এভাবে কি আর বিনিয়োগ আসে

যেকোনো বিদেশি বিনিয়োগকারী বাংলাদেশে বিনিয়োগের কথা চিন্তা করলে প্রথমেই বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) ওয়েবসাইটটি ভিজিট করবেন—এটাই স্বাভাবিক। বিডার ওয়েবসাইটে ‘কেন বাংলাদেশ’ নামে যে অধ্যায়টি আছে, সেটিতেও বিনিয়োগকারীরা নজর দেবেন বলে ধরে নেওয়া যায়। কিন্তু এতে সম্ভাব্য বিদেশি বিনিয়োগকারীরা যা দেখতে পাবেন, তার আগে চলুন আমরা একটু দেখে আসি কী আছে ওখানে। সেখানে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) আকার ২৭ হাজার ৪০০ কোটি ডলার, জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ৭ দশমিক ৮৬ শতাংশ, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৩ হাজার ২৯৪ কোটি ডলার এবং মাথাপিছু জিডিপি ১ হাজার ৭৫১ ডলার। কিন্তু এসব তথ্য তো ঠিক তিন বছর আগের।

বর্তমানে দেশের জিডিপির আকার ৩১ হাজার কোটি ডলার, জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ৮ দশমিক ২ শতাংশ, রিজার্ভ ৩ হাজার ৫০০ ডলার এবং মাথাপিছু জিডিপি ২ হাজার ৩২৬ ডলার। অথচ বিডার ওয়েবসাইটে উন্নয়নের এসব হালনাগাদ তথ্য নেই। কেন নেই, জানতে চাইলে সংস্থাটির নির্বাহী চেয়ারম্যান মো. সিরাজুল ইসলাম গত মঙ্গলবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘কোনো কারণে ওয়েবসাইট হালনাগাদ করা হয়নি। তবে হয়ে যাবে।’

এদিকে বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণের মূল সমস্যাগুলো তাহলে কী? এ প্রশ্নের জবাব খুঁজতে গত ২৪ জুন সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের সঙ্গে বৈঠক করে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্য সচিব আহমদ কায়কাউসের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত বৈঠকটির বিষয়বস্তু ছিল ‘বাংলাদেশে বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার বিষয়ে কৌশল নির্ধারণ’। ওই বৈঠকের আলোচনা ও সিদ্ধান্ত সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে একটি বিস্তারিত বিবরণী সংশ্লিষ্ট সব জায়গায় এসেছে গত রোববার।

এতে দেখা যায়, বৈঠকের শুরুতেই প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে প্রশ্ন তোলা হয়, কোভিড-১৯ সংক্রমণের বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে বিশ্বব্যাপী যে বিনিয়োগ স্থানান্তরিত হচ্ছে, তা বাংলাদেশে কেন আসবে না? তবে আলোচনায় ভারত ও ভিয়েতনাম কীভাবে বিনিয়োগ আকৃষ্ট করছে, সে প্রসঙ্গ ওঠেইনি।

দেশি-বিদেশি কোম্পানির করহার

এনবিআরের চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম বৈঠকে জানান, দেশি-বিদেশি উভয় ধরনের কোম্পানির করপোরেট করহারে বৈষম্য না রেখে এক রকম রাখাই বাঞ্ছনীয়। বিদেশি কোম্পানির জন্য মূল্য সংযোজন করে (ভ্যাট) ছাড় দেওয়ারও পক্ষে তিনি। বলেন, সাধারণ নিয়মের বাইরে গিয়ে কেস-টু–কেস সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, কেস-টু-কেস মানেই হলো বৈষম্যমূলক নীতি, যা রাখা উচিত হবে না। এতে বিদেশি বিনিয়োগে বিরূপ প্রভাব পড়বে। আর দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীরাও আশা করেন যে নীতি সবার জন্য একই রকম হবে।

অন্য দেশের প্রণোদনা প্রসঙ্গ

বেজার নির্বাহী চেয়ারম্যান পবন চৌধুরী বলেন, কোভিড-১৯ পরিস্থিতিতে বিভিন্ন দেশ বিভিন্ন প্রণোদনা ঘোষণা করেছে। যেমন থাইল্যান্ড নতুন শিল্প স্থাপনের ক্ষেত্রে ১৩ বছর এবং ইন্দোনেশিয়া নতুন বিনিয়োগের ক্ষেত্রে জমির কোনো ভাড়া না নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে।

বেপজার নির্বাহী চেয়ারম্যান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এস এম সালাহউদ্দিন ইসলাম বলেন, বেজা, বেপজা, বিডা ও বিএইচটিপিএর আওতাধীন শিল্পপ্রতিষ্ঠানের জন্য বৈষম্যহীন সমান সুযোগ ও প্রণোদনার ব্যবস্থা করতে হবে।

ব্যাংকিং প্রক্রিয়া জটিল

আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব মো. আসাদুল ইসলাম বৈঠকে জানান, দেশের অনিবাসী বাংলাদেশি হিসাবধারী বিনিয়োগকারীরা তাঁদের লভ্যাংশ বা মূলধন খুব সহজে ফেরত নিয়ে যেতে পারবেন কি না, তা নিয়ে সন্দিহান থাকেন।

দেশি বিনিয়োগ নিয়েও আলোচনা

বিডার চেয়ারম্যান ক্রেডিট গ্যারান্টি স্কিম বাস্তবায়নের পরামর্শ দিয়ে বলেন, দেশের বেশির ভাগ কর্মসংস্থান যেহেতু এসএমইর মাধ্যমে হয়ে থাকে, ফলে এ খাতকে সহায়তা না দিলে কর্মসংস্থানে বড় সমস্যা হবে। ওয়ান–স্টপ সার্ভিস (এসএসএস) বাস্তবায়নে একটি টাস্কফোর্স গঠন করতে হবে বলেও মত দেন তিনি।

এসএমই খাত নিয়ে গভর্নর ফজলে কবির বলেন, বেকারত্ব রোধে এসএমই বিশাল অবদান রাখছে। সে জন্য তাদের টিকিয়ে রাখতে হবে। এসএমইর জন্য মোট ৩০ হাজার কোটি টাকার প্যাকেজ নিয়ে কাজ চলছে বলে জানান তিনি।

ভাসা–ভাসা সিদ্ধান্ত

বৈঠকে মোট আটটি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। তবে সিদ্ধান্তগুলো দৃঢ় নয়, ভাসা–ভাসা। অর্থাৎ এগুলো বাস্তবায়ন ‘করা হবে’ বা ‘করতে হবে’ অর্থে নেওয়া হয়নি, বরং ‘করা যেতে পারে’, ‘সমীচীন’ এসব দুর্বল অর্থে নেওয়া হয়েছে। দেখা যায়, পাঁচটি সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের দায়িত্বই এনবিআরের। প্রথম সিদ্ধান্ত হচ্ছে করপোরেট কর কমানো হবে না, বরং অঞ্চল নির্দিষ্ট করে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য কর মওকুফ করা যেতে পারে। ভ্যাটের ব্যাপারে সাধারণ নিয়মের বাইরে কিছু কিছু ক্ষেত্রে বিশেষ আদেশ দিয়ে কেস-টু-কেস সমাধান করা যেতে পারে।

পণ্য ও অঞ্চলভিত্তিক প্রণোদনা দেওয়ার ব্যবস্থা নিতে বলা হয় এনবিআর ও বাংলাদেশ ব্যাংককে। এনবিআরকে পিপিপি কর্তৃপক্ষের কর-ভ্যাটের প্রস্তাব নিষ্পত্তি করতে বৈঠক ডাকতে এবং বেপজার প্রস্তাব কার্যকরে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতেও বলা হয়। আরও বলা হয়, প্রণোদনার জন্য বিনিয়োগবান্ধব বিধিবিধান প্রণয়নের বিষয়টি যেন এনবিআর পুনর্বিবেচনা করে। ক্রেডিট গ্যারান্টি স্কিম বাস্তবায়নে বাংলাদেশ ব্যাংক এবং ওএসএস বাস্তবায়ন ও টাস্কফোর্স গঠন করতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়কে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।

সরকারের এক সংস্থার সঙ্গে অন্য সংস্থার চুক্তির ক্ষেত্রে কর অব্যাহতির কোনো কিছু থাকলে চুক্তিনামাটি এনবিআর থেকে ভেটিং করিয়ে নেওয়া সমীচীন হবে—এ কথা বলা হয়েছে বিডা, বেপজা, বেজা, বিএইচটিপিএ ও পিপিপি কর্তৃপক্ষকে। বিদেশি বিনিয়োগ বিষয়ে মাস দুয়েক আগে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি এক বৈঠকে বলেছিলেন,’আলোচনা করছি ঠিক, সবকিছু হয়তো করবও আমরা। কিন্তু মূল ট্রেনটাই ফেল করব।’