করোনায় পদ্মা সেতুর কাজে আবার দেরি, ব্যয় বাড়বে

কাজ চলছে পদ্মা সেতুর। গত মঙ্গলবার মাওয়া ঘাট এলাকা থেকে তোলা।  ছবি: আশরাফুল আলম
কাজ চলছে পদ্মা সেতুর। গত মঙ্গলবার মাওয়া ঘাট এলাকা থেকে তোলা। ছবি: আশরাফুল আলম

আগামী বছরের জুন মাসে পদ্মা সেতুর কাজ শেষ হবে। এমনটাই ঠিক করা ছিল। আর এখন করোনার কবলে সেই পদ্মা সেতুর কাজের মেয়াদ আবার বাড়ছে। এতে প্রকল্পের ব্যয় আরও বাড়বে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এতে সেতুর অর্থনৈতিক সুবিধাও কমে যাবে।

এর আগেও দুই দফা পদ্মা সেতুর কাজ শেষ হওয়ার মেয়াদ বেড়েছে। সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ব্যয় বেড়েছে। ২০১৫ সালের ডিসেম্বর মাসে সেতুর কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল।সময় বাড়িয়ে ২০১৮ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত করা হয়। নদীশাসনসহ বিভিন্ন কার্যক্রম কাঙ্ক্ষিত হারে বাস্তবায়ন না হওয়ায় সময়সীমা আবার বাড়িয়ে করা হয় ২০২১ সালের জুন মাস। যদিও চীনের ঠিকাদারেরা আগেই বলে দিয়েছিলেন যে ২০২২ সালের আগে কাজ শেষ করা যাবে না।

সুতরাং, এখন কবে সেতু চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া যাবে এবং কত বাড়তি খরচ হবে, তা ঠিক হবে করোনা বিদায়ের পরে, পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে। বর্তমান সরকারের অন্যতম অগ্রাধিকার পাওয়া প্রকল্প পদ্মা সেতু। এ প্রকল্পে খরচ হচ্ছে ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা। গত মে মাস পর্যন্ত প্রকল্পের সাড়ে ৭৯ শতাংশ বাস্তবায়ন হয়েছে।

পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি) পদ্মা সেতুর কাজ মূল্যায়ন করে এক প্রতিবেদনে কাজের এ বিলম্বের কথা বলেছে। ২ জুলাই পদ্মা সেতু নিয়ে তৈরি করা ওই প্রতিবেদনে তিনটি দুর্বল দিক চিহ্নিত করেছে সংস্থাটি। এগুলো হলো নির্ধারিত সময়ে প্রকল্পটির কাজ শেষ হবে না, পাইলের নকশা পরিবর্তনের কারণে প্রকল্পের কাজ বাধাগ্রস্ত হওয়ায় সময় ও খরচ বেড়েছে এবং ইস্পাত বা স্টিল অবকাঠামোর কারণে রক্ষণাবেক্ষণ খরচও তুলনামূলক বেশি হবে।

প্রকল্পটির ঝুঁকি হিসেবেও তিনটি বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে আইএমইডির প্রতিবেদনে। যেমন করোনাভাইরাসের সংক্রমণের কারণে কাজের গতি কমে গেছে, নদীর পানিপ্রবাহের প্রাকৃতিক গতি নিয়ন্ত্রণের কারণে পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে এবং খরস্রোতা পদ্মার পানিপ্রবাহ প্রকল্পের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। তবে আইএমইডি পদ্মা সেতুতে আন্তর্জাতিক মানের কাজ হচ্ছে বলে প্রশংসাও করেছে।

আইএমইডি–সচিব আবুল মনসুর মো. ফয়েজউল্লাহ এ নিয়ে প্রথম আলোকে জানিয়েছেন, পদ্মা সেতু নিয়ে করা প্রতিবেদনটি সেতু বিভাগে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। এখন সেতু বিভাগ কী ধরনের পদক্ষেপ নেয়, তা নিয়মিত অনুসরণ করা হবে। মাঠপর্যায়ে যেসব তথ্য পাওয়া গেছে, তাই প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।

কাজে বিলম্ব জানুয়ারি থেকেই

সেতু বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, গত জানুয়ারি মাস থেকেই পদ্মা সেতু প্রকল্পটি ধুঁকছে। জানুয়ারি মাসের শুরুতে চীনে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। ফলে চীনা নববর্ষের ছুটিতে যাওয়া প্রায় আড়াই শ চীনা প্রকৌশলী সময়মতো পদ্মা সেতুর কাজে যোগ দিতে পারেননি। চীনে করোনার প্রকোপ কমলে ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহে ও মার্চের প্রথম সপ্তাহে তাঁরা ফিরে আসেন। প্রকল্প এলাকায় ১৪ দিনের কোয়ারেন্টিন শেষে যখন তাঁরা কাজে যোগ দিলেন, তখন বাংলাদেশে করোনার প্রাদুর্ভাব শুরু হয়। ফলে স্থানীয় পর্যায়ে শ্রমিকসংকট দেখা দেয়। করোনা–আতঙ্কে এক হাজারের মতো স্থানীয় শ্রমিক কাজে যোগ দেননি।

এ ছাড়া চীনা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি সেতুর বড় বড় স্টিল অবকাঠামো চীন থেকে বানিয়ে এ দেশে নিয়ে আসে। অন্য মালামালও চীন থেকে আনা হয়। চীনে করোনার প্রকোপ শুরু হওয়ায় প্রায় দুই মাস কোনো মালপত্র আসেনি।

>

করোনার কারণে পদ্মা সেতুর কাজ এগোয়নি
আইএমইডি বলছে, সময়মতো প্রকল্পের কাজ শেষ হবে না
সময় বাড়লে খরচও বাড়বে
পদ্মা সেতুর কাজে আবার দেরি

নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ করা নিয়ে পদ্মা সেতু প্রকল্পের পরিচালক শফিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে খুব বেশি আশার কথা শোনাতে পারেননি। ২০২১ সালের জুন মাসের মধ্যে প্রকল্পের কাজ শেষ করা নিয়ে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘করোনা শেষ হওয়ার আগে কিছুই বলতে পারছি না। করোনা শেষ হলে পুরো প্রকল্পটি পর্যালোচনা করা হবে। তখন হয়তো প্রকল্পের সময় বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হতে পারে।’ তিনি জানান, করোনার সময়ে প্রকল্পের কাজের গতি আগের চেয়ে বেশ কমেছে। আগের মতো পুরোদমে কাজ করা যাচ্ছে না।

তিন মাসে অগ্রগতি দেড় শতাংশ

পদ্মা সেতু দেশের চতুর্থ বৃহত্তম প্রকল্প। আইএমইডি ও পদ্মা সেতু কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা গেছে, গত মে মাস শেষে পদ্মা সেতু প্রকল্পের সার্বিক বাস্তবায়ন হয়েছে ৭৯ দশমিক ৫০ শতাংশ। গত ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত বাস্তবায়ন ছিল ৭৮ শতাংশ। এর মানে মার্চ, এপ্রিল ও মে—এ তিন মাসে প্রকল্পের কাজ এগিয়েছে মাত্র দেড় শতাংশ। হিসাব অনুযায়ী, গত মে মাস পর্যন্ত প্রকল্পের প্রায় ২৪ হাজার কোটি টাকার মতো খরচ হয়েছে। করোনার কারণে তিন মাসে ৫০০ কোটি টাকার মতো খরচ করা সম্ভব হয়েছে। তবে মূল সেতুর কাজ ৮৫ শতাংশ শেষ হয়ে গেছে।

২০২১ সালের জুন মাসে প্রকল্পটি শেষ হওয়ার কথা থাকায় চলতি অর্থবছরের (২০২০-২১) বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) ৫ হাজার কোটি টাকা রাখা আছে। এর আগে প্রতিবছর মূল এডিপিতে যত টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে, এর পুরোটা কখনোই খরচ করতে পারেনি পদ্মা সেতু কর্তৃপক্ষ। অর্থবছরের শেষের দিকে বাধ্য হয়ে বরাদ্দ কমাতে হয়েছে। শেষ পর্যন্ত সংশোধিত বরাদ্দও খরচ করতে না পেরে প্রায় প্রতিবারই টাকা ফেরত দিয়েছেন প্রকল্প কর্মকর্তারা।

আইএমইডির ওই প্রতিবেদনের হিসাব অনুযায়ী, সেতুর নির্মাণকাজ শুরু থেকে এ পর্যন্ত সংশোধিত এডিপিতে বরাদ্দের টাকা খরচ করতে না পেরে সব মিলিয়ে প্রায় ১ হাজার ৩০০ কোটি ফেরত দিতে হয়েছে।

তিনবার খরচ বৃদ্ধি

পদ্মা সেতু নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়ার পর এ পর্যন্ত তিনবার খরচ বৃদ্ধি করা হয়েছে। ২০০৭ সালের ২০ আগস্ট সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ১০ হাজার ১৬২ কোটি টাকার পদ্মা সেতু প্রকল্প জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটিতে (একনকে) পাস করা হয়। পরে বর্তমান আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার প্রথম মেয়াদের সময় দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের অভিযোগ এনে প্রকল্পের অর্থায়ন থেকে বিশ্বব্যাংকসহ দাতারা সরে গেলে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণকাজ শুরুর সিদ্ধান্ত হয়।

২০১১ সালের ১১ জানুয়ারি একনেকে প্রকল্পটি সংশোধন করে খরচ বাড়িয়ে ২০ হাজার ৫০৭ কোটি টাকা করা হয়। রেলপথ সংযুক্ত করে সেতুর নকশা পরিবর্তন করা হলে একলাফে খরচ দ্বিগুণ হয়। এর পরে ২০১৬ সালের ৫ জানুয়ারি আবার ৪০ শতাংশ খরচ বাড়ানো হয়। নদীশাসনে খরচ বৃদ্ধি, পাইলের নকশা পরিবর্তন—এসব কারণ দেখানো হয়। ফলে প্রকল্পের খরচ বেড়ে দাঁড়ায় ২৮ হাজার ৭৯৩ কোটি টাকা। সর্বশেষ ২০১৮ সালের ২১ জুন একনেকে পদ্মা সেতু নির্মাণের খরচ আবার বাড়িয়ে ৩০ হাজার ১৯৩ টাকা করা হয়।

পদ্মা সেতুর বারবার খরচ ও মেয়াদ বৃদ্ধির প্রভাব সম্পর্কে বড় অবকাঠামো বিশেষজ্ঞ ও সাবেক সচিব এম ফাওজুল কবির খান প্রথম আলোকে বলেন, এতে অবশ্যই অর্থনৈতিক সুবিধা কমে যাবে। প্রকল্পে যে টাকা খরচ করা হচ্ছে, তা উঠে আসবে টোল আদায়ের মাধ্যমে। ইতিমধ্যে তিন গুণ খরচ বৃদ্ধি করা হয়েছে। সেতু পারাপারে ভারী যানবাহনের জন্য টোল ধরা হয়েছে দেড় হাজার টাকা। এটি বাড়িয়ে সাড়ে চার হাজার টাকা করা যাবে না। তাহলে আগামী ৪০ বছরে বিনিয়োগ করা অর্থ উঠে আসবে না। তিনি আরও বলেন, খরচ বাড়লে সুবিধা কমবে। কেননা, বাড়তি খরচ এখন করে ফেলা হচ্ছে। ওই খরচ করা অর্থের সুবিধা দীর্ঘ সময় নিয়ে উঠে আসবে। এভাবে খরচ বাড়লে প্রকল্পের নেট প্রেজেন্ট ভ্যালু (প্রকৃত বর্তমান মূল্য) নেতিবাচক হয়ে যায়। নেতিবাচক হলে এ ধরনের বড় অবকাঠামো জাতীয় সম্পদ থেকে বাদ পড়ে যাবে। সরকারের অন্যতম অগ্রাধিকার প্রকল্প হিসেবে করোনা–পরবর্তী সময়ে একটি বিশেষ কর্মপরিকল্পনা তৈরির তাগিদ দেন ফাওজুল কবির খান।