রক্ত চলাচলহীন এক অর্থনীতি

জোসেফ স্টিগলিজ
জোসেফ স্টিগলিজ
>করোনা–পরবর্তী বিশ্ব অর্থনীতি কেমন হবে, তা নিয়ে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ জোসেফ স্টিগলিজ

যত দিন করোনাভাইরাস থাকবে, তত দিন অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার হবে না। তাই স্বাস্থ্য খাতকেই নীতিনির্ধারকদের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে। তবে সরকারের নীতিসহায়তার প্রস্তুতিও থাকতে হবে। যেমন, যারা সবচেয়ে বিপন্ন, তাদের সহায়তা দিতে হবে। ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের অনাকাঙ্ক্ষিত দেউলিয়াপনা ঠেকাতে সেখানে অর্থের প্রবাহ বাড়াতে হবে। শ্রমিক ও কারখানার মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক আরও গভীর করতে হবে।

করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের শুরুতে ভাবা হয়েছিল, দ্রুত পরিস্থিতি ঠিক হয়ে যাবে। অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার অনেকটা ভি-আকৃতির হবে। এর মানে, যে গতিতে অর্থনীতি নেমেছে, সেই গতিতে উঠবে। কিন্তু অনেকটা সময় পার হয়ে এখন জুলাই মাস চলে আসছে। যাঁরা ভি-আকৃতির অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের কথা ভেবেছিলেন, সেটা এখন অনেকটাই ফ্যান্টাসি বা কল্পনা। করোনা–পরবর্তী বৈশ্বিক অর্থনীতি হবে অনেকটা রক্ত চলাচলহীন এক অর্থনীতির মতো। যুক্তরাষ্ট্রের মতো যেসব দেশ করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলায় ব্যর্থ হচ্ছে, শুধু সেসব দেশ নয়; যারা করোনার ধাক্কা কাটিয়ে উঠেছে, তারাও ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) বলছে, বিশ্ব অর্থনীতি ২০১৯ সালের শেষে যেখানে ছিল, সেখানে ফিরে আসতে ২০২১ সালের শেষ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। শুধু তা–ই নয়, তখনো যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের অর্থনীতি আগের অবস্থান (২০১৯ সালের শেষ যে অবস্থানে ছিল) থেকে ৪ শতাংশ সংকুচিত থাকবে বা পিছিয়ে থাকবে। 

করোনা সংকটের কারণে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক প্রভাবকে দুইভাবে দেখা যেতে পারে। সামষ্টিক অর্থনীতিতে খরচ করার প্রবণতা কমেছে। কারখানার ব্যালান্স শিট ছোট হয়ে যাচ্ছে। ফলে অনেক প্রতিষ্ঠান দেউলিয়াত্বের পথে হাঁটছে। এ ছাড়া করোনাকালীন অতিমাত্রায় সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেওয়ার ফলে অনিশ্চয়তা বেড়েছে। অন্যদিকে করোনা সংকটে তৃণমূল পর্যায়ের অর্থনীতিতে একধরনের করের মতো প্রভাব ফেলছে। মানুষের ভোগ ও উৎপাদনে বড় ধরনের পরিবর্তন এনেছে, যা ভবিষ্যতে অর্থনীতিতে বিরাট রূপান্তর ঘটাবে।

অর্থনীতির ইতিহাস ও তত্ত্ব বিবেচনা করলে দেখা যায়, বিদ্যমান বাজারব্যবস্থা একাই এই ধরনের রূপান্তরের চালিকা শক্তিতে আবির্ভূত হতে পারবে না। যেমন, এয়ারলাইনসের কর্মীদের এক ধাপেই জুম টেকনিশিয়ান বানানো যাবে না। যদি তা করাও যায়, তাহলে শ্রমবাজার হয়ে পড়বে বেশি মাত্রায় প্রযুক্তিনির্ভর এবং আগের মতো শ্রমঘন থাকবে না। এতে অতিরিক্ত শ্রমশক্তি অলস পড়ে থাকবে। বেকার বাড়বে।

করোনার অতিমারি বৈষম্য বাড়িয়ে দেবে। কারণ, করোনাভাইরাস যন্ত্রপাতিতে সংক্রমিত হয় না। তাই যন্ত্রের মাধ্যমে কাজ করানোতেই বেশি আগ্রহী হয়ে উঠবেন উদ্যোক্তারা। বিশেষ করে যেসব খাতে অদক্ষ শ্রমিক বেশি কাজ করেন, সেখানে যন্ত্রের ব্যবহার বাড়বে। ফলে নিম্ন আয়ের মানুষের কাজের সুযোগ কমবে, এতে সব ক্ষেত্রেই বৈষম্য আরও বাড়বে। কারণ, নিম্ন আয়ের মানুষেরা আয়ের সিংহভাগ মৌলিক চাহিদা পূরণে খরচ করেন।

এর বাইরেও আরও সমস্যা আছে। যেমন, ২০০৮-০৯ সালের মতো মুদ্রানীতি দিয়ে বিভিন্ন কোম্পানির সাময়িক তারল্য সংকটের সমস্যার হয়তো সাময়িকভাবে সমাধান করা যাবে। কিন্তু তা ওই কোম্পানির সক্ষমতার সমস্যা দূর করা যাবে না। আবার এভাবে তারল্য সুবিধা দিয়ে অর্থনীতিকে বাড়তি প্রণোদনা দেওয়া যাবে না। কেননা, চাহিদা না থাকায় এমনিতেই সুদের হার শূন্যের পর্যায়ে নেমে এসেছে। তাই এই সংকট মোকাবিলায় স্বল্পমেয়াদি অগ্রাধিকার হলো, স্বাস্থ্য খাতের জরুরি অবস্থাকে গুরুত্ব দেওয়া। কারণ, যত দিন এ ভাইরাস থাকবে, তত দিন অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার হবে না। 

ব্যবসা-বাণিজ্য চাঙা করতে উদ্যোক্তাদের জন্য ‘বেইল আউট’ কর্মসূচি দিয়ে খুব বেশি লাভবান হওয়া যাবে না। যেমন, করোনার আগে থেকেই পুরোনো খুচরা বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলো সমস্যায় নিমজ্জিত। অনলাইনে বেচাকেনা বৃদ্ধি পাওয়ায় তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য নিম্নমুখী। যদি তাদের জন্য বেইল আউট কর্মসূচি দেওয়া হয়, তাহলে তা হবে নিছকই ঝরনা দিয়ে দূরে পানি ছিটানোর মতো; কোনো কাজে আসবে না। 

কোভিড–১৯ আরও অনেক দিন আমাদের সঙ্গে থাকবে। তাই আমাদের খরচের অগ্রাধিকারগুলো ঠিক করতে হবে। যখন করোনার আবির্ভাব হলো, তখন আমেরিকার সমাজ জাতিগত ও অর্থনৈতিকভাবে বিভক্ত ছিল। দেশটির স্বাস্থ্যসেবার মান কমেছে। জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর মারাত্মকভাবে নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। স্বাস্থ্য সুবিধার উন্নতির পাশাপাশি পরিবেশবান্ধব, মেধানির্ভর কোম্পানি প্রতিষ্ঠায় জোর দিতে হবে। এই মূল্যবোধ নির্ভর করবে, অগ্রাধিকারভিত্তিতে কীভাবে সরকারি অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে। পরিবেশবান্ধব অর্থনৈতিক রূপান্তর, শ্রমঘন খাতে সরকারি অর্থ বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। এতে বেকারত্বের সমস্যার সমাধান হবে। এভাবে সঠিকভাবে সরকারি অর্থ খরচ করলে এর অর্থনৈতিক সুবিধা অনেক বেশি পাওয়া যায়। এটি কর ছাড় দেওয়ার প্রণোদনার চেয়ে ভালো পন্থা। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্য দেশগুলো এই ধরনের টেকসই পুনরুদ্ধার কর্মসূচি না নেওয়ার কোনো অর্থনৈতিক যুক্তি নেই।

বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত লেখার সংক্ষেপিত ভাবানুবাদ: জাহাঙ্গীর শাহ