করোনায় এটিএমে লেনদেন কমেছে

জরুরি প্রয়োজন ছাড়াও জমা টাকা তুলতে এটিএম বুথের ব্যবহার উপজেলা পর্যায় পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছে। বিদ্যুৎ নেই, এমন এলাকাতেও সৌরবিদ্যুতের মাধ্যমে চলছে এটিএম বুথ। ফলে প্রতি মাসে গড়ে ১৫ হাজার কোটি টাকা উত্তোলন হতো এটিএম বুথ থেকে। তবে করোনাভাইরাসের ধাক্কায় গত এপ্রিলে তা কমে নেমে এসেছে ৮ হাজার কোটি টাকায়।

একইভাবে কেনাকাটা ও রেস্টুরেন্টে কার্ডের ব্যবহারও ব্যাপকভাবে বাড়ছিল। করোনার আগে স্বাভাবিক সময়ে তাই পয়েন্ট অব সেলসে (পিওএস) লেনদেনের পরিমাণ প্রতি মাসে গড়ে ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকায় পৌঁছে যায়। কিন্তু করোনার সংক্রমণ ঠেকাতে ২৬ মার্চ থেকে সরকার সাধারণ ছুটি ঘোষণা করলে বন্ধ হয়ে যায় বিপণিবিতান, দোকানপাট, রেস্টুরেন্ট সবই। তাতে পিওএসের লেনদেনেও ধস নামে। করোনার ধাক্কায় সেই লেনদেন দেড় হাজার কোটি টাকা থেকে কমে এপ্রিলে নেমে এসেছে মাত্র সাড়ে ৪০০ কোটি টাকায়। একইভাবে মেশিনে টাকা জমা দেওয়ার (সিআরএম) পরিমাণও বেশ কমেছে। তবে এই সময়ে ঘরে বসে কার্ড বা ইন্টারনেট ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে ই-কমার্স লেনদেনের পরিমাণ বেড়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদন থেকে এ–সংক্রান্ত তথ্য পাওয়া গেছে।

ব্যাংক কর্মকর্তারা বলছেন, করোনার কারণে মানুষের আয় কমে গেছে, আবার করোনার কারণে উদ্বেগ–উৎকণ্ঠায় থাকা মানুষ অপ্রয়োজনীয় খরচ কমিয়ে দিয়েছে। ঘরের বাইরেও মানুষের চলাচল ছিল এপ্রিল পর্যন্ত খুবই সীমিত। এ কারণে এ সময়ে এটিএমে লেনদেন কমে গেছে। পাশাপাশি বন্ধের কারণে পিওএসেও লেনদেন কমে গেছে। সিআরএমের মাধ্যমে ক্রেডিট কার্ড বা ঋণের ছোট কিস্তির টাকা জমা হয়। কিন্তু করোনায় ঋণের কিস্তি আদায়ও কমে গেছে। কারণ বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে, আগামী সেপ্টেম্বর পর্যন্ত কোনো ঋণগ্রহীতা কিস্তির টাকা দিতে না পারলেও ওই ঋণগ্রহীতাকে খেলাপি করা যাবে না। এ কারণে নিয়মিত কিস্তি আদায় হচ্ছে না, তাতে সিআরএম লেনদেনও কমেছে।

গত ২৬ মার্চ থেকে সাধারণ ছুটি ঘোষণার পর সীমিত হয়ে পড়ে ব্যাংকের শাখা কার্যক্রম। তাই ওই সময় টাকা তোলার ক্ষেত্রে বিকল্প ছিল এটিএম বুথ। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদন বলছে, শাখা কার্যক্রম সীমিত থাকার পরও এপ্রিলে বাড়েনি এটিএমের লেনদেন। বরং মার্চের তুলনায় তা অর্ধেক হয়ে গেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, জানুয়ারি মাসে সারা দেশে ছড়িয়ে–ছিটিয়ে থাকা এটিএমে মোট ১ কোটি ৮৩ লাখ ৯৯ হাজার ৯৩৭টি লেনদেন হয়েছিল। এতে সব মিলিয়ে ১৪ হাজার ৮২৯ কোটি টাকা উত্তোলন করা হয়। ফেব্রুয়ারি ও মার্চ মাসেও ১৪ হাজার কোটি টাকার কিছু বেশি উত্তোলন হয়। তবে এপ্রিলে উত্তোলন কমে হয় ৮ হাজার ১৮৭ কোটি টাকা। আর লেনদেন সংখ্যা কমে নেমে আসে ৯৪ লাখ ৬৭ হাজার ৪১২টিতে।

বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি এটিএম নেটওয়ার্ক রয়েছে ডাচ্‌–বাংলা ব্যাংকের। দেশের প্রায় সব ব্যাংকের গ্রাহকেরা ডাচ্‌–বাংলার এটিএম নেটওয়ার্ক ব্যবহার করেন। সারা দেশে ব্যাংকটির সাড়ে ৫ হাজারের বেশি এটিএম বুথ রয়েছে। জানতে চাইলে ডাচ্‌–বাংলা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবুল কাশেম মো. শিরিন প্রথম আলোকে বলেন, এপ্রিলে সরকারি সাধারণ ছুটি ছিল। শুরুর দিকে মানুষ আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিল। অনেক প্রতিষ্ঠান মার্চ মাসের বেতনও সময়মতো দেয়নি। এ ছাড়া অতি প্রয়োজনীয় কেনাকাটা ছাড়া কেউ টাকা খরচ করেনি। বন্ধ ছিল রেস্টুরেন্ট, দোকানপাট। এর ফলে লেনদেন এত কমে গেছে।

জানা গেছে, করোনার কারণে এপ্রিল মাসে ব্যাংকগুলো কোনো এটিএম বুথ, পিওএস, সিআরএম সংখ্যা বাড়ায়নি। তবে ওই সময়ে ব্যাংকের ডেবিট ও ক্রেডিট কার্ডের সংখ্যা বেড়েছে।

এদিকে সাধারণ ছুটিতে দোকানপাট বন্ধ থাকায় পিওএসে লেনদেনও অনেক কমে গেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাবে, জানুয়ারিতে পিওএসের মাধ্যমে লেনদেন হয়েছিল ১ হাজার ৬৬৬ কোটি টাকা। লেনদেন সংখ্যা ছিল ২৯ লাখ ৪৭ হাজার ৩৮টি। কিন্তু এপ্রিলে তা কমে নেমে আসে মাত্র ৪৫৪ কোটি টাকায়।

দেশজুড়ে বিভিন্ন বিপণিবিতান, দোকানপাট, রেস্টুরেন্টে ৩২ হাজার পিওএস মেশিন সরবরাহ করে শীর্ষে রয়েছে দি সিটি ব্যাংক। জানতে চাইলে ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাসরুর আরেফিন প্রথম আলোকে বলেন, আগে পিওএস মেশিনে প্রতি মাসে গড়ে ৪৭৫ কোটি টাকা লেনদেন হতো। এপ্রিলে সেই লেনদেন নেমে আসে মাত্র ১৩৮ কোটি টাকায়। এপ্রিলে খুব বেশি কমে যাওয়ার পর এখন আবার বাড়তে শুরু করেছে। সর্বশেষ গত জুনে পিওএসে ৩০৮ কোটি টাকা লেনদেন হয়েছে।

অন্যদিকে এপ্রিলে সাধারণ ছুটির মধ্যেও বিভিন্ন ব্যাংকের কিছু কিছু শাখায় পরিষেবা বিল দিতে ও বেতন–ভাতা উত্তোলনে গ্রাহকের ভিড় দেখা যায়। শাখায় ভিড় করলেও মেশিনে টাকা জমায় (সিআরএম) আগ্রহ খুব একটা দেখা যায়নি। এ কারণে জানুয়ারিতে যেখানে সিআরএমে জমা হয়েছিল ২৫৫ কোটি টাকা, এপ্রিলে তা কমে নেমে আসে মাত্র ৯১ কোটি টাকায়। ফেব্রুয়ারি ও মার্চে জমার পরিমাণ ছিল যথাক্রমে ২৪৬ কোটি ও ২৪৪ কোটি টাকা।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, মার্চের শেষ ভাগ থেকে এপ্রিলজুড়ে করোনার কারণে সবার মধ্যে একধরনের আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছিল। মানুষ অপ্রয়োজনীয় খরচ কমিয়ে দেওয়ার পাশাপাশি অপ্রয়োজনে ঘর থেকেও বের হয়নি। এ জন্য বিভিন্ন মাধ্যমে লেনদেনের পরিমাণ কমে গেছে। এখন ধীরে ধীরে পরিস্থিতি অনেকটাই স্বাভাবিক হয়ে আসছে।

তবে এপ্রিলে ইন্টারনেটভিত্তিক বা ই-কমার্স লেনদেন বেড়েছে। ঘরে বসে কার্ড ও অনলাইন ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে মানুষ প্রয়োজনীয় কেনাকাটা ও বিল পরিশোধ করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে, ই–কমার্স প্ল্যাটফর্মে গত ফেব্রুয়ারি ও মার্চে লেনদেনের পরিমাণ ছিল যথাক্রমে ২৪৭ কোটি ও ২২৪ কোটি টাকা। এপ্রিলে তা বেড়ে হয় ২৫৪ কোটি টাকা। তবে লেনদেন সংখ্যা আগের চেয়ে খুব বেশি বাড়েনি।

ইন্টারনেট বা অনলাইনভিত্তিক লেনদেন বৃদ্ধির কারণ হিসেবে খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, করোনার কারণে ঘরবন্দী মানুষ অনলাইনে বাজার–সদাই করার পাশাপাশি প্রয়োজনীয় বিভিন্ন সামগ্রী কিনেছেন।