করোনার সুফল অনলাইন লেনদেনে

ঘটনা ১: স্বাধীন জামান। রাজধানীর হাতিরপুল এলাকার একটি আবাসিক ভবনের ব্যবস্থাপক। ওই ভবনের বাসিন্দা ২৫ পরিবার। প্রতি মাসে বাসিন্দাদের কাছ থেকে নির্দিষ্ট পরিমাণ সেবা মাশুল (সার্ভিস চার্জ) সংগ্রহ করেন স্বাধীন। আগে সশরীরে এ মাশুল আদায় করলেও তিন মাস ধরে মোবাইলে আর্থিক সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান বিকাশের মাধ্যমে তা সংগ্রহ করছেন। সেই ভবনের গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানি, পরিচ্ছন্নতাকর্মীর বেতনসহ অন্যান্য সব খরচ পরিশোধ করা হয় এ সেবা মাশুল থেকে। বিকাশের মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহ করে আবার বিকাশের মাধ্যমেই তা খরচ বা বিতরণ করা হচ্ছে। 

ঘটনা ২ : ফরহাদ হোসেন। ঢাকায় বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানের চাকরিজীবী। প্রতি মাসে নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকা সঞ্চয় করেন। আগে অফিস যাতায়াতের পথে মাসের শুরুতে নির্ধারিত ব্যাংকে সেই অর্থ জমা দিয়ে দিতেন। করোনার কারণে তিন মাস ধরে বাসায় থেকে অফিসের (হোম অফিস) কাজ করছেন তিনি। জরুরি প্রয়োজন ছাড়া খুব একটা ঘর থেকে বের হন না। তাই বলে কী সঞ্চয় বন্ধ থাকবে? না, ফরহাদ সেটি করতে রাজি নন। তাই যে ব্যাংকের মাধ্যমে বেতন দেয় তাঁর প্রতিষ্ঠান, সেই বহুজাতিক ব্যাংকের অ্যাপ ব্যবহার শুরু করেছেন কয়েক মাস ধরে। সেই অ্যাপ ব্যবহার করে ঘরে বসেই ডিপিএসসহ প্রয়োজনীয় অর্থ স্থানান্তরের কাজ করছেন প্রতি মাসে। ব্যাংকে গিয়ে লাইন ধরে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে টাকা জমা দেওয়ার ঝামেলা নেই। ফরহাদ হোসেন তাই তাঁর নিজের মতো করেই প্রয়োজনীয় আর্থিক লেনদেনের কাজটি সম্পন্ন করছেন ঘরে বসেই।

ঘটনা ৩: মোহাম্মদ ইদ্রিস, বয়স ৭২। অবসরপ্রাপ্ত একজন স্কুলশিক্ষক। থাকেন মাদারীপুরের গ্রামের বাড়িতে। বাড়ি থেকে হাটবাজার খানিকটা দূরে। চাকরির কারণে দুই সন্তান থাকেন ঢাকায়। বার্ধক্য ও শারীরিক কিছু সমস্যা রয়েছে ইদ্রিস সাহেবের। তাই এ করোনাকালে জরুরি প্রয়োজন ছাড়া ঘর থেকে বের হন না তিনি। কিন্তু এ দুর্যোগের সময়ে ছেলেমেয়ে, আত্মীয়স্বজনের খোঁজ তো নিতে হয়। তাতে মুঠোফোনই একমাত্র ভরসা। ভিডিও কল বা কথা বলা, যা–ই হোক, তার জন্য মোবাইল রিচার্জ করতে হয়। রিচার্জ করতে হলে যেতে হয় বাজারে। কিন্তু সেটি যাতে না করতে হয় এ জন্য নিজেই তিন মাস ধরে এমএফএস সেবাদাতা একটা প্রতিষ্ঠানে হিসাব খুলেছেন। সেই অ্যাপ ব্যবহার করে যখন খুশি তখন মোবাইল রিচার্জ করেন। আর এমএফএস হিসাবে নিয়মিতভাবে টাকা পাঠান ছেলেমেয়েরা। তাই এখন মোবাইল রিচার্জের জন্য যখন–তখন আর ঘর থেকে বের হওয়ার দরকার হয় না ইদ্রিস সাহেবের। 

এমএফএস প্রতিষ্ঠান বিকাশের তথ্য অনুযায়ী, গত জানুয়ারি মাসে দেশে বিকাশের মোবাইল রিচার্জ করা গ্রাহকের সংখ্যা ছিল ৩ কোটি। এপ্রিলে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে সাড়ে ৪ কোটিতে। অর্থাৎ, মাত্র দুই মাসের ব্যবধানে ইদ্রিস সাহেবদের মতো বিকাশে মোবাইল রিচার্জ করা গ্রাহকের সংখ্যা বেড়েছে দেড় কোটি বা ৫০ শতাংশ। 

অন্য এমএফএস প্রতিষ্ঠান নগদের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তানভীর এ মিশুক জানান, নগদ হিসাব ব্যবহার করে মোবাইল রিচার্জের পরিমাণ স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে এ করোনাকালে ৩৫ শতাংশ বেশি বেড়েছে। 

ওপরের এসব ঘটনা ও পরিসংখ্যান বলছে, করোনাভাইরাস মানুষকে ঘরবন্দী করলেও দৈনন্দিন ছোটখাটো প্রয়োজনে আর্থিক লেনদেন তো করতেই হয়েছে। কিছু খরচ ও লেনদেন বন্ধের কোনো বিকল্পও ছিল না। তাই মানুষকে তার প্রয়োজন মেটাতেই হয়েছে ঘরে থেকেও। এ কারণে করোনাকালে আর্থিক লেনদেনে বেড়েছে অনলাইন–নির্ভরতা। 

পরিষেবা বিল প্রদান থেকে শুরু করে বাজার–সদাই, ওষুধ কেনাকাটা, করোনায় চাকরি হারিয়ে কষ্টে থাকা স্বজনকে সহায়তা—এমন অনেক জরুরি প্রয়োজনে মানুষ হয় মুঠোফোনে আর্থিক সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান বা এমএফএস কোম্পানিগুলো বেছে নিয়েছে, নয়তো ব্যাংকের ইন্টারনেট বা অ্যাপ–নির্ভর লেনদেনের সুবিধা কাজে লাগিয়েছে। 

অনেকদিন ধরেই এমএফএস কোম্পানি ও আর্থিক খাত সংশ্লিষ্টরা ‘ক্যাশলেস বা নগদবিহীন’ সোসাইটির কথা বলে আসছিল। কিন্তু যতটা বলা হচ্ছিল, ততটা যেন বাস্তবরূপ পাচ্ছিল না। কারণ, মানুষ তার বহুদিনের পুরোনো অভ্যাস থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছিল না। কিন্তু করোনা যেন রাতারাতি মানুষের কিছু অভ্যাসই বদলে দিল। মানুষকে ঘরবন্দী করার বিপরীতে আর্থিক লেনদেনে অনলাইন–নির্ভর করে দিয়েছে। জীবন–জীবিকার ক্ষেত্রে করোনা মানুষকে বড় ধরনের ঝুঁকিতে ফেললেও ‘নগদবিহীন’ লেনদেন বা সোসাইটি গড়ে তোলার ক্ষেত্রে যেন রাতারাতি বহুদূর এগিয়ে দিল এ করোনাকাল। 

মোবাইল আর্থিক সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান বিকাশের তথ্য অনুযায়ী, গত এপ্রিলেও বিকাশে দৈনিক গড় লেনদেনের পরিমাণ ছিল ৮০০ কোটি টাকা। আর লেনদেনের সংখ্যা ছিল দিনে ৬৫ লাখের মতো। জুন শেষে দৈনিক গড় লেনদেন বেড়ে ১ হাজার ১০০ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। আর দৈনিক লেনদেনের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭৫ লাখে। 

করোনাকালে ‘বিকাশে’ বড় উত্থান ঘটেছে রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয় বিতরণের ক্ষেত্রে। গত জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি ও মার্চে প্রতিষ্ঠানটির মাধ্যমে রেমিট্যান্স আসার পরিমাণ ছিল ২৫–২৭ কোটি টাকার মধ্যে। এপ্রিলে তা এক লাফে বেড়ে দাঁড়ায় ১০৬ কোটি টাকায়। ঈদের কারণে মে মাসে তা আরও বেড়ে গিয়ে ১৬৩ কোটি টাকা হয়েছিল। জুনে তা কিছুটা কমে নেমে এসেছে ১১৯ কোটি টাকায়। বিকাশের পরিসংখ্যান থেকে দেখা যাচ্ছে, করোনার কারণে গত তিন মাসে প্রবাসী আয় আসা তিন গুণের বেশি বেড়েছে। 

জানতে চাইলে বিকাশের প্রধান নির্বাহী কামাল কাদীর প্রথম আলোকে বলেন, দেশের সব আইনকানুন ও বিধিবিধান মেনে অনলাইন সুবিধাকে কাজে লাগিয়ে মানুষের জীবনকে সহজ করার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। এ ক্ষেত্রে বিকাশ নতুন নতুন সেবার সঙ্গে নিজেদের যুক্ত করছে। করোনাকালে অনলাইনে লেনদেনে মানুষের আগ্রহ আগের তুলনায় বেড়েছে বলে জানান তিনি।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, করোনার আগে গড়ে প্রতিদিন প্রায় ৩০ হাজার নতুন গ্রাহক যুক্ত হতেন বিকাশে। করোনার কারণে তা বেড়ে এখন গড়ে প্রতিদিন প্রায় ৬০ হাজারে উন্নীত হয়েছে। অর্থাৎ, বিকাশে নতুন গ্রাহক যুক্ত হওয়ার পরিমাণ বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে করোনাকালে। 

মানুষের দৈনন্দিন কেনাকাটায়ও যে অনলাইন–নির্ভরতা বেড়েছে, তার প্রমাণ মেলে মুঠোফোনে আর্থিক সেবাদাতা আরেক প্রতিষ্ঠান নগদের পরিসংখ্যান থেকেও। নগদের তথ্য অনুযায়ী, গত জানুয়ারি–মার্চ—এ তিন মাসে নগদ ব্যবহার করে বিভিন্ন মার্চেন্ট পেমেন্ট বা বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানে লেনদেনের পরিমাণ ছিল সর্বনিম্ন ৪ কোটি থেকে সর্বোচ্চ ১২ কোটি ৫৯ লাখ টাকা পর্যন্ত। কিন্তু করোনার কারণে এপ্রিল–মে মাসে এ লেনদেনের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে যথাক্রমে ৪৯৬ ও ৬৩৪ কোটি টাকায়। অর্থাৎ, করোনার কারণে নগদের মার্চেন্ট পেমেন্টের পরিমাণ ৪০ থেকে দেড় শ গুণের বেশি বেড়ে গেছে।

জানতে চাইলে নগদের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তানভীর আহমেদ মিশুক প্রথম আলোকে বলেন, ‘করোনায় মানুষের অনলাইন–নির্ভরতা আমাদের প্রত্যাশার চেয়েও অনেক বেশি বেড়েছে। ডিজিটাল লেনদেন বা নগদবিহীন লেনদেন ব্যবস্থা চালুর ক্ষেত্রে এটি আমাদের অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে যাবে। করোনায় মানুষের অনলাইন–নির্ভর লেনদেনের যে অভ্যাস গড়ে উঠেছে, তা আগামী দিনেও অব্যাহত থাকলে সেটিই হবে করোনাকালে আমাদের জন্য বড় অর্জন। যদিও করোনা মানুষের জীবন–জীবিকাকে বড় ধরনের ঝুঁকিতে ফেলেছে।’

শুধু কী কেনাকাটা? ব্যাংক থেকে ব্যাংকে টাকা স্থানান্তরেও বেড়েছে অনলাইন–নির্ভরতা। বেসরকারি ব্যাংকগুলোর অ্যাপ–নির্ভর লেনদেনের ক্ষেত্রে দি সিটি ব্যাংকের ‘সিটিটাচ’ শীর্ষস্থানীয় একটি অ্যাপ। এ অ্যাপ ব্যবহার করে সিটি ব্যাংকের যেকোনো হিসাবে টাকা স্থানান্তরের পাশাপাশি অন্য ব্যাংকের হিসাবেও টাকা পাঠানো যায়। এ ছাড়া কার্ডের বিল বা মাশুল পরিশোধ থেকে শুরু করে প্রায় সব ব্যাংকিং সেবা এ অ্যাপের মাধ্যমে করা যায়।

ব্যাংকটির তথ্য অনুযায়ী, গত ফেব্রুয়ারি মাসে সিটিটাচের মাধ্যমে লেনদেনের পরিমাণ ছিল প্রায় ৫৪৪ কোটি টাকা। আর করোনার কারণে গত জুনে সিটিটাচে লেনদেনের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৭০০ কোটি টাকায়। আর মোট লেনদেনের সংখ্যা বেড়েছে প্রায় ৩১ শতাংশ। 

জানতে চাইলে সিটি ব্যাংকের ইন্টারনেট ব্যাংকিং বিভাগের প্রধান গোলাম ইয়াজদানী প্রথম আলোকে বলেন, ‘করোনাকালে গ্রাহকের অনলাইন ব্যাংকিংয়ে আগ্রহ ও ব্যবহার উভয়ই বেড়েছে। ফলে আমাদের ব্যাংকের অনলাইন–নির্ভর লেনদেন অনেক বেড়েছে। লেনদেনের ধরন পর্যালোচনায় দেখা যাচ্ছে, মাসিক সঞ্চয় স্কিম ও বিভিন্ন মেয়াদি আমানতের অর্থ জমা দিতে গ্রাহকেরা ইন্টারনেট ব্যাংকিং করছেন। এ ছাড়া অন্যান্য ব্যাংক ও এমএফএস হিসাবে টাকা স্থানান্তরেও অ্যাপের ব্যবহার স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি বেড়েছে। পাশাপাশি কার্ডের বিল ও বিমা পরিশোধের ইন্টারনেট ব্যাংকিং বেড়েছে।’ 

এমএফএস প্রতিষ্ঠান বিকাশ থেকে সিটি ব্যাংকে টাকা স্থানান্তরের পরিমাণও বেড়েছে করোনাকালে। গত মার্চেও বিকাশ থেকে প্রতি লেনদেনে গড়ে ৪ হাজার ৩০০ টাকা সিটি ব্যাংকে জমা হতো। জুনে সেটির পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮ হাজার টাকায়। অন্যদিকে ব্যাংক থেকে বিকাশে লেনদেনের সংখ্যা বেড়েছে প্রায় ৩৫ শতাংশ আর টাকার অঙ্কে বেড়েছে ৮৫ শতাংশ। সিটি ব্যাংক ও বিকাশের মধ্যকার চুক্তির আওতায় অর্থ স্থানান্তরের এ লেনদেন হচ্ছে।

করোনাকালে মানুষের অনলাইন–নির্ভর লেনদেন বেড়ে যাওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা অনেক দিন ধরেই “নগদবিহীন” সোসাইটির কথা বলে আসছি। কিন্তু মানুষ তার দীর্ঘদিনের অভ্যাস পরিবর্তন না করায় সেটি কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় হচ্ছিল না। করোনা এসে মানুষকে পুরোনো অভ্যাসের বদলে অনলাইন–নির্ভর লেনদেনে বাধ্য করেছে। অনলাইন–নির্ভর লেনদেন যত বাড়বে, তত দুর্নীতি ও নানা ধরনের আর্থিক প্রতারণা কমে আসবে।’

আহসান এইচ মনসুরের মতে, অনলাইন–নির্ভর লেনদেনের সবচেয়ে বড় সুফল হচ্ছে মানুষের জীবন সহজ হয়ে যাওয়া। মানুষ কম সময়ে ঘরে বসে সহজে তার প্রয়োজনীয় লেনদেনটি সম্পন্ন করতে পারছে। ব্যাংক,এমএফএস বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো যত বেশি অনলাইন–নির্ভর লেনদেন করবে, তাতে পরিচালন খরচ কমে আসবে। এতে কম খরচে প্রতিষ্ঠানগুলো অনেক বেশি মানুষকে সেবা দিতে পারবে।