আসেন তাস খেলি...

শীর্ষ ধনী দুই বন্ধু ওয়ারেন বাফেট ও বিল গেটস
শীর্ষ ধনী দুই বন্ধু ওয়ারেন বাফেট ও বিল গেটস

জুনের এক দুপুরে তিন বছরের মেয়ে মায়াবী এসে মোবাইল চাইল। বললাম, মোবাইলে করোনাভাইরাস আছে। সে বলল, ‘হাতে স্যানিটাজ (স্যানিটাইজার) দিছি, করোনাভাইরাস মরি গেছে।’ মোবাইল কী করবা জিজ্ঞেস করতেই বলল, ‘সাপলুডু খেলব।’ পাশে থাকা ৯ বছরের পৃথিবী বলল, ‘জানো বাবা মায়াবী মোবাইলে সাপলুডু খেলে মজা পায়।’ বলেই সে মোবাইলটা নিল এবং বোনের সঙ্গে সাপলুডু খেলতে শুরু করল। দেখলাম, মোবাইলে শুধু আঙুলের চাপ দিলেই হয়, ঘুঁটি অটোমেটিক ওঠা–নামা করে। লুডুর ঘুঁটি মই দিয়ে এক লাফে ওপরে উঠলে, আর সাপের মুখে পড়ে নিচে পড়লে তাদের খুশি যেন আর ধরে না। ভাবলাম, বাচ্চারা সেই মার্চ থেকে পুরোপুরি ঘরবন্দী। তাই সাপলুডু খেলেই না হয় ওদের কিছুটা সময় কাটুক।

মোবাইলে বা কম্পিউটার–ল্যাপটপে ইন্টারনেট সংযোগ থাকলে এই করোনাকালে যতটা সম্ভব বাইরে না গিয়ে ঘরে বসেই কত কিছু করে সময় কাটানো যায়। যেমন ধরুন, বাংলাদেশ থেকে ১৩ হাজার ২১৯ কিলোমিটার দূরের দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দুই ধনকুবের বিল গেটস ও ওয়ারেন বাফেট অনলাইনে পরস্পরের সঙ্গে ব্রিজ (একধরনের তাস খেলা) খেলে সময় কাটান, আনন্দ পান, স্বতঃস্ফূর্ত থাকেন। 

বিল গেটস এখন বিশ্বের দ্বিতীয় শীর্ষ ধনী, যাঁর সম্পদের মোটমূল্য ১০ হাজার ৯৯০ কোটি মার্কিন ডলার। ওয়ারেন বাফেট বর্তমানে ৭ হাজার ৮০ কোটি ডলারের সম্পদ নিয়ে বিশ্বের চতুর্থ শীর্ষ ধনী। ৮৯ বছর বয়সী ওয়ারেন বাফেট ও ৬৪ বছরের বিল গেটস শুধু সময় কাটাতেই যে ব্রিজ খেলেন, তা কিন্তু নয়। মনমানসিকতা সতেজ এবং স্বতঃস্ফূর্ত রাখতে তাঁরা ব্রিজ খেলেন। এটি অবশ্য এমন এক খেলা, যেটি জেতার জন্য খেলোয়াড়ের দুর্দান্ত কৌশলগত পরিকল্পনা ও মস্তিষ্কের তীক্ষ্ণ ক্ষমতা বা প্রখর চিন্তাশক্তি থাকা প্রয়োজন।

বিল গেটস ও ওয়ারেন বাফেট নিজেদের ব্যবসায়–বাণিজ্যের কথা ভুলে গেছেন, এমনটা ভাববেন না যেন। কারণ করোনার সময়েও তাঁদের আয় বেড়েছে।

মনে রাখতে হবে, বিল–বাফেট জুটি কিন্তু অন্য অনেকের মতো বাজি ধরে বা সোজা কথায়, জুয়া হিসেবে তাস খেলেন না। তাঁরা এটি খেলেন সময় কাটাতে, আনন্দ পেতে, দীর্ঘ সময় স্বতঃস্ফূর্ত থাকতে ও মস্তিষ্ককে তীক্ষ্ণ বা প্রখর রাখতে। এসব কিন্তু গালগল্প নয়। গবেষণায় মিলেছে এমন তথ্য। দ্য জার্নাল অব আমেরিকান একাডেমি অব নিউরোলজি শীর্ষক প্রকাশনায় স্থান পাওয়া এক গবেষণায় বলা হয়েছে, যাঁরা মানসিকভাবে উদ্দীপনামূলক, অর্থাৎ মানসিকভাবে চাপ পড়ে এমন কাজ করেন তাঁদের স্মৃতি বা স্মরণশক্তি অন্যদের তুলনায় মন্থর হয়, কমে যায়। সে জন্য মানসিকভাবে সতেজ থাকা যায় তেমন কিছু করা উচিত। 

শিক্ষণীয় ব্যাপার হলো, ব্রিজ খেলায় বিল ও বাফেট নাওয়া–খাওয়া ভুলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কিন্তু পার করেন না। খেলার সময় নিয়েও তাঁদের পরিমিতি বোধ আছেন। বাফেট জানান, তিনি প্রতি সপ্তাহে গড়ে আট ঘণ্টার মতো ব্রিজ খেলে থাকেন। এতে তাঁর অনুশীলন বা দক্ষতায় শাণ দেওয়ার কাজটি হয়ে যায়। ফলে বিল গেটসকে পরাজিত করা সহজ হয়ে ওঠে। বাফেট বলেন, ​‘আমি সচরাচর বিল গেটসের সঙ্গে ব্রিজ খেলি, সম্ভবত ১০০ বারও খেলি। এটিই আমার জন্য পৃথিবীর একমাত্র খেলা যেটিতে আমি বিল গেটসে কিছুটা পেছনে ফেলতে মানে হারাতে পারি।’ 

বিল গেটস আর ওয়ারেন বাফেট পরস্পরের দীর্ঘদিনের বন্ধু। বহু বছর ধরেই তাঁরা একে অপরের ব্রিজ খেলার পার্টনার। তবে এই করোনাকালেও তাঁরা মুখোমুখি বসে খেলছেন না। যে যাঁর জায়গায় থেকে অনলাইনে খেলছেন। এ সম্পর্কে বিল গেটস সম্প্রতি তাঁর ব্লগে লিখেছেন, ‘আমরা এখন আর ব্যক্তিগতভাবে একত্র হই না। আমরা যে যাঁর জায়গায় অবস্থান করছি। কিন্তু আমরা এখন অনলাইনে ব্রিজ খেলি।’

করোনাকালে সময় কাটাতে সবাইকে বিল–বাফেটদের মতো ব্রিজ বা তাস কিংবা সাপলুডুই খেলতে হবে, তা কিন্তু নয়। কারণ ইন্টারনেটে ভালো কিছু করে সময় কাটানো বা আনন্দ পাওয়ার জন্য হাজারো সুযোগ–সুবিধা রয়েছে। শুনুন তাহলে বিল গেটস ব্লগে কী লিখেছেন, ‘অনলাইন ফ্ল্যাটফর্মে ব্রিজের মতো বিভিন্ন ধরনের খেলার কত সুবিধা আছে। আমি আর ওয়ারেনও অনলাইনে খেলা করে সময় কাটাই, যেটাকে বলা যায় ব্রিজ বেইস।’

করোনাকালে কেবল ব্রিজ খেলাটা দৈনন্দিন জীবনের অপরিহার্য অংশ হয়ে উঠলেও দেশ–দুনিয়া সম্পর্কে উদাসীন নন বিল ও ওয়ারেন। বিলের মুখেই শুনুন, ​‘কয়েক মাস আগে যখন কাজকর্ম কমতে শুরু করল তখন আমি খুব উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিলাম। কিন্তু কাজকর্ম আবার শুরু হতে দেখে আামি মোটামুটি বিস্মিত এবং এতে স্বস্তি পাচ্ছি।’ করোনার ভ্যাকসিন বা টিকা আবিষ্কারের গবেষণা করার জন্যও তাঁরা বড় অঙ্কের অনুদান দিয়েছেন।

বিল গেটস ও ওয়ারেন বাফেটের মতো বিশ্বসেরা ধনীদের সম্পর্কে লেখক স্টিভ সেইবোল্ড বলেছেন, ‘সফল ব্যক্তিরা সাধারণত বিনোদনের চেয়ে জ্ঞান অর্জনের প্রতিই বেশি আগ্রহী থাকেন।’ এক হাজারের বেশি ধনাঢ্য ব্যক্তির ওপর গবেষণা করে লেখা ​হাউ রিচ পিপল থিঙ্ক (ধনীরা যেভাবে চিন্তা করেন) শীর্ষক গ্রন্থে স্টিভ সেইবোল্ড বলেন, ধনীরা বিনোদন পছন্দ করেন, আর জ্ঞান অর্জন করতে ভালোবাসেন। এ ধরনের ব্যক্তিরা নিজেদের গোটা জীবনটাই কাটিয়ে দেন তথ্য-জ্ঞানের খোঁজে, যা কাজে লাগিয়ে তাঁরা প্রতিদিনই আরও ধনী হয়ে ওঠেন। সূত্র: সিএনবিসি