'ফ্রি' ফেসবুক প্যাকেজ বন্ধ, রাজস্বও কারণ

বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারে বিনামূল্যে ইন্টারনেট প্যাকেজ বন্ধের যে নির্দেশনা দিয়েছে, তার পেছনে রাজস্ব আদায়ও একটি বড় কারণ।

সরকার চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটে কোম্পানির 'প্রমোশনাল' ব্যয় মোট বিক্রির শূন্য দশমিক ৫ শতাংশে রাখার সীমা বেঁধে দিয়েছে। তা মানতে বিনামূল্যের অফারে লাগাম টানতে অপারেটরগুলোও তেমন কোনো আপত্তি দেখাচ্ছে না। 

করোনাকালে ইন্টারনেটের ব্যবহার বাড়লেও সেখান থেকে সরকারের রাজস্ব বাড়ছে না। ফলে বিনামূল্যের অফারে লাগাম টানলে সরকারের রাজস্বও বাড়বে। সব মিলিয়ে রাজস্ব বাড়ানোর চিন্তা থেকেও বিনামূল্যে ইন্টারনেটের সুযোগ সীমিত করা হয়েছে বলে সূত্র জানিয়েছে।

দেশের গ্রাহকেরা ইন্টারনেট প্যাকেজের সঙ্গে বিনামূল্যে অথবা প্রায় বিনামূল্যে আরেকটি প্যাকেজ কিনে ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারের সুযোগ পেতেন। সেখানে লাগাম টেনেছে বিটিআরসি।
তথ্য মন্ত্রণালয়ের এক চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে বিটিআরসি গত মঙ্গলবারের তারিখ দিয়ে অপারেটরদের পাঠানো এক নির্দেশনায় বলেছে, এখন থেকে আর বিনামূল্যের ইন্টারনেট দেওয়া যাবে না। এতে বাজারে অসুস্থ্য প্রতিযোগিতা হয় এবং অনেকে বিনামূল্যের এসব প্যাকেজ ব্যবহার করে 'অপ্রয়োজনীয় অপরাধমূলক' কর্মকাণ্ড করে।

বিটিআরসির চিঠিতে ১৪ জুলাইয়ের তারিখ দেওয়া হলেও অপারেটরেরা জানিয়েছে তারা ১৬ জুলাই তা পেয়েছে। চিঠিতে ১৫ জুলাই (গত বুধবার) থেকে নির্দেশনা কার্যকর করতে বলা হয়।
এদিকে গ্রাহকসংখ্যায় শীর্ষ মোবাইল অপারেটর গ্রামীণফোন আজ শনিবার তাদের স্বীকৃত ফেসবুক পেজে এক ঘোষণায় জানিয়েছে, ফেসবুক সংশ্লিষ্ট যাবতীয় বিনামূল্যের অফার বন্ধ করেছে তারা।

গ্রামীণফোনের ওই পোস্টের নিচে একজন গ্রাহক জানতে চান, এমন কোনো বিনামূল্যের অফার ছিল কিনা। জবাবে গ্রামীণফোন জানায়, ১১০ টাকায় ১৭৫ মিনিটের সঙ্গে এক গিগাবাইট ফেসবুক ডাটা বিনামূল্যে ছিল। এ ধরনের অফার আর থাকবে না।
দ্বিতীয় শীর্ষ অপারেটর রবি আজিয়াটাও বিটিআরসির নির্দেশনা বাস্তবায়ন করেছে। গণমাধ্যমকে দেওয়া এক বিবৃতিতে আজ রবির চিফ করপোরেট অ্যান্ড রেগুলেটরি অফিসার সাহেদ আলম বলেন, 'ফেসবুক সংক্রান্ত যাবতীয় ফ্রি অফার বন্ধে যে নির্দেশনা বিটিআরসি দিয়েছে, আমরা মনে করি তা অবশ্যম্ভাবী ছিল। কারণ চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটের নির্দেশনা অনুসারে, একটি কোম্পানির প্রমোশনাল ব্যয়ের পরিমাণ তার মোট আয়ের শূন্য দশমিক ৫ শতাংশের বেশি হতে পারবে না। এই নির্দেশনা অনুসারে ফ্রি অফারকেন্দ্রিক কোনো ব্যয় নির্বাহ করা আমাদের মতো কোম্পানির জন্য স্বাভাবিকভাবেই কঠিন।'

চলতি ২০২০–২১ অর্থবছরের বাজেটের আগে কোম্পানির প্রমোশনাল ব্যয়ের সীমা ছিল না। নতুন করে সীমা বেঁধে দেওয়ায় কোম্পানিগুলোর বিনামূল্যে কোনো পণ্য বা সেবা দেওয়ার পথ অনেকটা রুদ্ধ হয়েছে। এখনও বিনামূল্যে দেওয়া যাবে। তবে সেটা মোট রাজস্বের শূন্য দশমিক ৫ শতাংশের বেশি হলে বাড়তি অংশের জন্য কর দিতে হবে। টেলিযোগাযোগ খাতে করপোরেট করের হার ৪৫ শতাংশ।

বিটিআরসির হিসাবে, দেশে মে মাস শেষে ইন্টারনেট ব্যবহারকারী দাঁড়িয়েছে ১০ কোটি ২১ লাখের কিছু বেশি। ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সেবা গ্রহণ করেন ৮০ লাখ গ্রাহক। এ ক্ষেত্রে একেকটি সংযোগের বিপরীতে ৪ জনের বেশি গ্রাহক রয়েছে বলে দাবি করে ইন্টারনেট সেবাদানকারীরা।
মোবাইল ইন্টারনেট ব্যবহার করে ৯ কোটি ৪০ লাখ গ্রাহক, যা মার্চ শেষে ৯ কোটি ৫২ লাখ ছিল। উল্লেখ্য, ৯০ দিনের মধ্যে একবার ইন্টারনেটে প্রবেশ করলেই তাকে ব্যবহারকারী হিসেবে গণ্য করা হয়।
করোনাকালে মুঠোফোনে ইন্টারনেট ব্যবহার অনেক বেড়ে গেলেও টেলিযোগাযোগ খাত থেকে বাড়তি রাজস্ব পাচ্ছে না সরকার। এর কারণ অপারেটরদের রাজস্ব কমে গেছে। অন্যদিকে বোনাস দিয়ে অথবা তুলনামূলক কম দামে বড় প্যাকেজ দিয়ে গ্রাহক আকৃষ্ট করছিল অপারেটরেরা।
যেমন, চলতি বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে (এপ্রিল-জুন) ৩ হাজার ৩০৭ কোটি টাকা রাজস্ব অর্জন করে মোবাইল অপারেটর গ্রামীণফোন, যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ৮ দশমিক ২ শতাংশ কম।

আলোচ্য সময়ে গ্রামীণফোনের একজন গ্রাহক ২ দশমিক ৫৪ গিগাবাইট ইন্টারনেট ব্যবহার করেন, যা আগের প্রান্তিকের চেয়ে প্রায় ১৭ শতাংশ বেশি। অথচ এই বাড়তি ব্যবহার থেকে আয় বাড়েনি গ্রামীণফোনের। আলোচ্য প্রান্তিকে গ্রামীণফোনের একজন গ্রাহক গড়ে ইন্টারনেটের পেছনে মাসে ৬৯ টাকা ব্যয় করেছেন, যা আগের প্রান্তিকের চেয়ে দুই টাকা কম।
গ্রামীণফোনের আর্থিক বিরবণী অনুযায়ী, চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকে (জানুয়ারি-মার্চ) একজন গ্রাহকপ্রতি গড় রাজস্ব ছিল মাসে ১৫৬ টাকা। এপ্রিল-জুন সময়ে তা ১৪৬ টাকায় নেমে যায়।
ফলে স্বাভাবিকভাবেই সরকার রাজস্ব কম পায়। কারণ অপারেটর যা আয় করে তার ৫২ থেকে ৫৬ শতাংশ যায় সরকারের কোষাগারে।
বাড়তি রাজস্বের জন্য চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটে মোবাইল সেবার ওপর সম্পূরক শুল্ক ৫ শতাংশ বাড়িয়েছে সরকার। ফলে এখন একজন গ্রাহক ১০০ টাকা কথা বলা ও খুদেবার্তার পেছনে ব্যয় করলে ২৫ টাকা যায় সরকারের ঘরে। আর ইন্টারনেটে সরকার পায় ১৮ টাকার মতো।
অপারেটর বলছে, করোনার কারণে মানুষের আয় কমে যাওয়া ও কর বাড়ানোর আংশিক প্রভাবে তাদের রাজস্ব আয় কমছে। ফলে মোবাইল সেবার ওপর কর বাড়ানোয় সরকার ১ হাজার থেকে ১ হাজার ২০০ টাকা বাড়তি রাজস্ব পেতে পারত, যদি ব্যবহার না কমে। কমে গেলে অতটা বাড়তি রাজস্ব পাওয়া যাবে না। বিনামূল্যের অফার বন্ধের ফলে অনেকেই এখন বাড়তি ব্যয়ের মুখে পড়বেন।

তাই গ্রাহকের অনেকে বিনা মূল্যের অফার বন্ধে খুশি নন। গতকাল শুক্রবার প্রথম আলোর এ বিষয়ক সংবাদের নিচে আকবর আলী নামের একজন পাঠক লিখেছেন, টাকা দিয়ে কিনলে সরকার কর পাবে। এটা অনেকটা জোর করে টাকা আদায়।

আরও পড়ুন: