সম্ভাবনার পাঁচ খাতে দরকার বাড়তি উদ্যোগ

>

সব হিসাব ওলট–পালট করে দিয়েছে করোনাভাইরাস। দেশ ও বিদেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় ছাড়া অন্য সব পণ্যের চাহিদা কমে গেছে। স্বাভাবিকভাবেই শিল্পকারখানার উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। রপ্তানি আয়ও কমে গেছে। কর্মী ছাঁটাইয়ের মতো ঘটনা বাড়ছে। আর্থিক সংকটে পড়ে কারখানাও বন্ধ হচ্ছে। 

ক্রয়াদেশ বাতিল ও স্থগিতাদেশে করোনার শুরুতে বিপর্যস্ত হয়েছে পোশাক রপ্তানি। বর্তমানে বেশ কিছুটা ঘুরে দাঁড়ালেও গতবারের চেয়ে রপ্তানি ক্রয়াদেশ ২০-৩০ শতাংশ কম। চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের রপ্তানি কমে গেছে সাড়ে ২১ শতাংশ। আর্থিক সংকটে কোরবানির চামড়া কেনা নিয়ে সংকটে আছেন ট্যানারির মালিকেরা। পাট ও পাটজাত পণ্যের রপ্তানি বাড়লেও সরকারি ২৬টি পাটকল বন্ধ করে দিয়েছে সরকার। ফলে পাটের ন্যায্যমূল্য পাওয়া নিয়ে পাটচাষিদের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ার শঙ্কা রয়েছে। ওষুধ রপ্তানি বাড়লেও বড় আকারে বাজার ধরা যায়নি। দীর্ঘদিন ধরে সম্ভাবনা দেখালেও হালকা প্রকৌশলশিল্পেও বড় অর্জন নেই। বছরখানেক আগে আশার আলো দেখানো কৃষি প্রক্রিয়াজাত পণ্যের রপ্তানিও ছোটখাটো ধাক্কা খেয়েছে মহামারি এই ভাইরাসে। 

বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে বড় হাতিয়ার পণ্য রপ্তানি। তবে করোনায় তা অনেকটাই টালমাটাল। বিদায়ী অর্থবছরেই রপ্তানি ৬৮৬ কোটি ডলারের কমে গেছে। কঠিন এই সময়ে শীর্ষ রপ্তানি আয়ের খাতকে আগের জায়গা নিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি সম্ভাবনাময় খাতগুলোকে চাঙা করা যায় কীভাবে, তা খুঁজে দেখতে আজকের আয়োজন। লিখেছেন শুভংকর কর্মকার

সস্তা শ্রমের কারণে বিদেশি ক্রেতাদের কাছে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক এখনো আকর্ষণীয়। নারায়ণগঞ্জের একটি পোশাক কারখানায় কাজ করছেন নারী শ্রমিকেরা। প্রথম আলোর ফাইল ছবি
সস্তা শ্রমের কারণে বিদেশি ক্রেতাদের কাছে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক এখনো আকর্ষণীয়। নারায়ণগঞ্জের একটি পোশাক কারখানায় কাজ করছেন নারী শ্রমিকেরা। প্রথম আলোর ফাইল ছবি

পোশাকশিল্পের ঘুরে দাঁড়ানোর গল্পে আত্মতৃপ্তির সুযোগ নেই 
করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়লে সংক্রমণ রোধে লকডাউন জারি করে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের অনেক দেশ। দোকানপাট বন্ধ হয়ে যায়। তাতে গত মার্চে একের পর এক ক্রয়াদেশ বাতিল ও স্থগিতাদেশ আসতে থাকে। সব মিলিয়ে ৩১৮ কোটি ডলারের ক্রয়াদেশ বাতিল ও স্থগিত হয়। এপ্রিলে মাত্র ৩৭ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়। পরের মাসে তা ১২৩ কোটি ডলারে গিয়ে দাঁড়ায়। 

অবশ্য দুই মাসের ব্যবধানে পোশাক রপ্তানি বেশ খানিকটা ঘুরে দাঁড়ায়। জুনে ২২৫ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়। চলতি মাসের প্রথম ১২ দিনে ৯৮ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়েছে। উদ্যোক্তারা বলছেন, গতবারের তুলনায় বর্তমানে ৭০-৮০ শতাংশ ক্রয়াদেশ আসছে। অনেক বড় ব্র্যান্ড স্থগিত ও বাতিল হওয়া পণ্য নিতে শুরু করায় পোশাক রপ্তানি জুন থেকে ঘুরে দাঁড়িয়েছে। 

মার্চে পোশাকের ক্রয়াদেশ বাতিল ও স্থগিত হওয়ায় মালিকেরা আতঙ্কিত হয়ে পড়লে সরকার রপ্তানিমুখী শ্রমিকদের মজুরি দেওয়ার জন্য পাঁচ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করে। সেই তহবিল থেকে প্রায় ১ হাজার ৮০০ কারখানার মালিক ২ শতাংশ সার্ভিস চার্জে ঋণ নিয়ে তিন মাসের মজুরি দিয়েছেন। তা ছাড়া চলতি অর্থবছরের বাজেটে পোশাক রপ্তানিতে বাড়তি ১ শতাংশ প্রণোদনা ও প্রতিষ্ঠানের করপোরেট কর আগের মতোই রেখেছেন অর্থমন্ত্রী। যদিও উৎসে কর দশমিক ২৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে দশমিক ৫০ শতাংশ করা হয়েছে। 

পোশাকের বৈশ্বিক বাজারে বাংলাদেশের হিস্যা বাড়াতে ঢাকা চেম্বার গত সপ্তাহে তাদের এক প্রতিবেদনে বলেছে, বাংলাদেশি তৈরি পোশাকের ব্র্যান্ডিংয়ের জন্য নিজস্ব ব্র্যান্ড করতে হবে। পণ্যবৈচিত্র্য বাড়াতে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা লাগবে। বেশি মূল্য সংযোজিত হয়, এমন পণ্যে নগদ সহায়তা দিতে হবে। সে ক্ষেত্রে স্যুটের মতো ভ্যালু অ্যাডেড পোশাক ও ব্যক্তিগত সুরক্ষাসামগ্রী (পিপিই) রপ্তানি ও উন্নতমানের কাপড় উৎপাদনে ১-২ শতাংশ নগদ সহায়তা দেওয়া যায়। 

মেশিনে কাজ করছেন নারী পোশাকশ্রমিক
মেশিনে কাজ করছেন নারী পোশাকশ্রমিক

জানতে চাইলে চট্টগ্রামের ডেনিম এক্সপার্ট লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোস্তাফিজ উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘বর্তমানে আমরা অনেকে একেকটি নকশার ১ থেকে ২ লাখ পিস পোশাকের ক্রয়াদেশ পাই। ভবিষ্যতে এই পরিমাণে ক্রয়াদেশ মিলবে না। সে জন্য ছোট পরিমাণের ক্রয়াদেশ করার মানসিক প্রস্তুতি নিতে হবে। দ্রুত পণ্য পাঠানোর দিকে আমাদের অবশ্যই এগোতে হবে। কারণ, চার-পাঁচ মাস আগে অর্থ লগ্নি করার চিন্তাভাবনা থেকে ক্রেতারা সরে আসতে শুরু করেছেন।’ 

মোস্তাফিজ উদ্দিন আরও বলেন, ‘বর্তমানে ক্রেতারা চুক্তি ভঙ্গ করলে অনেক ক্ষেত্রেই আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ কম থাকে। তাই আমাদের পেমেন্ট টার্মসে পরিবর্তন আনতে হবে। সেই চুক্তির শর্তাবলি সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তর থেকে নির্দিষ্ট করা দরকার। কারখানাগুলোর জন্য বিমাসুবিধাও প্রয়োজন। প্রতিটি ক্রেতা প্রতিষ্ঠানকে সরকার বা বিজিএমইএ বা বিকেএমইএ থেকে ব্যবসা করার ছাড়পত্র নেওয়া বাধ্যতামূলক করা প্রয়োজন। কারণ, সস্তা পোশাক কিনতে বিশ্বের ছোটখাটো অনেক ক্রেতা বাংলাদেশে আসেন। তাঁদের আর্থিক সক্ষমতা যাচাই–বাছাই করে ছাড়পত্র দেওয়া দরকার।’ 

উৎপাদনশীল বৃদ্ধি ও পণ্যে বৈচিত্র্য আনাই আগামী দিনে টিকে থাকার মূল অস্ত্র হবে মনে করেন এইচঅ্যান্ডএমের বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও ইথিওপিয়ার প্রধান জিয়াউর রহমান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানির ৭২ শতাংশ আসে মাত্র পাঁচ ধরনের পণ্যে। এই জায়গায় অবশ্যই পরিবর্তন আনতে হবে। 

সরকারি পাটকল ডুবলেও মুনাফা করছে বেসরকারি খাতের পাটকল। তেমনই এক পাটকলে পাটের বস্তা উৎপাদন তদারকি করছেন দুই শ্রমিক
সরকারি পাটকল ডুবলেও মুনাফা করছে বেসরকারি খাতের পাটকল। তেমনই এক পাটকলে পাটের বস্তা উৎপাদন তদারকি করছেন দুই শ্রমিক

পরিকল্পনায় সুদিন ফিরবে পাটপণ্যে
সরকারি পাটকল বন্ধ হওয়ায় মাসখানেক ধরে পাট খাত বেশ আলোচনার মধ্যে রয়েছে। অধিকাংশ বেসরকারি পাটকল যখন লাভের মুখ দেখছে, সেখানে বছরের পর বছর ধরে লোকসানে ডুবছিল সরকারি পাটকল। লোকসানের বোঝা বইতে না পেরে এক যুগের চেষ্টার ইতি টেনেছে সরকার। সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্বে পাটকলগুলো চালানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। 

বিদায়ী ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৮৮ কোটি ডলারের পাট ও পাটজাত পণ্যের রপ্তানির মধ্যে পাটসুতার অবদান ৫৬ কোটি ডলার। আগের বছরের তুলনায় রপ্তানি বেড়েছে ১০ দশমিক ১২ শতাংশ। তা ছাড়া ১২ কোটি ডলারের কাঁচা পাট রপ্তানি হয়েছে। এ ক্ষেত্রে প্রবৃদ্ধি হয়েছে সাড়ে ১৫ শতাংশের কাছাকাছি। আর পাটের ব্যাগ রপ্তানি আয় ১০ কোটি ডলারের। ২০১৮-১৯ অর্থবছরের চেয়ে পাটের ব্যাগের রপ্তানি আয় বেড়েছে সাড়ে ২৮ শতাংশ। 

পণ্যবৈচিত্র্য না থাকায় পাটপণ্যের রপ্তানি আশানুরূপ বাড়ছে না বলে মনে করে ঢাকা চেম্বার। তারা বলছে, বহুমুখী পাটপণ্য উৎপাদনে বিনিয়োগ দরকার। পাট মন্ত্রণালয় পাটের কাগজ তৈরি করার পাইলট প্রকল্প নিতে পারে। সরকারি দপ্তরে পাটের কাগজ ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা প্রয়োজন। তৈরি পোশাকের মতো করসুবিধা পাট খাতকে দেওয়া যেতে পারে। সেই সঙ্গে পাঁচ বছরের জন্য ভ্যাট অব্যাহতি। 

 অবশ্য পাট খাতের জন্য সরকারের তরফ থেকে সহযোগিতা রয়েছে। বর্তমানে বহুমুখী পাটপণ্য রপ্তানিতে ২০ শতাংশ নগদ সহায়তা দিয়ে থাকে সরকার। পাটের বস্তা ও কার্পেটের নিচে ব্যবহারের জন্য পাটের তৈরি কাপড় রপ্তানিতে নগদ সহায়তার পরিমাণ ১২ শতাংশ। আর পাটসুতা রপ্তানি করলে ৭ শতাংশ নগদ সহায়তা পান উদ্যোক্তারা। 

উদ্যোক্তারা বলছেন, বিশ্বব্যাপী পলিথিন ব্যবহারের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিচ্ছে বিভিন্ন দেশ। ইউরোপীয় ইউনিয়নে (ইইউ) পলিব্যাগ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তাতে কেবল ইইউর দেশগুলোতে বার্ষিক প্রায় ৪ হাজার ৮০০ কোটি পাটের ব্যাগের চাহিদা সৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে। তা ছাড়া গৃহস্থালির পণ্য থেকে শুরু করে ব্যক্তিগত বাগানের জন্যও পাটপণ্য জনপ্রিয় হচ্ছে। সামনের দিনগুলোতে বহুমুখী পাটপণ্যের চাহিদা আরও বাড়বে। তাই দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিয়ে এগোনো গেলে পাটের সুদিন ফেরানো সম্ভব। 

বাংলাদেশ জুট মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিজেএমএ) চেয়ারম্যান মো. মাহবুবুর রহমান পাটোয়ারী প্রথম আলোকে বলেন, সরকার দীর্ঘদিন বিজেএমসির পাটকলের জন্য যে ভর্তুকি দিয়েছে তা যদি বেসরকারি খাত পায়, তবে পাট ও পাটপণ্যের রপ্তানি অনেক বেড়ে যাবে।

পুরান ঢাকায় ছোটখাটো অনেক হালকা প্রকৌশল কারখানা রয়েছে। তাতে কাজ করেন কয়েক হাজার শ্রমিক
পুরান ঢাকায় ছোটখাটো অনেক হালকা প্রকৌশল কারখানা রয়েছে। তাতে কাজ করেন কয়েক হাজার শ্রমিক

সম্ভাবনার দরজা কীভাবে খুলবে হালকা প্রকৌশলে
হালকা প্রকৌশলশিল্পের (লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং) ওপর ভিত্তি করে বিশ্বের অনেক দেশের অটোমোবাইলসহ বড় শিল্পকারখানা দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশেও হালকা প্রকৌশলশিল্পের সম্ভাবনা নিয়ে আলাপ-আলোচনা হচ্ছে দীর্ঘদিন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হালকা প্রকৌশল পণ্যকে ২০২০ সালের বর্ষ পণ্য ঘোষণা করায় বিষয়টি নতুন মাত্রা পেয়েছে। 

ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলার গত আসরের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী এই ঘোষণা দেন। তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি, আমরা লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং খাতের অধীনে বিভিন্ন ধরনের পণ্য রপ্তানি করে আরও বেশি বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে সক্ষম হব।’ প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বিনিয়োগ আকৃষ্টে আমাদের অনেক সুযোগ আছে। লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং খাতে আমাদের বিশাল বাজার আছে।’ 

হালকা প্রকৌশলশিল্পের ৪০ হাজার ক্ষুদ্র-মাঝারি কারখানা রয়েছে। অবশ্য অধিকাংশই গাড়ির ইঞ্জিন ও বিভিন্ন কলকারখানার যন্ত্রপাতি মেরামত আর ছোটখাটো নাটবল্টু তৈরিতেই ব্যস্ত। কিছু প্রতিষ্ঠান কৃষি ও নির্মাণকাজের যন্ত্রপাতি, প্লাস্টিক পণ্যের ছাঁচ বা মোল্ড, পেপার মিলের রোলার, ব্রেড ও বেকারির যন্ত্র ইত্যাদি তৈরি করছে। তার বাইরে অল্প কিছু বড় কারখানা বাইসাইকেল, ইলেকট্রিক ও ইলেকট্রনিক পণ্য রপ্তানি করছে। 

বিদায়ী অর্থবছরে সম্ভাবনাময় হালকা প্রকৌশলশিল্পের রপ্তানি আয় মাত্র ২৯ কোটি ডলার। এই আয় তার আগের বছরের চেয়ে ১৪ শতাংশ কম। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে হালকা প্রকৌশলশিল্পের রপ্তানি আয় ছিল ৩৪ কোটি ডলার। হালকা প্রকৌশলশিল্পের মধ্যে ভালো করছে বাইসাইকেল। বিদায়ী অর্থবছরে ২৯ কোটি ডলারের মধ্যে বাইসাইকেলের রপ্তানি ছিল ৮ কোটি ২৮ লাখ ডলার। 

হালকা প্রকৌশল খাতের কারখানাগুলোর সম্মিলিত টার্নওভার ১৬০ কোটি ডলার। ভ্যালু অ্যাডেড লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং পণ্যে সরকার ১০ শতাংশ নগদ সহায়তা দিয়ে থাকে। এমন তথ্য দিয়ে খাতটির সম্ভাবনা কাজে লাগতে ঢাকা চেম্বার মনে করে, স্থানীয়ভাবে খুচরা যন্ত্রাংশ ও যন্ত্রপাতি তৈরিতে ভ্যাট অব্যাহতি দেওয়া দরকার। মুন্সিগঞ্জে হালকা প্রকৌশলশিল্পের শিল্পপার্কটির নির্মাণকাজ দ্রুত শেষ করা উচিত। স্বল্প সুদে ঋণ ও শ্রমিকদের দক্ষতা উন্নয়নে প্রশিক্ষণের কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া দরকার। 

বড় বিনিয়োগ না হওয়ায় হালকা প্রকৌশলশিল্প ধুঁকছে বলে মনে করেন বাংলাদেশ ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্প মালিক সমিতির আবদুর রাজ্জাক। তিনি বলেন, হালকা প্রকৌশল খাতের অধিকাংশই ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তা। তাঁদের পক্ষে বড় বিনিয়োগ করা সম্ভব না। অন্যদিকে দেশের প্রতিষ্ঠিত বড় ব্যবসায়ীরাও খাতটিতে বিনিয়োগে আসছেন না। তাই সরকারিভাবে উদ্যোগ নিয়ে প্রকল্পের মাধ্যমে কয়েকটি কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করে উন্নতমানের পণ্য উৎপাদন করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে। সেটি করা গেলেই দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট হবে। 

বাংলাদেশের পাশের দেশ ভারতের সাত রাজ্যের তিনটিতে পাথর ভাঙাসহ বিভিন্ন যন্ত্রপাতি রপ্তানি হচ্ছে। চীনের উদ্যোক্তারাও বাংলাদেশ থেকে যন্ত্রপাতি উৎপাদনে আগ্রহ দেখাচ্ছেন। এমন তথ্য দিয়ে আবদুর রাজ্জাক বলেন, ‘সময় চলে যাচ্ছে। আমাদের দ্রুত কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে।’ 

হাজারীবাগের চামড়াশিল্প নগরে চামড়া শুকানোর কাজে ব্যস্ত একজন শ্রমিক। প্রথম আলোর ফাইল ছবি
হাজারীবাগের চামড়াশিল্প নগরে চামড়া শুকানোর কাজে ব্যস্ত একজন শ্রমিক। প্রথম আলোর ফাইল ছবি

অপ্রস্তুত সিইটিপির কারণে বিপাকে চামড়াশিল্প
বিশ্বে ২১ হাজার কোটি ডলারের চামড়ার পণ্য ও জুতার বাজার রয়েছে। তার মাত্র দশমিক ৫ শতাংশ বাংলাদেশ দখল করতে পেরেছে। যদিও উন্নতমানের চামড়া উৎপাদনে অন্য অনেক দেশের চেয়ে বাংলাদেশ এগিয়ে। চামড়া ও চামড়াপণ্য রপ্তানিতে কেবল পরিবেশগত কারণেই বড় ধরনের মার খাচ্ছেন উদ্যোক্তারা। আন্তর্জাতিক বাজারের চেয়ে ৪০ শতাংশ কম দামে চামড়া বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন ট্যানারির মালিকেরা। 

ট্যানারিকে পরিবেশবান্ধব করতে শিল্প মন্ত্রণালয় ২০০৩ সালে সাভারের হেমায়েতপুরে চামড়াশিল্প নগর তৈরির প্রকল্প নেয়। চারবার সংশোধন করে সর্বশেষ ব্যয় ধরা হয় ১ হাজার ১৯ কোটি টাকা। ১৭ বছর পার হলেও প্রকল্পের বেশ কিছু কাজ বাকি। এর মধ্যে ২০১৭ সালে হাজারীবাগ থেকে ট্যানারিগুলোকে অপ্রস্তুত অবস্থায় স্থানান্তরিত করা হয়।

২০১২ সালে শুরু হলেও কেন্দ্রীয় বর্জ্য পরিশোধনাগারের (সিইটিপি) কাজ শেষ হয়নি এখনো। ফলে পরিবেশদূষণের কারণে বাংলাদেশি চামড়া ও চামড়ার পণ্য বিদেশি বড় কোনো ব্র্যান্ড কেনে না। বাংলাদেশি চামড়ার বড় ক্রেতা হচ্ছে চীন। তবে করোনা ছড়িয়ে পড়ার পর চীনারা চামড়া কেনা কমিয়ে দিয়েছেন। তাতে বিপাকে পড়েছেন উদ্যোক্তারা। 

বিদায়ী অর্থবছরে ৭৯ কোটি ৭৬ লাখ ডলারের চামড়া ও চামড়াপণ্য রপ্তানি হয়েছে। এই আয় তার আগের বছরের চেয়ে ২১ দশমিক ৭৯ শতাংশ কম। গত ২০১৯-২০ অর্থবছরে ১০০ কোটি রপ্তানি ছাড়িয়ে যাওয়ার পরের বছরই বড় ধাক্কা খেয়েছে চামড়া ও চামড়াপণ্য। তাতে দ্বিতীয় শীর্ষ রপ্তানি খাত থেকে ছিটকে চারে চলে যায় চামড়া খাত। 

কেন্দ্রীয় বর্জ্য পরিশোধনাগারের কাজ দ্রুতগতিতে শেষ করে লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপের (এলডব্লিউজি) মানসনদ অর্জনে উদ্যোগ নেওয়া দরকার বলে মনে করে ঢাকা চেম্বার। তারা বলছে, প্রতিষ্ঠানগুলোর এলডব্লিউজি মানে উন্নীত করে সনদ অর্জনে সরকারকে তহবিল গঠন করে সহায়তা করা দরকার। কাঁচা চামড়া সংরক্ষণে উন্নত ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। ঈদের আগে ট্যানারির মালিকদের ঋণের ব্যবস্থা করতে হবে। তা ছাড়া রাজশাহী ও চট্টগ্রামে দুটি জুতার অর্থনৈতিক অঞ্চল করা প্রয়োজন। রাসায়নিক আমদানিতে শুল্ক ছাড় দেওয়া দরকার বলে মনে করে ডিসিসিআই। 

দেশের চামড়া খাতের জন্য কোরবানির ঈদ বেশ গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, সারা বছর যে কাঁচা চামড়া সংগ্রহ হয়, তার বড় অংশই আসে কোরবানির সময়। তবে গত কোরবানির ঈদে আর্থিক সংকটের কারণে চামড়ায় বিনিয়োগ কম করেছিলেন ট্যানারি মালিকেরা। তাতে কাঙ্ক্ষিত দাম না পেয়ে কোরবানির চামড়া সড়কে ফেলে দেওয়া কিংবা মাটিতে পুঁতে ফেলার ঘটনা ঘটেছে সারা দেশে। 

বাংলাদেশ ফিনিশড লেদার, লেদারগুডস অ্যান্ড ফুটওয়্যার এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান মহিউদ্দিন আহমেদ সম্প্রতি বলেন, ‘তিন বছর আগে অপরিকল্পিতভাবে হাজারীবাগ থেকে হেমায়েতপুরে ট্যানারি স্থানান্তরের কারণে ৭৫ শতাংশ উদ্যোক্তা ঋণখেলাপি হয়ে পড়েছেন। জামানত দিতে না পারায় সরকারের ঘোষিত ২০ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ থেকে ঋণ নিতে পারছেন না উদ্যোক্তারা। কোরবানির পশুর চামড়া কেনার জন্য আমরা বিশেষ তহবিলের দাবি করেছি। তবে শেষ পর্যন্ত গত বছরের ঋণ সমন্বয় করে নতুন ঋণ দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। তাতে খুব বেশি লাভ হবে না।’

প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্যে বৈচিত্র্য আনতে হবে
প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্যে বৈচিত্র্য আনতে হবে

প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্যে বৈচিত্র্য আনতে হবে
দেশের কৃষিজাত পণ্য, বিশেষ করে প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্য রপ্তানি কয়েক বছর ধরে সম্ভাবনা দেখাচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্য, ভারত, নেপাল ও আফ্রিকার দেশগুলোর পর ইউরোপের বাজারেও রপ্তানি শুরু হয়েছে প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্যের। ইউরোপের তিন দেশ যুক্তরাজ্য, নেদারল্যান্ডস ও ইতালিতে বেশি যাচ্ছিল এসব পণ্য। তবে করোনায় বাধাগ্রস্ত হয়েছে রপ্তানি। 

বিদায়ী অর্থবছরে ৮৬ কোটি ডলারের কৃষিপণ্য রপ্তানি হয়েছে। এই আয় তার আগের বছরের চেয়ে ৫ শতাংশ কম। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে রপ্তানি হয়েছিল প্রাণ ৯১ কোটি ডলারের কৃষিপণ্য। সামগ্রিকভাবে কৃষিপণ্যের রপ্তানি কমলেও চা, তামাক ও শাকসবজির রপ্তানি বেড়েছে। কৃষিপণ্যের রপ্তানির একটি বড় অংশ প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্য। 

প্রক্রিয়াজাত খাদ্য রপ্তানিতে বেশ ভালো করছে দেশের বড় কোম্পানিগুলো। তাদের উৎপাদিত রুটি, বিস্কুট, চানাচুর, পানীয়, মসলা, জ্যাম জেলি, শর্ষের তেল ইত্যাদি পণ্যে রপ্তানি আয় বাড়ছে। মধ্যপ্রাচ্য, ভারত, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের মতো পুরোনো বাজারের পাশাপাশি আফ্রিকা ও এশিয়ার কয়েকটি দেশে সম্প্রসারিত হচ্ছে এসব পণ্যের বাজার। অন্যদিকে শুধু প্রবাসী বাংলাদেশিরা নন, আমদানিকারক দেশগুলোর নাগরিকেরাও বাংলাদেশি পণ্য কেনা শুরু করেছেন বলে দাবি রপ্তানিকারকদের। 

মোট পণ্য রপ্তানিতে প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্যের অবদান ১ দশমিক ৭৫ শতাংশ। তা ছাড়া দেশের সামগ্রিক কর্মসংস্থানে খাতটির অবদান ২ দশমিক ২ শতাংশ। এসব তথ্য দিয়ে ঢাকা চেম্বার বলেছে, আলু, কাঁঠাল, আনারস, কলা ও পেয়ারার মতো যেসব ফল ও সবজি বেশি উৎপাদিত হয়, সেগুলো দিয়ে বৈচিত্র্যময় প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্য প্রস্তুত করতে হবে। পরীক্ষাগার স্থাপনে নীতিসহায়তা লাগবে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের ঋণ দিতে হবে। আশপাশের দেশগুলোতে অশুল্ক বাধা দূর করতে সরকারি পর্যায়ে উদ্যোগ লাগবে। কিছুটা কম দামেও প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্য বিক্রির জন্য অনলাইন প্ল্যাটফর্মকে ব্যবহার করতে হবে।