাস পর ১৮টি মাসিক কিস্তিতে ঋণ আদায় করতে হবে। সব বেতন-ভাতা মুঠোফোনে আর্থিক সেবা (এমএফএস) হিসাবের মাধ্যমে যাবে।

প্রসঙ্গত, করোনার কারণে ৩১৮ কোটি ডলারের পোশাকের ক্রয়াদেশ বাতিল বা স্থগিত হলে মার্চের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে এ নিয়ে ব্যাপকভাবে উদ্বেগ প্রকাশ করতে থাকেন তৈরি পোশাক খাতের নেতারা। এরপর গত ২৫ মার্চ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রপ্তানিমুখী শিল্পের জন্য পাঁচ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা তহবিল ঘোষণা করেন। অবশ্য সহজ শর্তে ঋণ পেয়েও ক্রয়াদেশ বাতিল ও স্থগিতের অজুহাতে শ্রমিক ছাঁটাইও অব্যাহত থাকে।

এদিকে নতুন করে আবার তিন মাসের (জুলাই, আগস্ট ও সেপ্টেম্বর) মজুরি দেওয়ার জন্য অর্থ বরাদ্দ চেয়ে অর্থমন্ত্রীকে গত মাসে যৌথভাবে চিঠি দেন বিজিএমইএ ও বিকেএমইএর সভাপতি। তবে তাতে সরকারের তরফ থেকে সায় পাওয়া যায়নি বলে জানা গেছে।

সামগ্রিক বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেক) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান প্রথম আলোকে বলেন, ‘সরকারের রাজস্ব আদায় কমে গেছে। তার মধ্যে প্রণোদনা তহবিলের জন্য ভর্তুকি বাড়লে সরকারের বোঝা আরও বাড়বে। অন্যদিকে ৩০ হাজার কোটি টাকার তহবিল থেকে রপ্তানিমুখী প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া হলে দেশীয় শিল্পকারখানা বঞ্চিত হবে। মনে রাখতে হবে, শুধু গার্মেন্টস আমাদের একমাত্র শিল্প নয়।’ এ ক্ষেত্রে সরকারের অন্য বিকল্প ভাবার সুযোগ ছিল বলে মন্তব্য করেন এই অর্থনীতিবিদ।