কী যাতনা এই করোনায় বুঝছে বিশ্ব অর্থনীতি

বিক্রি কম। তাই ফ্রান্সের একটি দোকানে কম দামে পণ্য বিক্রির চেষ্টা। ছবি: এএফপি
বিক্রি কম। তাই ফ্রান্সের একটি দোকানে কম দামে পণ্য বিক্রির চেষ্টা। ছবি: এএফপি

অদ্ভুত এক সময়ে এসে পড়েছে বিশ্ব। ছয়টা মাস পার হয়ে গেলেও আটকে রয়েছে জীবন। থেমে থেমে চলছে জীবিকা। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গানের মতো বলা যায় ‘সকাতরে ওই কাঁদিছে সকলে শোন শোন পিতা, কহ কানে কানে শোনাও প্রাণে প্রাণে মঙ্গল বারতা’। কোভিড–১৯ থেকে পরিত্রাণ পেতে বিশ্ব যেন সমস্বরেই কাঁদছে। এই মহামারি প্রিয় জীবনগুলো নিয়ে নেওয়ার পাশাপাশি বিপর্যস্ত করে ফেলছে বিশ্ব অর্থনীতিকে। কোনো পূর্বাভাস, কোনো বিশ্লেষণেই আশার বাণী নেই। এই তো কদিন আগেই আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল জানাল, করোনায় এ বছর আর আগামী বছর মিলিয়ে বিশ্ব অর্থনীতি থেকে হারিয়ে যাবে ১২ ট্রিলিয়ন ডলার। বিশ্বব্যাংক বলছে, করোনা–পূর্ববর্তী অবস্থায় ফিরতে লাগবে বেশ কয়েক বছর। দিন দিনই পরিস্থিতি জটিল হচ্ছে, অর্থনৈতিক মন্দা গভীর থেকে গভীরতর হচ্ছে। এই মহামারি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সবচেয়ে খারাপ বৈশ্বিক মন্দার কারণ হওয়ার পূর্বাভাস দিচ্ছে।

১৮৭০ সাল থেকে ২০২০ এই দেড় শ বছরে এবারেরটা নিয়ে ১৪টি মন্দা দেখল বিশ্ব অর্থনীতি। বিশ্বব্যাংক বলছে, অন্য মন্দাগুলোর তুলনায় এবারেরটা যেন একেবারেই আলাদা। এমনকি ১৯১৮ সালে শুরু হওয়া স্প্যানিশ ফ্লুর সঙ্গেও এই পরিস্থিতি তুলনীয় নয়। আবার ২০০৭–২০০৯ সালের বিশ্বব্যাপী আর্থিক সংকটের সময় যে মন্দার সৃষ্টি হয়েছিল, তার চেয়ে দ্বিগুণেরও বেশি গভীর। অর্থনীতি হারাচ্ছে লাখ লাখ কোটি ডলার। বিশ্বের প্রায় সব অঞ্চলে মাথাপিছু আয় কমার পাশাপাশি বাড়ছে বেকারত্ব। 

পরিস্থিতি কতটা খারাপ

একটি দেশের অর্থনীতির স্বাস্থ্য বা অবস্থা নির্ণয়ের প্রধান নির্দেশিকাগুলোর অন্যতম হলো জিডিপি বা মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন। তেমনি বিশ্বেরটাও বোঝা যায় সামষ্টিকভাবে। বিশ্বব্যাংকের পূর্বাভাস অনুযায়ী, চলতি বছরে বিশ্বের মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) ৩ শতাংশ সংকুচিত হবে। অন্যদিকে আইএমএফ বলছে, এ বছর বিশ্বের গড় উৎপাদন আগের বছরের তুলনায় হ্রাস পাবে ৪ দশমিক ৯ শতাংশ। এর মধ্যে বিশ্বের সবচেয়ে বড় অর্থনীতি যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি সংকুচিত হবে ৮ শতাংশ। জাপানের উৎপাদন ৫ দশমিক ৮ শতাংশ কম হবে। চীনের প্রবৃদ্ধি হবে মাত্র ১ শতাংশ, যা কিনা গত কয়েক দশকের মধ্যে সর্বনিম্ন। রাশিয়ার অর্থমন্ত্রী ম্যাক্সিম রিশেতনিকভ গত মে মাসে আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, এপ্রিল থেকে জুন এই তিন মাসে গত বছরের একই সময়ের তুলনায় রাশিয়ার অর্থনৈতিক সংকোচন হবে ৯ দশমিক ৫ শতাংশ।

বছরের ছয় মাস পার হয়ে গেছে, এখনো নেই কোনো আশার কথা। ৭ জুলাই ইউরোপীয় কমিশন (ইসি) জানায়, আগে যা ভাবা হয়েছিল, ইউরোজোনের অর্থনীতি এর চেয়েও বেশি মন্দার গভীরে ডুবে যাবে। চলতি বছর ইউরোজোনের অর্থনীতি ৮ দশমিক ৭ শতাংশ সংকুচিত হতে পারে। এর আগে অর্থনীতি ৭ দশমিক ৭ শতাংশ সংকুচিত হবে বলে বলেছিল তারা।

সম্প্রতি বৈশ্বিক পরিস্থিতি নিয়ে অস্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির একদল গবেষক বেশ কিছু দৃশ্যপট তুলে ধরেছেন। তাঁরা বলছেন, পরিস্থিতি সবচেয়ে খারাপ হলে ২০২০ ও ২০২১ সালে বিশ্ব অর্থনীতি থেকে হারিয়ে যাবে ২১ দশমিক ৮ ট্রিলিয়ন ডলার। আর সবচেয়ে ভালো হলে হারাবে ১৪ দশমিক ৭ ট্রিলিয়ন ডলার (১ ট্রিলিয়ন মানে ১ লাখ কোটি)।

বিশ্বের অর্থনীতি আসলে কত বড়? গত বছরের সেপ্টেম্বরে প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী বিশ্ব অর্থনীতি প্রায় ৮৬ ট্রিলিয়ন ডলারের। সে হিসাবে সবচেয়ে খারাপ অবস্থা হলে অর্থনীতি আকার হারাচ্ছে প্রায় এক–চতুথাংশ। আর সবচেয়ে ভালো অবস্থায় থাকলে ১৭ শতাংশ।

অস্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ওয়ারউইক ম্যাককিবিন এবং রোশন ফার্নান্দোর নেতৃত্বে গবেষণাটি বিশ্ব অর্থনীতিতে করোনভাইরাস প্রভাবের ছয়টি নতুন দৃশ্যপট তৈরি করেছে। চলতি বছরের মাঝামাঝি সময়ে কোভিড–১৯–এর অবস্থা থেকে শুরু করে বেশ কয়েক বছর ধরে ভাইরাসের চলমান ঢেউয়ে বিশ্ব অর্থনৈতিক অবস্থা কী হতে পারে, সেই দৃশ্যপট বর্ণনা করা হয়েছে।

১. প্রথম দৃশ্যপটে অধ্যাপক ম্যাককিবিন বলেছেন, পরিস্থিতি সবচেয়ে ভালো অবস্থায় থাকলেও বিশ্বব্যাপী অর্থনীতি ১৪ দশমিক ৭ ট্রিলিয়ন ডলার পর্যন্ত হারাবে। এই ভালো হলো—ছয় মাসে যা হারিয়েছে তা হারিয়েছেই, বাকি ছয় মাসে ধরে নেওয়া হচ্ছে কোভিডের প্রকোপ অল্প থাকবে।

২ ও ৩. দ্বিতীয় ও তৃতীয় দৃশ্যপটে ধরে নেওয়া হয়েছে যেভাবে ভাইরাস এখন বিদ্যমান, সেভাবেই রয়েছে। মাঝে কমলে কিছুটা ক্ষতি কম হবে, বাড়লে ক্ষতি বেশি হবে।

৪. চতুর্থ দৃশ্যপটে বলা হচ্ছে পরিস্থিতি সবচেয়ে খারাপ হলে দুই বছরে অর্থনীতি থেকে হারিয়ে যাবে ২১ দশমিক ৮ ট্রিলিয়ন ডলার। এখানে খারাপ পরিস্থিতি বলতে গবেষকেরা ধরে নিয়েছেন তীব্র মাত্রায় চলতি বছরে দুই দফায় এবং আগামী বছরেও দুই দফায় কোভিডের সংক্রমণ হবে।

৫. পঞ্চম দৃশ্যপটে ২০২০ থেকে ২০২৫ পর্যন্ত পরিস্থিতি বিবেচনা করেছেন এই গবেষকেরা। এই সময়ে সবচেয়ে খারাপ অবস্থা হলে (দুই বছরের মধ্যে ভাইরাসের তীব্র চারটি ঢেউ। প্রথম বছরে কেবল লকডাউন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে) পাঁচ বছরে অর্থনীতি থেকে হারিয়ে যাবে ৩৫ দশমিক ৩ ট্রিলিয়ন ডলার।

৬. ষষ্ঠ দৃশ্যপটে বর্তমান ধারায় কোভিড যে অবস্থায় আছে, তেমন থাকলে অর্থনীতির পাঁচ বছরের সম্মিলিত লোকসানের পরিমাণ হবে সাড়ে ১৭ ট্রিলিয়ন ডলার।

এ তো অর্থনৈতিক সংকোচনের কথা। অর্থনৈতিক অবস্থা বোঝা যায় মানুষের আয় দিয়েও। সম্প্রতি একটি জরিপ প্রকাশ করেছে পরিসংখ্যানবিষয়ক প্রতিষ্ঠান স্টাটিসটা। এতে দেখা গেছে কোভিডের কারণে মে মাসে যুক্তরাষ্ট্রের অনেক মানুষের আয় কমে গেছে। জরিপে অংশ নেওয়া প্রায় তৃতীয়াংশ মানুষের (৩৪ শতাংশ) ১০ থেকে ২৫ শতাংশ আয় কমেছে। ১৩ শতাংশের কোনো আয়ই নেই। অন্যদিকে যুক্তরাজ্যের ৭ শতাংশ ও জার্মানির ৫ শতাংশের কোনো আয় নেই।

আয়ের সঙ্গে কাজ হারানোর সরাসরি যোগসূত্র রয়েছে। ৬ জুন পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রে বেকার ভাতার দাবি করা মানুষের সংখ্যা ১৫ লাখ ৪২ হাজার। ৩০ মে পর্যন্ত ছিল ২ কোটি ৯২ লাখ ৯ হাজার। অন্যদিকে যুক্তরাজ্যে কাজের বাইরে থাকা এবং কাজের সঙ্গে সম্পর্কিত সুবিধাগুলোর দাবি করা লোকের সংখ্যা মে মাস পর্যন্ত ২৩ শতাংশ বেড়ে ২৮ লাখে হয়েছে। করোনাভাইরাস সংকটে হাজার হাজার ব্যবসা বন্ধ হয়ে গেছে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও পরিস্থিতি সংকটময়। বিআইডিএসের এক জরিপে বলা হয়, বাংলাদেশের ১৩ শতাংশ মানুষ কাজ হারিয়েছেন।

উন্নত দেশগুলোর সংগঠন অর্গানাইজেশন ফর ইকোনমিক করপোরেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (ওইসিডি) সম্প্রতি প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ২০০৮ সালে বিশ্বব্যাপী আর্থিক সংকটের প্রথম মাসগুলোতে যে পরিমাণ আঘাত এসেছিল, তার চেয়েও ১০ গুণ বেশি চাকরির ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে এবারে। ওইসিডি অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, ইউরোপ, যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য উন্নত অর্থনীতির চাকরির ক্ষেত্রে ২০২২ সালের আগে করোনা–পূর্ব অবস্থায় ফিরে আসার সম্ভাবনা খুব কম। ওইসিডিভুক্ত ৩৭টি দেশের বেকারত্বের হার বছর শেষে ৯ দশমিক ৭ শতাংশে পৌঁছাবে, যা গত বছর ছিল মাত্র ৫ দশমিক ৩ শতাংশ। পরিস্থিতি আরও খারাপ হলে ১২ শতাংশ পর্যন্তও যেতে পারে। গবেষণায় দেখা গেছে, পুরুষদের তুলনায় নারীরা বেশি প্রতিকূল অবস্থায় পড়েছেন। কারণ তাঁরা সাধারণত কম সুরক্ষিত কর্মসংস্থানে যুক্ত থাকেন। ওইসিডি মনে করছে, এই সংকট স্থায়ীভাবে কাজের জগতে পরিবর্তন ঘটাবে।

ভোক্তা ব্যয়ের ওপরও অর্থনীতি ব্যাপকভাবে নির্ভর করে। অর্থনৈতিক অবস্থা নিরূপণে ‘কনজামশন ইনডেক্স’ খুবই জনপ্রিয় একটি পরিমাপক। জনগণের ব্যয় থাকলে অর্থনীতি সচল থাকে, টাকা ঘোরে, টাকায় ভ্যালু যোগ হয়। নতুন করোনাভাইরাস সরাসরি আঘাত করেছে বিশ্বের সব দেশের খুচরা দোকান, আবাসন, শিক্ষা, বিনোদন, হোটেল ও রেস্তোরাঁর মতো খাতগুলোকে। অনেকটা প্রলয়ের মতো। খুচরা পণ্য বিক্রির খাত এমনিতেই ই-কমার্স সাইটগুলোর দিক থেকে চাপে ছিল। এর সঙ্গে এখন লকডাউনের মতো বিষয় যুক্ত হওয়ায় ধনী দেশগুলোয় এটি রীতিমতো অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে। দেউলিয়া হওয়ার আবেদন করছে একের পর এক বড় বড় প্রতিষ্ঠান।

অর্থনৈতিক এ অবস্থার পরিণতি কী

জুনে ‘গ্লোবাল ইকোনমিক প্রসপেক্টাস ২০২০’ প্রকাশ করে বিশ্বব্যাংক। সংস্থাটি বলছে, গত ৮০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বড় মন্দায় পড়েছে বিশ্ব। এই করোনা মহামারির কারণে চলতি বছর ৭ থেকে ১০ কোটি মানুষ চরম দরিদ্র হয়ে পড়বে। মহামারির আগে বিশ্বব্যাংকের চরম দারিদ্র্য বলতে ওই মানুষকে বলা হতো, যিনি প্রতিদিন ১ দশমিক ৯০ ডলারের (১৬১ টাকা) চেয়ে কম অর্থে জীবন যাপন করেন। এখন তা–ও কমিয়ে আনা হচ্ছে। ২০২১ সালেও চরম দারিদ্র্য ঘুচবে না। জাতিসংঘের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, করোনার কারণে বিশ্বজুড়ে ৪০ থেকে ৬০ কোটি মানুষ দরিদ্র হয়ে পড়বে। ফলে আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে জাতিসংঘ টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার আওতায় দারিদ্র্যের হার কমিয়ে আনার যে লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে, তা মারাত্মক চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে।

৯ জুলাই প্রকাশিত আন্তর্জাতিক দাতব্য সংস্থা অক্সফামের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, কোভিড–১৯ রোগে আক্রান্ত হয়ে যত মানুষ মারা যাবে, এর চেয়েও বেশি মানুষ মারা যেতে পারে করোনার বিরূপ প্রভাবে সৃষ্ট খাদ্যের অভাবে—ক্ষুধায়। করোনার সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিরূপ প্রভাবে সৃষ্ট ক্ষুধায় প্রতিদিন ১২ হাজার মানুষ মারা যেতে পারে। ‘দ্য হাঙ্গার ভাইরাস’ শীর্ষক অক্সফামের ওই প্রতিবেদন অনুযায়ী, ব্যাপক বেকারত্ব, খাদ্য উৎপাদনে ব্যাহত হওয়া ও মহামারির কারণে সহায়তা কমে যাওয়ায় এ বছর প্রায় ১২ কোটি মানুষ অনাহার পরিস্থিতিতে চলে যেতে পারে। ৬০ কোটি মানুষ দরিদ্র হয়ে পড়বে।

 যে পদক্ষেপ নিচ্ছে অর্থনীতিগুলো

করোনার এই সময়ে বিশ্ব আসলে ক্রান্তিকালে রয়েছে। এই মহামারি বিশ্বের স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা, সরকারের আর্থিক সংস্থান ও ভাইরাসের প্রতিক্রিয়া মোকাবিলায় অনেক সংস্থার দক্ষতার ওপরই চাপ সৃষ্টি করছে। বেশির ভাগ নেতাদের জন্য অনিশ্চয়তার মাত্রা নজিরবিহীন। পরিকল্পনা ও সমস্যা সমাধানে বেশির ভাগ কাঠামোই অক্ষম।

এখন পর্যন্ত আমরা দেখেছি, করোনা সংকট মোকাবিলায় অর্থনীতিকে টিকিয়ে রাখতে বড় বড় আকারের অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার প্যাকেজ ঘোষণা করেছে বিভিন্ন দেশ। বিলিয়ন থেকে শুরু করে ট্রিলিয়ন ডলারের এই সব সহায়তা আসলে কতটুকু মোকাবিলা করতে পারছে অর্থনীতিকে। কারণ এই বিপুল পরিমাণ প্রণোদনা জোগাতে ঋণ পরিস্থিতি খারাপ হচ্ছে দেশগুলোর। সেই সঙ্গে লকডাউন থাকায় অনেক দেশেরই বছরের ছয়টা মাস অর্থনৈতিক কার্যক্রম থমকে ছিল। 

করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াই ও অর্থনীতি পুনরায় চালু করার জন্য তিন ধরনের কৌশল নেওয়া হয়েছে, বলছে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম।

১. প্রথমটি হলো ‘ক্রাশ অ্যান্ড কন্টেইন’। এর মানে হলো একদিকে করোনা সংক্রমণের সংখ্যা একেবারে শূন্যের কাছে নামিয়ে আনা। যেমনটা করেছে দক্ষিণ কোরিয়া। দেশটি শুরু থেকেই বিধিনিষেধ আরোপ করেছে। ব্যাপক নমুনা পরীক্ষার মাধ্যমে সংক্রমিত এলাকা কোয়ারেন্টিন নিয়ে ভাইরাসের বিস্তার কমিয়ে এনেছে। নিউজিল্যান্ডও ভাইরাস প্রতিরোধে দ্রুত লকডাউন পদক্ষেপ নিয়েছে। ব্যাপক নমুনা পরীক্ষাও করেছে। এই ক্রাশ অ্যান্ড কন্টেইন পদক্ষেপ নেওয়ার সুযোগ আছে অল্প কয়েকটি দেশের। যেমন কোস্টারিকা মার্চের শেষ দিকে কঠোর লকডাউন পদক্ষেপ নেয় এবং এপ্রিলের শেষ থেকে দৈনিক গড়ে ২০ জনের মতো আক্রান্ত পাওয়া যাচ্ছে সেখানে। কিছু কিছু দেশ প্রথমে লকডাউনে না গেলেও এখন এটিকেই মূল পদক্ষেপ হিসেবে নিচ্ছে। যেমন ইসরায়েল। এই ক্রাশ অ্যান্ড কন্টেইন অন্তর্ভুক্ত সরকারগুলো এখন নতুন আক্রান্ত ন্যূনতম রাখতে কঠোর সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ বাস্তবায়নের পাশাপাশি প্রবেশের প্রধান পয়েন্টগুলোতে পরীক্ষার দিকে দৃষ্টি দিয়েছে। এর মাধ্যমে সরকারের লক্ষ্য একটি প্রাচীরযুক্ত সমাজের মধ্যে এর অর্থনীতি পুনরুদ্ধার করা।

২. দ্বিতীয় কৌশল হলো ‘ফ্ল্যাটেন অ্যান্ড ফাইট’। এর মানে হলো করোনার ভাইরাস সংক্রমণের সংখ্যা কমাতে ও স্বাস্থ্যসেবার সক্ষমতা যাতে ছাড়িয়ে না যায়, তা এড়ানোর জন্য শক্তিশালী হস্তক্ষেপ। ইউরোপের বেশির ভাগ দেশ, দক্ষিণ আমেরিকা ও উত্তর আমেরিকাসহ অনেক দেশ প্রাথমিক প্রাদুর্ভাব নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হয়েছে। ফলে তারা কিছুটা শিথিল ও লড়াইয়ের একটি বিস্তৃত কৌশল অনুসরণ করেছিল। আক্রান্তের সংখ্যায় তাত্পর্যপূর্ণ বৃদ্ধির মুখোমুখি হয়ে স্বাস্থ্যসেবার সংকট এড়াতে সামাজিক দূরত্বসহ কিছু লকডাউন জারি করেছে। ফ্ল্যাটেন অ্যান্ড ফাইট হলো কিছুটা দীর্ঘ এবং অনিশ্চিত কৌশল। লক্ষ্য হলো স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা যাতে ছাড়িয়ে না যায়, তাই পর্যায়ক্রমে অর্থনীতি পুনরায় খোলা। তবে ভাইরাস যেহেতু পুরোপুরি চলে যাচ্ছে না, তাই ভবিষ্যতে আবার প্রকোপের মুখোমুখি হওয়ার ঝুঁকিতে থাকে দেশগুলো এবং স্থানীয়ভাবে লকডাউন জারির প্রয়োজনীয়তার মুখে পড়ে। বাস্তবে এই দেশগুলো স্বাস্থ্য ও অর্থনীতিতে ভারসাম্য বজায় রাখতে সফল চিকিত্সা এবং ভ্যাকসিনের আশায় থেকে ভ্যাকসিন তৈরিতে কাজ করছে।

৩. তৃতীয় কৌশল হলো ‘সাসটেইন অ্যান্ড সাপোর্ট’। এই কৌশল নিয়েছে সুইডেন। একেবারেই আলাদা একটি কৌশল। এটি অনেকটা এমন—করোনাভাইরাসের সংক্রমণ হচ্ছে, তবে জনগণকে প্রয়োজনে সমর্থন দেওয়া হবে। সমাজ ও অর্থনীতিকে অনেকাংশে উন্মুক্ত রেখেছে সুইডেন। দুর্বল প্রবীণ জনগোষ্ঠীকে সুরক্ষিত করার জন্য কিছু বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। ভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে বা রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে কোনো পদক্ষেপই নেওয়া হয়নি।

 পরিত্রাণ কি মিলবে

আসলে এই তিন কৌশলের কোনটি যে কাজ করছে, তা বলা মুশকিল। ভাইরাস থেকে মুক্তির পাশাপাশি অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার কীভাবে সম্ভব, সেই সমন্বয় করা এখন সরকারগুলোর জন্য চ্যালেঞ্জ। বর্তমান পরিস্থিতি আগামী কয়েক মাস বিশ্ব অর্থনীতির জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ‘ভি শেপ’ পুনরুদ্ধার পেতে চায় সব দেশ। অর্থাৎ যত দ্রুত খাদে পড়েছে, তত দ্রুতই উত্থান। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম মনে করে বর্তমান অবস্থায় আরও ভালো কৌশল ও নীতি সন্ধান করা জরুরি। অনেকটা এপিনোমিকসের মতো, স্বাস্থ্যের পাশাপাশি অর্থনৈতিক ও সামাজিক ব্যয়ের একীভূত বিশ্লেষণ। সেই সঙ্গে বিশ্ব অর্থনীতি পুনরায় চালু করার জন্য প্রয়োজন একটি সমন্বিত বৈশ্বিক প্রচেষ্টা ও শিক্ষাব্যবস্থা তৈরি করা। এ বছরের শেষে বা আগামী বছরের শুরুতে ভ্যাকসিন না আসা পর্যন্ত কি কেবল অপেক্ষায় থাকবে বিশ্ব এ দুঃস্বপ্নের শেষের জন্য, এটাই এখন সবার প্রশ্ন।