করোনার ধাক্কায় দেউলিয়া যারা

২০০৮ সালের অর্থনৈতিক মন্দার অন্যতম বলি হয় লেহম্যান ব্রাদার্স। সে সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চতুর্থ বৃহৎ বিনিয়োগকারী ব্যাংক ছিল তারা। ১৫৮ বছরের পুরোনো ওই ব্যাংকে তখন ২৫ হাজারের বেশি কর্মী ছিল। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং ১৯৩০-এর মহামন্দার ঝড় সামাল দিলেও ২০০৮ সালের মন্দায় আর দাঁড়াতে পারেনি প্রতিষ্ঠানটি। দেউলিয়া হয়ে যায়। শুধু এটি নয়, ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকার শত শত ব্যাংক–প্রতিষ্ঠান ওই মন্দায় বন্ধ হয়ে যায়। এমন ১৪টি অর্থনৈতিক মন্দা দেখেছে বিশ্ব। এই মন্দায় সর্বশেষ যুক্ত হলো করোনা মহামারি থেকে সৃষ্ট অর্থনৈতিক সংকট, যা এখনো চলছে, এর শেষ কবে অজানা বিশ্বের। 

আইনি সেবাবিষয়ক জায়ান্ট মার্কিন কোম্পানি ইপিআইকিউর তথ্যমতে, ২০২০ সালের প্রথমার্ধে (জুন পর্যন্ত) ৩ হাজার ৬০০টিরও বেশি মার্কিন বাণিজ্যিক কোম্পানি চ্যাপ্টার ১১–এর অধীনে দেউলিয়ার ঘোষণার জন্য আবেদন করেছে। যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ২৬ শতাংশ বেশি। এর মধ্যে ৬০০–এর বেশি আবেদন পড়েছে কেবল জুনে। যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ৪৩ শতাংশ বেশি। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন অবস্থা কেবল খারাপই হচ্ছে। দেউলিয়াত্ব নিয়ে কাজ করা নিউ জেনারেশন রিসার্চের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা জেমস হ্যামন্ড বলেন, ‘আমরা দেউলিয়া হওয়ার ঢেউ দেখছি, যা নজিরবিহীন। এই বছর দেউলিয়া হওয়ার পরিমাণ ইতিমধ্যে ২০০৮ সালের মন্দাকে ছাড়িয়ে গেছে।’ 

জেড-স্কোর একটি আর্থিক পরিসংখ্যান, যা দেউলিয়া সম্ভাবনা পরিমাপ করে। এটি তৈরি করেন নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক এডওয়ার্ড আই অল্টম্যান। তিনিও একই রকম মনে করছেন। তাঁর মতে, এ বছর মেগা কোম্পানিগুলো দেউলিয়ার আবেদনে রেকর্ড করবে। এসব কোম্পানির বেশির ভাগেরই ঋণের পরিমাণ শতকোটি ডলার ছাড়িয়েছে। এ ছাড়া লাখ ডলারের কোম্পানিগুলোর দেউলিয়া হওয়ার সংখ্যা ২০০৮ সালের সংকটকে ছাপিয়ে যাবে বলে মনে করছেন তিনি। 

ছয়টা মাস পার হয়েছে এই বছরের। ২০২০ সংখ্যার দিক দিয়ে যেমন অনন্য, তেমনি ইতিহাসে আলাদা করে স্মরণীয় হয়ে থাকবে এ বছরটি। করোনাভাইরাস নামক মহামারির প্রভাব পৌঁছেছে বিশ্বের সব প্রান্তে। এমনটা এর আগে আর দেখেনি বিশ্ব। ঝাপটা সামলানো তাই কঠিন হয়ে পড়ছে। ভাইরাস প্রতিরোধে দুয়ার বন্ধের সিদ্ধান্ত নেয় বিশ্বের প্রায় সব দেশ। ফলে ভেঙে পড়ছে অর্থনীতি। একের পর এক দেউলিয়া হওয়ার আবেদন করছে বড় বড় কোম্পানি। কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান যখন পাওনাদার, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বা ব্যাংকের ঋণ পরিশোধে অক্ষম হয় তখন ওই ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে দেউলিয়া হিসেবে গণ্য করা হয়। সাধারণত আইনসংগতভাবে আদালত একজন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে দেউলিয়া বলে ঘোষণা করতে পারে। 

দেউলিয়া আবেদনে একের পর এক মার্কিন কোম্পানি
লকডাউন পদক্ষেপের কারণে জ্বালানি তেলের চাহিদা কমে যায় ব্যাপক। তেলের দাম তলানিতে গিয়ে ঠেকে। এর সঙ্গে জড়িত কোম্পানিগুলো ত্রাহি পরিস্থিতিতে পড়ে। এপ্রিলে ডায়মন্ড অফশোর ড্রিলিং, হোয়াইটিং পেট্রোলিয়াম, আলট্রা পেট্রোলিয়াম ফিল্ড যুক্তরাষ্ট্রের আদালতের নিজেদের দেউলিয়া ঘোষণার আবেদন জানায়। যদিও তারা এও জানায় একেবারে বিদায় নিচ্ছে না তারা। পরিস্থিতির ভালো হলে আবার ব্যবসায় ফিরবে। 

মে মাসের শুরুতে যেন মার্কিন অর্থনীতিতে রক্তক্ষরণ সবচেয়ে বেশি হয়েছে। করোনার মারাত্মক প্রভাব পড়তে শুরু করে বড় প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর। বিলাসবহুল ডিপার্টমেন্ট স্টোর জে ক্রু দেউলিয়া সুরক্ষার আবেদন করে। দ্য টাইম ম্যাগাজিন জে ক্রুর এই পতনকে খুচরা ব্যবসার ক্ষেত্রে করোনাভাইরাসের ‘প্রথম বড় দুর্ঘটনা’ বলে অভিহিত করেছে। অনলাইন বেচাকেনা জনপ্রিয় হয়ে ওঠায় কোভিড-১৯–এর ধাক্কা লাগার আগে থেকেই অবশ্য এই কোম্পানি অস্তিত্বসংকটে ভুগছিল। মহামারি তা যেন আরও ত্বরান্বিত করল। 

আমেরিকাজুড়ে সাত শতাধিক জিমের মালিক ও পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান গোল্ডস জিম। একসময় বিশ্বের সবচেয়ে বড় শরীরচর্চা কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত ছিল। মে মাসে দেউলিয়া ঘোষণার আগে এপ্রিলে বিশ্বব্যাপী তাদের ৩০টি চেইন কোম্পানি বন্ধ করে দেয় তারা। শত বছরের পুরোনো ডিজাইনারস ক্লদিং, হ্যান্ডব্যাগ, শু এবং বিউটি পণ্যের জন্য বিখ্যাত মার্কিন ডিপার্টমেন্ট স্টোর নাইম্যান মার্কাস কয়েক বছর ধরেই দীর্ঘস্থায়ী ঋণের বোঝায় জর্জরিত ছিল। তবে করোনার কারণে এ পরিস্থিতি থেকে আর উত্তরণ ঘটানো সম্ভব হলো না কোম্পানিটির। শেষ পেরেক বসল, এর ৪৩টি স্টোরই অস্থায়ীভাবে বন্ধ হয়ে গেছে। মে মাসের শুরুতে দেউলিয়া সুরক্ষার আবেদন করে কোম্পানিটি। 

মে মাসের মাঝামাঝি আরেকটি বড় ধাক্কা। ১১৮ বছরের পুরোনো মার্কিন চেইন ডিপার্টমেন্ট স্টোর জেসি পেনি নিজেদের চ্যাপ্টার ১১-এর অধীনে দেউলিয়া ঘোষণার জন্য আবেদন করে। জেসি পেনি যুক্তরাষ্ট্রে ৮৫০টির বেশি স্থানে পোশাক, প্রসাধনসামগ্রী ও গয়না বিক্রি করে। প্রায় ৮০ হাজার কর্মী কাজ করেন এই কোম্পানিতে। করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত খাতগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো পর্যটন খাত। আমেরিকার গাড়ি ভাড়া দেওয়া বিখ্যাত প্রতিষ্ঠান হার্তজ। মে মাসে প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী বিদায় নিয়েছেন, সেই সঙ্গে দেউলিয়া ঘোষণার আবেদন করেছে তাঁরা। উত্তর আমেরিকাজুড়ে ছাঁটাই করা হয়েছে ১০ হাজার কর্মীকেও।

জুনে দেউলিয়া হওয়ার আবেদন করেছে চাকি ই চিজের মূল সংস্থা, জিএনসি, টোয়েন্টি ফোর ফিটনেস। জুলাইতে দেউলিয়া ঘোষণার আবেদন জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ২০০ বছরের পুরোনো পোশাক ব্র্যান্ড ব্রুকস ব্রাদার্স। পুরুষদের জন্য পোশাক বিশেষ করে স্যুট তৈরির জন্য বিখ্যাত কোম্পানিটি ঋণে জর্জরিত হয়ে পড়েছিল। এ ছাড়া ফ্লোরিডায় ব্যবসা পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান অ্যাপেক্স পার্কস, ব্রাভো ও ব্রায়ো রেস্টুরেন্ট চেইনের প্যারেন্ট কোম্পানি ফুডফার্স্ট গ্লোবাল হোল্ডিংস, কাপড়ের ব্র্যান্ড ট্রু রিলিজিয়ন অ্যাপারেল, চেইন মুভি থিয়েটার সিএমএক্স সিনেমাস, রুবিস কস্টিউম কোম্পানি, খেলার পণ্য তৈরির কোম্পানি অলিম্পিয়া স্পোর্টস দেউলিয়ার ঘোষণার আবেদন করেছে গত দুই মাসে। 

সারা বিশ্বেই দেউলিয়ার খবর
কেবল যুক্তরাষ্ট্র নয়, করোনার কোপে দিশেহারা বিশ্বের বহু কোম্পানি। করোনা কেড়ে নিচ্ছে অনেক কোম্পানির প্রতিপত্তি। ঋণের সাগরে ডুবে বিখ্যাত সব কোম্পানি ঝুঁকছে। জার্মানির বিমান প্রতিষ্ঠান লুফথানসা সরকারের কাছ থেকে ৯০০ কোটি ইউরোর সহায়তা তহবিল নিয়েছে। ভার্জিন অস্ট্রেলিয়া কোনোরকমে টিকে আছে ‘ভলান্টারি অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের’ অধীনে বৃহৎ স্প্যানিশ ফ্যাশন গ্রুপ ইন্ডিটেক্সের কোম্পানি জারা। স্প্যানিশ ধনকুবের ও বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ ধনী অ্যামানসিও ওর্তেগার এই কোম্পানি বিশ্বব্যাপী ১ হাজার ২০০ স্টোর বন্ধ করে দিয়েছে। ৪ হাজার ৯৯১টি স্টোর বন্ধ করে দিয়েছে চীনের পোশাক কোম্পানি লা চ্যাপেল। প্যারিসের ফ্যাশন ব্র্যান্ড শ্যানেল ও ঘড়ির জন্য সুইজারল্যান্ডের বিশ্বখ্যাত ব্র্যান্ড পাটেক ফিলিপ উৎপাদন বন্ধ করে দিয়েছে। উৎপাদন বন্ধ রেখেছে যুক্তরাজ্যের রোলেক্সও। অস্ট্রেলিয়ার অন্যতম বড় ডিপার্টমেন্ট স্টোর কে মার্ট ব্যবসায়িক ময়দান ছেড়েছে। বিশ্বের বিলাসবহুল শিল্প একরকম চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে পড়েছে। প্রায় ২৩ বিলিয়ন ডলার ঋণের বোঝা নিয়ে চলছে নাইকি। এয়ারবিএনবির প্রতিষ্ঠাতা বলেছেন যে মহামারির কারণে, তাদের ১২ বছরের প্রচেষ্টা ৬ সপ্তাহের মধ্যে ধ্বংস হয়ে গেছে। স্টারবাকস তার ৪০০ স্টোর একেবারে বন্ধ করে দিয়েছে। এমনকি এই মহামারি ওয়ারেন বাফেটকেও শীর্ষ ধনীর তালিকা থেকে নিচে নামিয়ে দিচ্ছে। 

যুক্তরাজ্যে এক জরিপে দেখা গেছে চলতি বছর প্রতি দশটি দাতব্য প্রতিষ্ঠানের একটির কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যেতে পারে। কারণ, তাদের সেবার চাহিদা দ্বিগুণ বাড়লেও তহবিল আগের চেয়ে অনেক কমে গেছে। দেউলিয়ার বাতাস লেগেছে খেলার জগতেও। মাঠে দর্শক নেই, ক্লাব, কর্তৃপক্ষ আর বিভিন্ন কোম্পানি বঞ্চিত হচ্ছে টিকিট আর বিজ্ঞাপনের টাকা থেকে। জার্মানির পেশাদার ফুটবল দল কাইজার্সলাউটার্ন দেউলিয়া হয়ে যাওয়ার আবেদন করেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন এই তালিকা সামনের দিনে ক্রমশ লম্বা হবে। 

চলতি বছরের প্রথমার্ধে জাপানে দেউলিয়াত্বের হার গত ১১ বছরের মধ্যে প্রথম বেড়েছে। দেশটির অন্যতম গবেষণা সংস্থা টোকিও শকো রিসার্চ বলছে, বছরের প্রথম ছয় মাসে জাপানে ৪ হাজার ১টি কোম্পানি দেউলিয়াত্বের জন্য আবেদন করেছে, যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে শূন্য দশমিক ২ শতাংশ বেশি। এর মধ্যে করোনাভাইরাস মহামারির কারণে ২৪০টি কোম্পানি দেউলিয়া হয়েছে। 

অন্যদিকে ভারতে সংস্থাগুলোকে দেউলিয়া হওয়া থেকে বাঁচাতে বিশেষ আদেশ বা অধ্যাদেশ এনেছে সরকার। ঋণের টাকা না মেটাতে পারলেও এক বছরের জন্য কোনো সংস্থাকে দেউলিয়া ঘোষণা করবে না কেন্দ্রীয় সরকার বলে জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমণ। মে মাসে দেউলিয়া আইন, ২০১৬-তে ওই নতুন ধারা যোগ হয়। এর ফলে আগামী ছয় মাস দেউলিয়া কার্যক্রম স্থগিত থাকবে। 

কোম্পানির জন্য দেউলিয়াই কি শেষ 
অনেক ক্ষেত্রে দেউলিয়া হয়ে যাওয়া কোম্পানি বা ব্যক্তি নতুন প্রস্তুতি নিয়ে আরও শক্তিশালী রূপে ফিরে আসতে পারে। ইতিহাসে এমন ঘটনার নজিরও কম নয়। হেনরি ফোর্ড তাঁর কোম্পানি শুরুর আগে দেউলিয়া হয়ে গিয়েছিলেন। ২০০৮ সালের অর্থনৈতিক মন্দায় জেনারেল মোটরস, ক্রাইসলারের মতো কোম্পানিও দেউলিয়াত্বের আবেদন করেছিল। তবে তারা ফিরে আসে। এমনকি আর্থিক সংকটে পড়ে দেউলিয়া হওয়ার মুখে ছিল অ্যাপলও। ১৯৯৭ সালের আগস্টে প্রায় দেউলিয়া হওয়ার দ্বারপ্রান্তে থাকা অ্যাপলের দিকে সে সময় হাত বাড়িয়ে দেন মাইক্রোসফটের বিল গেটস। তাই বলা যায় করোনাভাইরাস পরিস্থিতি শান্ত হলে হয়তো ভালো খবরও আসতে পারে। ২০২০ সাল হলো করপোরেট শক্তি এবং ব্যবসায়িক সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার বড় চ্যালেঞ্জের বছর। দেখা যাক কীভাবে তা সামাল দিতে পারে কোম্পানিগুলো।