পেটের দায়ে করোনার ভয়ও দূরে

জাহেদুল ইসলাম, ইলেকট্রিক সুপারভাইজার
জাহেদুল ইসলাম, ইলেকট্রিক সুপারভাইজার

বছর তিরিশের টগবগে যুবক, নাম জাহেদুল ইসলাম। পেশায় ইলেকট্রিশিয়ান বা বিদ্যুৎ-মিস্ত্রি। কক্সবাজার সৈকতের আবাসিক হোটেল রয়েল বিচ রিসোর্টে মাসিক ১৫ হাজার টাকা বেতনে ইলেকট্রিক সুপারভাইজার হিসেবে চাকরি করতেন। কিন্তু করোনার কারণে চার মাস ধরে হোটেল বন্ধ। তাই চাকরিও নেই।

এই সৈকত শহরে হোটেল-মোটেল, গেস্টগাউস ও কটেজ রয়েছে পাঁচ শতাধিক। আর রেস্তোরাঁ আছে সাত শতাধিক। এসব জায়গায় গত ফেব্রুয়ারি মাসেও ৫০ হাজারের বেশি কর্মকর্তা-কর্মচারী কাজ করতেন। করোনার সংক্রমণ রোধে ১৮ মার্চ থেকে সৈকতে পর্যটকের আগমন নিষিদ্ধ করে জেলা প্রশাসন। সেই থেকে বন্ধ হোটেল-মোটেল, কটেজ, গেস্টহাউস, রেস্তোরাঁ সব বন্ধ। অবশ্য বন্ধের আগেই অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারী ছাঁটাই করা হয়।

কক্সবাজার হোটেল গেস্টহাউস অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক কলিম উল্লাহর দাবি, ছাঁটাই হওয়া কর্মচারীর সংখ্যা কমপক্ষে ৪০ হাজার হবে। তিনি জানান, তিন-চার মাস ধরে বেতন-ভাতা না পেয়ে তাঁরা অমানবিক জীবন কাটাচ্ছেন। আসন্ন কোরবানির ঈদ নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন। অধিকাংশ কর্মীর বসতি শহরের বিভিন্ন এলাকায়, ভাড়া বাড়িতে। তাঁদের এমন দুর্দিনে মালিকেরা কিংবা অন্য কেউই পাশে দাঁড়াচ্ছেন না।

করোনার সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় গত ৬ জুন কক্সবাজার পৌরসভাকে ‘রেড জোন’ ঘোষণা করা হয়। শুরু হয় ১৪ দিনের কঠোর লকডাউন। এ সময় ঘর থেকে কেউই তেমন বের হতে পারেননি। দোকানপাট থেকে শুরু করে সবই বন্ধ ছিল। কিন্তু সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে আসেনি। সে জন্য ৩০ জুন পর্যন্ত দ্বিতীয় দফায় লকডাউন বাড়ানো হয়। তত দিনে জাহেদুল ইসলামদের মতো নিম্ন আয়ের মানুষের অবস্থা কাহিল।

এদিকে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে এলে স্বাস্থ্যবিধি মেনে সীমিত আকারে হোটেল-মোটেল, রেস্তোরাঁ খুলে দেওয়া যেতে পারে বলে অভিমত দিয়েছেন কক্সবাজার চেম্বারের সভাপতি আবু মোর্শেদ চৌধুরী।

কলাতলী-মেরিনড্রাইভ হোটেল-রিসোর্ট মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মুকিম খান বলেন, কক্সবাজারের হোটেল-মোটেল, বিনোদনকেন্দ্রগুলো সীমিত আকারে চালু হলেও এই খাতের শ্রমিক-কর্মচারীরা জীবিকা নির্বাহের সুযোগ পেতেন এবং পর্যটনশিল্পও কিছুটা ঘুরে দাঁড়ানোর শক্তি পেত। 

জাহেদুল ইসলাম শহরের পাহাড়তলী এলাকায় একটি আধা পাকা টিনশেড বাড়িতে থাকেন। সাত সদস্যের পরিবার। বাবা আবদুর রহিম রাজমিস্ত্রি, আর ছোট যমজ দুই ভাই আবদুল হক ও নুরুল হক দোকানে চাকরি করতেন। তাঁরা তিনজনে আয় করতেন ২০-২৫ হাজার টাকা। সঙ্গে জাহেদুলের ১৫ হাজার মিলিয়ে ৪০ হাজার টাকায় মোটামুটি ভালোই কাটছিল তাঁদের। কিন্তু করোনা ও লকডাউনের কারণে বাবা ও ভাইদের রোজগার বন্ধ। কেবল জাহেদুল বৈদ্যুতিক কাজ জানেন বলে তিন মাস ধরে টুকটাক কিছু আয় করেন। কিন্তু রোজ রোজ তো মানুষের বাড়িতে ইলেকট্রিক বা বৈদ্যুতিক কাজ থাকে না। তাই কাজ না পেলে অর্ধাহারে-অনাহারে থাকতে হয় সবাইকে। এই অবস্থায় এক বছরের ফুটফুটে মেয়েটির জন্যই বেশি কষ্ট হয় জাহেদুলের।

করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত শহরের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ । অনেকেই কমবেশি সরকারি-বেসরকারি ও ব্যক্তি উদ্যোগে দেওয়া ত্রাণসহায়তা পাচ্ছেন। কিন্তু জাহেদুলের মতো হোটেল কর্মচারীদের পাশে কেউ নেই। তাই কয়েক দিন পরপর ভালো খবরের আশায় প্রিয় কর্মস্থল হোটেল রয়েল বিচ রিসোর্টে ছুটে যান। কিন্তু কখন পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে, আর তিনি ফিরে পাবেন চাকরি, সেই প্রত্যাশায় দিন কাটে তাঁর।

জাহেদুল ইসলামের সঙ্গে সম্প্রতি এক দুপুরে কক্সবাজারের হোটেল-মোটেল জোনের প্রধান সড়কে দাঁড়িয়ে কথা হয়।

কী খবর, জিজ্ঞেস করতেই জাহেদুলের জবাব, ‘ক্যামনে ভালো থাকি, ভাই? করোনা আমাদের জীবনটাকে এলোমেলো করে দিল। কোথাও কাজকর্ম নাই। করোনা থেকে কখন মুক্তি পাব, হোটেল-মোটেল কখন খুলবে, সেই আশাতেই দিন গুনছি।’

একটু বিরতি দিয়ে লম্বা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে জাহেদুল ইসলাম পাল্টা প্রশ্ন করেন, ‘হোটেল-মোটেল কখন খুলবে, আপনি কিছু জানেন?’ এরপর বলেন, ‘আপনাদের (সাংবাদিকদের) সঙ্গে তো প্রশাসনের ওপর মহলের যোগাযোগ আছে। হোটেল-মোটেল সহসা খুলে না দিলে আমার মতন হাজার হাজার কর্মচারীর পরিবারে দুর্বিষহ যন্ত্রণা নেমে আসবে।’

কিছুক্ষণের মধ্যে সেখানে জড়ো হন আরও কয়েকজন যুবক। তাঁরাও হোটেল-মোটেল ইত্যাদির কর্মচারী। তিন মাস ধরে চাকরি না থাকা এসব যুবককেও বেশ হতাশ মনে হলো। তাঁরা জানান, জীবিকার তাগিদে কেউ পথে পথে ঘুরে চা বিক্রি করছেন, কেউ বিক্রি করছেন মাস্ক, অনেকেই চালাচ্ছেন ইজিবাইক, টমটম কিংবা অটোরিকশা।

বাড়ির পথে হাঁটতে হাঁটতে জাহেদুল বললেন, ‘সপ্তাহে দু-একটা কাজ পাই। তাতে আয় হয় ৫০০-৬০০ টাকা। সে টাকায় এক দিনের বেশি চলে না। লকডাউনের সময় ৩০ হাজার টাকা ধারকর্জ করে সংসার চলেছে। এখন কেউ ধারকর্জ দেয় না। দোকানদারেরাও বাকিতে মাল দিতে রাজি হয় না। কী করব, ভেবে পাচ্ছি না।’

মা-বাবার বড় সন্তান বলে জাহেদুল ইসলাম নবম শ্রেণির বেশি পড়াশোনা করতে পারেননি। কিশোর বয়সেই ইলেকট্রিক মিস্ত্রির কাজ শিখে পরিবারের হাল ধরেন। জাহেদুলের আক্ষেপ, ‘লেখাপড়ার মূল্য কী, তা এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। লেখাপড়া করলে মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে কাজ খুঁজতে হতো না। রোহিঙ্গা শরণার্থী আশ্রয়শিবিরে মানবিক সেবায় কাজ করছে ১৪৫টির বেশি দেশি-বিদেশি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা। সেখানে শিক্ষিত বেকাররাই কাজ পাচ্ছেন। লেখাপড়া থাকলে এমন চাকরি আমরাও পেতাম।’

বিদায় নেওয়ার সময় জাহেদুল বলেন, ‘শহরে দোকানপাট, বিপণিকেন্দ্র, ব্যাংক-বিমা, অফিস খুলতে শুরু করেছে। কিন্তু হোটেল-মোটেল খুলছে না। জীবন বাঁচাতে এখন জীবিকার দরকার, পেটের দায়ে করোনায় আক্রান্ত হওয়ার ভয় ক্ষীণ হয়ে আসছে।’