অব্যবস্থাপনায় কমবে ব্যবসার সুযোগ

ঢাকা চেম্বার লোগো
ঢাকা চেম্বার লোগো

করোনাভাইরাস সংক্রমণ কমাতে না পারলে অর্থনীতি পুরোপুরি সচল করা যাবে না। আবার ভাইরাস শনাক্তে নকল সনদ ও অব্যবস্থাপনা

শক্ত হাতে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে দেশের ভাবমূর্তিও ক্ষুণ্ন হবে। ব্যবসা-বাণিজ্যের সুযোগও নষ্ট হবে। তখন নীতিসহায়তা দিয়েও কোনো কাজ হবে না।

ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) আয়োজনে ‘বেসরকারি খাতের দৃষ্টিতে বাংলাদেশের অর্থনীতির বর্তমান অবস্থা ও ভবিষ্যৎ প্রেক্ষিত’ শীর্ষক এক অনলাইন আলোচনায় অংশ নিয়ে ব্যবসায়ী নেতারা এসব কথা বলেন। তাঁরা করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় নীতিমালা প্রণয়ন ও সংস্কারের দাবি জানান। গতকাল শনিবার আয়োজিত এই আলোচনায় প্রধান অতিথি ছিলেন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান। অনুষ্ঠানের সঞ্চালক ছিলেন ঢাকা চেম্বারের সভাপতি শামস মাহমুদ।

বাংলাদেশ থেকে জাপান ও কোরিয়ার পর ইতালিতে যাওয়ার ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। সেদিকে ইঙ্গিত করে ঢাকা চেম্বারের সাবেক সভাপতি আবুল কাসেম খান বলেন, ‘আমরা পিছিয়ে যাচ্ছি। অনেক দেশে যাওয়া বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। ভবিষ্যতে আরও বন্ধ হবে যদি আমরা স্বাস্থ্যগত নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে না পারি। করোনা শনাক্তের কিছু নকল সনদের কারণে বিদেশ থেকে শ্রমিকদের ফেরত পাঠানো হচ্ছে। এটি আমাদের জন্য খুবই লজ্জাজনক। এটি নিয়ন্ত্রণ না করে যতই পরিকল্পনা ও নীতিসহায়তা গ্রহণ করা হোক না কেন, তা বৈশ্বিকভাবে গ্রহণযোগ্যতা পাবে না এবং অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হবে।’

যতক্ষণ পর্যন্ত করোনাভাইরাস ব্যবস্থাপনা সঠিকভাবে করা যাবে না, ততক্ষণ অর্থনীতিও পুরোপুরি সচল করা যাবে না বলে মন্তব্য করেন বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি এক্সচেঞ্জের চেয়ারম্যান মাশরুর রিয়াজ। তিনি বলেন, কর্মসংস্থান ধরে রাখতে উদ্যোগ নিতে হবে। চাকরি না থাকলে মানুষের আয় কমে যাবে। তাতে পণ্যের চাহিদা কমে যাবে। সেটি হলে অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে অনেক বেশি সময় লাগবে।

কর্মসংস্থান ধরে রাখার পাশাপাশি বিনিয়োগ চাঙা করতে বেশ কিছু পরামর্শ দেন মাশরুর রিয়াজ। তিনি বলেন, বিনিয়োগ টানতে নীতিসহায়তা দিতে হবে। করপোরেট কর কমানো হলেও এখনো তা থাইল্যান্ড ও ভারতের চেয়ে অনেক বেশি। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার পূর্বাভাস হচ্ছে, বৈশ্বিক বাণিজ্য ৩০ শতাংশ কমিয়ে দেবে করোনা। তাই আমাদের বহুমুখী পণ্য উৎপাদনে যেতে হবে। রপ্তানি খাতেও সংস্কার আনতে হবে। এ জন্য ভ্যাটের হার ও টার্নওভার কর কমানোর পরামর্শ দেন তিনি।

মূল প্রবন্ধে প্রধান প্রধান শিল্প ও সেবা খাতকে এগিয়ে নিতে কী ধরনের ব্যবস্থা নিতে হবে, তা তুলে ধরেন ঢাকা চেম্বারের সভাপতি শামস মাহমুদ। তিনি বলেন, কোভিড–পরবর্তী অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে সরকারের নীতিসহায়তা ও প্রণোদনার সঠিক ব্যবহার গুরুত্বপূর্ণ। চীন থেকে স্থানান্তরিত বিনিয়োগ বাংলাদেশে আনার ক্ষেত্রে সহায়ক পরিবেশ তৈরিতে সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ ও কৌশল এখনই নিতে হবে। করোনায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত অতি ক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাত ব্যাংক থেকে প্রণোদনা প্যাকেজ পাচ্ছে না বলে অভিযোগ করেন তিনি।

বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো ট্রেজারি বন্ডে বিনিয়োগ করায় অতি ক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প (এমএসএমই) ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে মনে করেন আবুল কাসেম খান। তিনি বলেন, বেশির ভাগ ব্যাংক বাংলাদেশ ব্যাংকের ট্রেজারি বন্ডে বিনিয়োগ করছে। করোনায় নিরাপদ বিনিয়োগ হিসেবে ব্যাংকগুলো এমন উদ্যোগ নেওয়ায় বেসরকারি খাতের ঋণের অর্থ বন্ডে চলে যাচ্ছে। এতে এমএসএমই খাত বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তাই ট্রেজারি বন্ডে ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগ বন্ধের পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানান তিনি।

আবুল কাসেম খান আরও বলেন, মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের অবদান অনেক। তাই তাদেরকে প্রণোদনা প্যাকেজের আওতায় নিয়ে আসার উপায় বের করতে হবে। কর্মসংস্থান ধরে রাখতে করপোরেট করহার কমানো দরকার। বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্টে মুক্তবাণিজ্য চুক্তি, আমদানি-রপ্তানি নীতি সংস্কার, কাঁচামাল উৎপাদনে নজর দেওয়ার ওপর জোর দেন তিনি।

করোনায় সরকারের রাজস্ব আদায়ে বড় ধরনের ধস নেমেছে। তাই ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়ার দিকে ঝুঁকছে সরকার। তবে ব্যাংক খাত থেকে বেশি মাত্রায় ঋণ নিলে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ কমিয়ে দিতে পারে বলে মন্তব্য করেন ঢাকা চেম্বারের আরেক সাবেক সভাপতি হোসেন খালেদ। তিনি বলেন, ‘আমরা বেঁচে থাকার চেষ্টা করছি। কর্মসংস্থান ধরে রাখার চেষ্টা হচ্ছে। পুঁজি ভেঙে হলেও কারখানা চালু রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছি।’ পুঁজিবাজারকে চাঙা করতে দ্রুত নতুন আইপিও নিয়ে আসা এবং বর্তমান বাস্তবতায় ইলেকট্রিক গাড়ি ব্যবহারে নীতিসহায়তার দাবি করেন তিনি।

দেশের বন্ড মার্কেটকে কার্যকর করার মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্পে অর্থায়ন নিশ্চিত করতে সেগুলোকে পুঁজিবাজারে নিয়ে আসার আহ্বান জানান ঢাকা চেম্বারের সাবেক সভাপতি আসিফ ইব্রাহীম। এ ছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী ব্যাংকগুলোকে কমপক্ষে ২০০ কোটি টাকা পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের অনুরোধ জানান তিনি। তাঁর প্রস্তাব, বাংলাদেশ ব্যাংক আরও বেশি হারে ট্রেজারি চালান ক্রয় করুক।

ঢাকা চেম্বারের আরেক সাবেক সভাপতি সবুর খান বলেন, ‘যা হবার হয়ে গেছে। এখনো যাতে আমরা ঘুরে দাঁড়াতে পারি, সে জন্য উদ্যোগ নেওয়া দরকার। আমাদের ভাবমূর্তির উন্নয়ন করতে হবে। এ ক্ষেত্রে ভিয়েতনাম বড় উদাহরণ। তারা শুধু ডিসিপ্লিন আর সুশাসনের জন্য অনেক দূর চলে গেছে।’

সুশাসন নিয়ে ভয় পাওয়ার কিছু নেই বলে মনে করেন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান। তিনি বলেন, সুশাসন নিয়ে সরকার কেন ভয় পাবে। এটি সরকারের জন্য লাভজনক। তবে দীর্ঘ মেয়াদে কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া গেলে সুশাসন প্রতিষ্ঠা সম্ভব। শুধু তৈরি পোশাক কারখানায় নয়, সরকারের সব খাতে কমপ্লায়েন্স নিশ্চিত করতে হবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।

করোনা শনাক্তে নকল সনদের বিষয়ে পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, ‘কিছু অসাধু ব্যক্তির অসৎ কাজের জন্য দেশ-বিদেশে আমাদের ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে। বিষয়গুলোর যেন পুনরাবৃত্তি না ঘটে, সে বিষয়ে সবার মনোযোগী হওয়া দরকার। করোনা নিয়ন্ত্রণে ভিয়েতনামের উদাহরণ আমরা অনুসরণ করতে পারি।’ ব্যবসায়ীদের পরামর্শ ও দাবিদাওয়া সরকারের ওপর মহলে তুলে ধরার আশ্বাস দেন তিনি।

আলোচনায় আরও অংশ নেন ডিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি রাশেদ মাকসুদ খান, এম এইচ রহমান, আফতাব-উল ইসলাম, বেনজীর আহমেদ, সাইফুল ইসলাম প্রমুখ।