সিঙ্গাপুরের শ্রমিক থেকে উদ্যোক্তা শরিফুল

নিজের প্রতিষ্ঠানে কাজ করছেন মোহাম্মদ শরিফুল আলম। ছবি: সংগৃহীত
নিজের প্রতিষ্ঠানে কাজ করছেন মোহাম্মদ শরিফুল আলম। ছবি: সংগৃহীত

সিঙ্গাপুরের বিখ্যাত মেরিনা বে স্যান্ডের একজন নির্মাণকর্মী ছিলেন মোহাম্মদ শরিফুল আলম। কাজ করেছেন চাঙ্গি এয়ারপোর্টের টার্মিনাল-৩–এর শ্রমিক হিসেবেও। এখন মেরিনা বে স্যান্ড বা টার্মিনাল-৩–এর মতোই সিঙ্গাপুরে তিনি মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি সিঙ্গাপুরে একজন উদ্যোক্তা, সিঙ্গাপুরে নির্মাণ প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি পোল্যান্ডেও আছে তাঁর রেস্তোরাঁ ব্যবসা। সব মিলিয়ে কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিত শরিফুলের ১৫ বছরের জীবন একটি গল্পই বটে।

শরিফুলের ইচ্ছা ছিল কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে কাজ করবেন। ২০০৫ সালে ভর্তিও হয়েছিলেন ডেন্টাল টেকনোলজি কলেজে। সে পড়ায় তাঁর মন বসেনি। এক বছরেই ছেড়ে এসেছিলেন। এর মধ্যে এক বছর কেটেছে ব্যবসা করার চেষ্টায়। কিন্তু তাঁর লক্ষ্য আরও বড় ছিল, তিনি আরও বড় কিছু হতে চেয়েছিলেন। তাই এক মামার পরামর্শে চলে যান সিঙ্গাপুর। স্বপ্ন ভঙ্গ হয় দ্রুতই। ১৬ মাস প্রতিদিন দিনরাত পালাক্রমে ১২ ঘণ্টা নির্মাণশ্রমিকের কাজ করে ইস্তফা দেন তিনি। শরিফুল বলেন, ‘তখন অদক্ষ শ্রমিক ছিলাম, না ভালো কাজ পেতাম, না ভালো পারিশ্রমিক। এমনকি ব্যবহারটাও ভালো হতো না। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সঙ্গে বিরোধে ছেড়ে আসি চাকরি।’

চাকরি ছাড়ার পর দেশে ফিরে আসা। আবার ব্যবসার চেষ্টা, কিন্তু সিঙ্গাপুরের অসমাপ্ত অধ্যায় শেষ করার বেশ তাড়না অনুভব করেন শরিফুল। ‘আমার কেন যেন মনে হচ্ছিল, আমার ভাগ্যের বদল সেখানেই হতে পারে,’ বলেন সহাস্যে। ‘২০০৯ সালে আবার যখন সিঙ্গাপুরে ফেরত যাই, সময়টা খুব কঠিন ছিল। যাওয়ার খরচটা চড়া সুদে ধার করে গিয়েছিলাম। স্টোরম্যানের চাকরি, বেতন মাত্র ৫২০ ডলার। ওভারটাইম করব, সে উপায়ও নেই। এই টাকায় খেয়ে–পরে টিকে আবার সুদ পরিশোধ করতে হতো। বাড়িতেও তখন অর্থসংকট, মনে হতো এ অথই সাগরের শেষ কোথায়?’ এভাবেই কঠিন দিনগুলোর স্মৃতিচারণা করেন শরিফুল।

স্বজন-বান্ধবহীন জীবনে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম হয়ে ওঠে শ্বাস নেওয়ার জায়গা। মনের কথা বলার জন্য জীবনে যোগ হয় দুজন মানুষ, প্রথম আলোর যুব কার্যক্রমের তৎকালীন সমন্বয়ক মুনির হাসান ও বাংলাদেশ ওপেন সোর্স নেটওয়ার্কের সাজ্জাত হোসাইন। এরপর শরিফুল শুরু করেন কারিগরি বিষয়ে পড়াশোনা। ২০১২ সালে নিজের চেষ্টায় সেফটি কো-অর্ডিনেটর কোর্স শেষ করেন তিনি। ভাগ্যই বলতে হবে, কোম্পানিতে তখন এই পদেই লোক দরকার ছিল। তক্ষুনি চাকরি হয় যায় তাঁর।

জীবনে উন্নতির ফলে কাজের প্রতি ভালোবাসাও শুরু হয় শরিফুলের। সেই পরিশ্রমে পদোন্নতি হয় সেফটি ডিপার্টমেন্টের হেড হিসেবে। কিন্তু সেই পদ পেতে হলে থাকতে হবে সার্টিফিকেট। আবার পড়াশোনা শুরু করেন তিনি। সিঙ্গাপুরের পিএসবি একাডেমিতে ২ বছরের ইলেকট্রিক্যাল ডিপ্লোমা শেষ হতে হতে তিনি হয়ে যান প্রজেক্ট কো-অর্ডিনেটর। কিন্তু আবারও সার্টিফিকেটের চেয়ে পদ বড় হয়ে যাচ্ছিল, তত দিনে শরিফুল কোম্পানির সব কাজের কাজি। একা হাতেই প্রজেক্ট দেখাশোনা, লাভ–ক্ষতির হিসাব করা, ড্রাফটিং—সবই করতেন। এমন কাজের লোক আর কে হাতছাড়া করে? কোম্পানিই তাঁকে খরচ দিল ইউনিভার্সিটি অব নিউ ক্যাসেলের সিঙ্গাপুর শাখায় কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তাবিষয়ক বিএসসি কোর্স করতে।

একদিকে পড়াশোনা, অন্যদিকে তিনটা আলাদা ধরনের কাজ, হিমশিম খাওয়ার বদলে অথই সাগরের দক্ষ নাবিক হয়ে উঠলেন শরিফুল। এই ‘অতিরিক্ত কাজই’ গড়ে দিল উদ্যোক্তা তাঁকে। ২০১৮ সালে দীর্ঘ ১০ বছরের চাকরিজীবনের ইতি টেনে তিনি হয়ে গেলেন পুরাদস্তুর ব্যবসায়ী। ২০১৭ থেকে তিনি কাজ শুরু করেছিলেন নিজের কোম্পানি নিসা ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের। ছোট্ট কনস্ট্রাকশন কোম্পানি ২০১৯ নাগাদ মাত্র তিনজন কর্মচারী। তাঁদের বেতন হয় না, বোনাস হয় না, তবু তাঁরা তাঁকে বিশ্বাস করে টিকে থাকেন। তিন বছরের অক্লান্ত পরিশ্রমে তাঁর কোম্পানিতে এখন কাজ করেন ৩৫ বাংলাদেশি, ৩ ভারতীয় ও ৭ সিঙ্গাপুরের নাগরিক। ছোট ছোট করতে করতেও তাঁরা কাজ করে ফেলেছেন মাইক্রোসফট, গুগল, মাইক্রন, রেডমার্ট ও অ্যাপলের মতো কোম্পানির সঙ্গে।

জয় করতে করতে সাম্রাজ্য বিস্তারের আনন্দ পেয়ে বসেছে শরিফুলকে। সম্প্রতি তিনি পোল্যান্ডে রেস্টুরেন্টের ব্যবসাও শুরু করেছেন। সেখানে ভর্তি হয়েছেন মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়েও। কোম্পানির বড় কর্তা বলে কথা, জ্ঞান তো সবদিকেই থাকা চাই। কোভিডের আগ্রাসনের আগ পর্যন্ত মাসের অর্ধেক সিঙ্গাপুর আর বাকি অর্ধেক পোল্যান্ড থাকতেন তিনি। এখন যদিও কিছুটা থমকে গেছেন, তবে এটা শুধুই একটি বিরাম, যতি নয়। কোভিডের প্রকোপ কমায় আবার শাণিত হয়ে উঠছেন তিনি দলবল নিয়ে। পাশাপাশি মন দিয়ে অনলাইনে পড়াশোনা করছেন এখন। অপেক্ষা করছেন কবে আবার ঝাঁপিয়ে পড়া যাবে সব শক্তি নিয়ে।

সিঙ্গাপুরে শরিফুল খুব জনপ্রিয় ‘বনের মোষ তাড়ানো রাখাল’ হিসেবে। তিনি দেশে থাকা দক্ষ শ্রমশক্তিকে যুক্ত করেন সিঙ্গাপুরের কর্মবাজারে। এভাবেই সিঙ্গাপুরের মেরিনা বে স্যান্ডের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সিঙ্গাপুরে দাঁড়িয়ে গেছেন তিনি। বাংলাদেশের শরিফুল।