ফজলে কবির আবার গভর্নর, প্রজ্ঞাপন জারি

বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির। ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির। ছবি: সংগৃহীত

নিজের জন্মদিনেই পদ থেকে বিদায় নেবেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির। সেটা অবশ্য ২০২২ সালের ৪ জুলাই সোমবার। তিনি গভর্নর থাকবেন ওই বছরের ৩ জুলাই পর্যন্ত।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ ফজলে কবিরকে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর পদে আবার নিয়োগ দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে আজ বুধবার। আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের উপসচিব মো. জেহাদউদ্দিন স্বাক্ষরিত প্রজ্ঞাপনে বলা রয়েছে, ৬৭ বছর বয়স পর্যন্ত ফজলে কবির গভর্নর থাকবেন।

ফজলে কবির কেন্দ্রীয় ব্যাংকে নতুন করে কবে যোগ দেবেন, জানতে চেয়ে মোবাইল ফোনে খুদে বার্তা পাঠালে কোনো জবাব দেননি তিনি। সুনির্দিষ্ট করে বলতে পারছেন না বলে জানান বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মো. সিরাজুল ইসলামও।
রিজার্ভ চুরির ঘটনায় ২০১৬ সালের ১৫ মার্চ তৎকালীন গভর্নর আতিউর রহমান পদত্যাগ করলে তাড়াহুড়ো করে পরদিনই ফজলে কবিরকে চার বছরের জন্য গভর্নর নিয়োগ দেয় সরকার। তখন তিনি বিদেশে ছিলেন এবং ফিরে এসে গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব নেন ২০ মার্চ। সে হিসেবে তাঁর মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা ছিল এ বছরের ১৯ মার্চ।

কিন্তু মেয়াদ শেষ হওয়ার ৩৪ দিন আগে গত ১৬ ফেব্রুয়ারি গভর্নর হিসেবে তাঁর মেয়াদ ৩ মাস ১৩ দিনের জন্য বাড়িয়ে দেয় সরকার। এতে বলা হয়, ৬৫ বছর পূর্ণ হওয়া পর্যন্ত তিনি গভর্নর থাকবেন। বাংলাদেশ ব্যাংক অর্ডারে চার বছরের জন্য কাউকে গভর্নর পদে নিয়োগ দেওয়ার কথা বলা থাকলেও সরকার এ মেয়াদ আরেক দফা বাড়াতে পারে বলে অর্ডারে বলা রয়েছে।

ফজলে কবিরের ৬৫ বছর বয়স শেষ হয় ৩ জুলাই। তার আগেই মে মাস থেকে শুরু হয় গভর্নর পদের মেয়াদ দুই বছর বাড়িয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক অর্ডার সংশোধনের কাজ। মন্ত্রিসভা ঠিক সময়ে অনুমোদন করলেও সংসদে বিল আকারে তা আর যথাসময়ে উপস্থাপিত হয়নি। এই ফাঁকে সংসদ মুলতবি হয়ে যায় ৮ জুলাই পর্যন্ত। ফলে বিল পাস হয় ৯ জুলাই।

অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল চিকিৎসার জন্য ইংল্যান্ড রয়েছেন। আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ এরপরও ফজলে কবিরকে আবার গভর্নর করার প্রস্তাব ই-নথির মাধ্যমে অর্থমন্ত্রীর অনুমোদন করিয়ে আনে। এরপর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ও রাষ্ট্রপতির কার্যালয় ঘুরে ফাইল আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগে এলে বিভাগটি প্রজ্ঞাপন জারির এখতিয়ার পায়। বাংলাদেশ ব্যাংক অর্ডার সংশোধন করে কাউকে গভর্নর পদে বসানো দেশের ইতিহাসে প্রথম ঘটনা।

হিসাব করে দেখা যায়, প্রথম দফায় ৪ বছর, দ্বিতীয় দফায় ৩ মাস ১৩ দিন এবং তৃতীয় দফায় ১ বছর ১১ মাস ১৫ দিন অর্থাৎ মোট ৬ বছর ৩ মাস গভর্নর হিসেবে ইতিহাসের পাতায় থাকছেন ফজলে কবির।

তবে ফজলে কবিরকে আবার নিয়োগ দিতেই যে আইন সংশোধন করা হয়েছে, তা নিয়ে কোনো রাখঢাক করেননি অর্থমন্ত্রী। ইংল্যান্ড যাওয়ার আগে তিনি প্রথম আলোকে বলেছেন, কোভিড-১৯ পরিস্থিতি মোকাবিলা ও অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে প্রায় এক লাখ কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়েছে। এগুলোর বেশির ভাগই বাস্তবায়িত হবে ব্যাংক খাতের মাধ্যমে। ফলে এই সময়ে নতুন কাউকে গভর্নর পদে নিয়োগ দেওয়ার ঝুঁকি নেওয়া ঠিক হবে না।

এদিকে কার্যবিধি (রুলস অব বিজনেস) অনুযায়ী গভর্নর পদে নিয়োগ দেওয়ার এখতিয়ার আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের হলেও এত দিন এই কাজ করে আসছিল জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। ফজলে কবিরকে ২০১৬ সালে প্রথমবার নিয়োগও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ই দিয়েছিল।

গভর্নর পদের যোগ্যতা কী
দেশের মুদ্রা সরবরাহ কত হবে, টাকার মান কতটা বাড়বে বা কমবে, মূল্যস্ফীতির হার কত রাখা ঠিক হবে—এই সবই ঠিক করেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর। পাশাপাশি দেশের মানুষের জীবনযাপনের মান, অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্য, বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানের বিষয় সম্পর্কেও গভর্নরকে খোঁজ রাখতে হয়। এ পদে কে থাকবেন, সেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে সব দেশের সরকারই তাই বারবার চিন্তা করে।

এত গুরুত্বপূর্ণ পদ হওয়া সত্ত্বেও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর নিয়োগের কোনো নীতিমালা নেই দেশে। ফলে তাঁর যোগ্যতার কথাও বলা নেই কোথাও। এ সুযোগটি নিয়েই যে কাউকে গভর্নর বানায় সরকার।

অনেক দেশ গভর্নর বেছে নেয় আন্তর্জাতিক অর্থ ব্যবস্থাপনা ও ব্যাংকিংয়ে অভিজ্ঞতাসম্পন্ন কোনো ব্যক্তিকে। তবে বিশেষজ্ঞরা বলে থাকেন, অঙ্কশাস্ত্র, ব্যাংকিং ও প্রশাসনিক দক্ষতাসম্পন্ন লোকদেরই গভর্নর পদে বসানো উচিত। পাশাপাশি দেখা উচিত তাঁর শক্ত ব্যক্তিত্ব, সততা, নীতিনিষ্ঠতা ও স্বাধীনচেতা মনোভাব আছে কি না।

বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদের নেতৃত্বাধীন ১৯৯৬ সালে গঠিত ব্যাংক সংস্কার কমিটি ১৯৯৯ সালে যে প্রতিবেদন দাখিল করে, তাতে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর, ডেপুটি গভর্নরসহ রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের পরিচালক ও এমডিদের তালিকা তৈরির জন্য একটি জাতীয় ব্যাংকিং উপদেষ্টা পরিষদ গঠনের সুপারিশ করেছিল। গভর্নরের মেয়াদ পাঁচ বছর করা এবং পদমর্যাদা সুপ্রিম কোর্টের বিচারকের সমান করার সুপারিশও করা হয়েছিল তাতে। ওই সুপারিশ সরকার আমলে নেয়নি।

দেশের আগের গভর্নররা
স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত ১১ জন গভর্নর নিয়োগ দিয়েছে সরকার। এর মধ্যে প্রথম গভর্নর আ ন ম হামিদুল্লাহ (১৯৭২-৭৪) ছিলেন একজন ব্যাংকার। আজকে যেটি উত্তরা ব্যাংক, তা ছিল মূলত পাকিস্তানের ইস্টার্ন ব্যাংকিং করপোরেশন। এই ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ছিলেন হামিদুল্লাহ।

দ্বিতীয় গভর্নর এ কে নাজিরউদ্দীন আহমেদ (১৯৭৪-৭৬) ছিলেন স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তানের নির্বাহী পরিচালক, ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক অব পাকিস্তানের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক, সোনালী ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও এমডি । এ কে এন আহমেদ নামে পরিচিত এই ব্যাংকার বিশ্বব্যাংক এবং আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলেও (আইএমএফ) কাজ করেছেন।

দেশে সবচেয়ে বেশি সময় গভর্নর ছিলেন এম নূরুল ইসলাম (১৯৭৬-৮৭)। তিনিই দেশের প্রথম আমলা গভর্নর। পাকিস্তান সেন্ট্রাল সার্ভিস কমিশনের (সিএসপি) সাবেক কর্মকর্তা ছিলেন তিনি। তার পরের গভর্নরও আরেক আমলা শেগুফ্তা বখ্ত চৌধুরী (১৯৮৭-৯২) ছিলেন কর ক্যাডারের কর্মকর্তা। এর পরের গভর্নর এম খোরশেদ আলমও (৯২-৯৬) ছিলেন সাবেক সিএসপি কর্মকর্তা।

আওয়ামী লীগ ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় এসে জিয়া ও এরশাদ সরকারের আমলানির্ভরতা ভেঙে গভর্নর করেন দেশের বিশিষ্ট ব্যাংকার লুৎফর রহমান সরকারকে (১৯৯৬-৯৮)। এরপরের গভর্নর ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন (১৯৯৮-২০০১) একাধারে অর্থনীতির শিক্ষক ও সাবেক আমলা। গভর্নর ফখরুদ্দীন আহমদ (২০০১-২০০৫) ছিলেন অর্থনীতির শিক্ষক, আমলা এবং বিশ্বব্যাংকের কর্মকর্তা। সালেহউদ্দিন আহমেদও (২০০৫-২০০৯) তাই ছিলেন। আতিউর রহমান (২০০৯-১৬) একজন অর্থনীতিবিদ ও শিক্ষক। আর ফজলে কবির সাবেক আমলা, একসময় অর্থসচিব ছিলেন।

অর্থ মন্ত্রণালয়ে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে ছিলেন, এমন একজন ব্যক্তি প্রথম আলোকে বলেন, এফ সাইফুর রহমান যখন অর্থমন্ত্রী ছিলেন, তখন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ছিলেন ফখরুদ্দীন আহমেদ এবং বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের চেয়ারম্যান ছিলেন এ বি মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম। সাইফুর রহমানের ইচ্ছায় দুজনেরই মেয়াদ আরেক দফা বৃদ্ধির একটি প্রস্তাব তখনকার মন্ত্রিসভায় উপস্থাপন করা হয়। কিন্তু ব্যক্তিবিশেষকে মাথায় রেখে আইন সংশোধনের প্রস্তাব তখন অনুমোদন করেনি মন্ত্রিসভা।

ফজলে কবির ১৯৫৫ সালের ৪ জুলাই মুন্সিগঞ্জের টঙ্গিবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি অর্থনীতিতে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়ে রেলওয়ের সহকারী ট্রাফিক সুপারিনটেনডেন্ট হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। প্রয়াত সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত রেলমন্ত্রী থাকার সময় তিনি ছিলেন রেলসচিব। পরে তাঁকে অর্থসচিব করা হয়।

বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের কর্মচারী তাঁর স্ত্রী মাহমুদা শারমিন বেনু, মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে অতিরিক্ত সচিব থাকার সময় চাকরি শেষ হওয়ার এক দিন আগে যাকে সরকার সচিব মর্যাদায় নিয়োগ দেয়। তবে তিনি কোনো মন্ত্রণালয় বা বিভাগের সচিব ছিলেন না।