পকেটে পয়সা নেই, খরচ কিসের

আনিসুজ্জামান, রাইড শেয়ারিং সেবাদাতা
আনিসুজ্জামান, রাইড শেয়ারিং সেবাদাতা

রাজধানীর তেজগাঁওয়ের সাতরাস্তার মোড়ে যাত্রীর অপেক্ষায় মোটরসাইকেল নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন মো. আনিসুজ্জামান। মাস্ক পরা যুবকটির চোখে বিষণ্নতার ছাপ। রাইড শেয়ারিং সেবা পাঠাওয়ের মাধ্যমে মোটরসাইকেলে যাত্রী বহন করেন। কিন্তু এক জায়গায় দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে দেখে অনুমান করা যায়, এখন যাত্রী পাওয়া কঠিন। অকপটে জানালেন, যা উপার্জন, তা দিয়ে চলতে কষ্ট হয়।|

দেশে করোনাভাইরাসের অর্থনৈতিক প্রভাব দিন দিন প্রকট হচ্ছে। অনানুষ্ঠানিক খাতে যুক্ত ব্যক্তিরা কাজ হারাচ্ছেন। শহর ছেড়ে গ্রামের দিকে ফিরে যাচ্ছেন অনেকে। গ্রামে ফিরে যাওয়া মানুষের মধ্যে রাইড শেয়ারিং সেবায় নিয়োজিত ব্যক্তিরাও রয়েছেন বলে জানান আনিসুজ্জামান। বলেন, লকডাউন শুরুর পর মোটরসাইকেলে অ্যাপসভিত্তিক রাইড শেয়ারিং সেবা বন্ধ হয়ে যায়। সম্প্রতি সীমিত আকারে গাড়ির শেয়ারিং শুরুর অনুমতি দেওয়া হলেও মোটরসাইকেলের জন্য সেই সুযোগ চালু করা হয়নি। তাই রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে ডাকাডাকি করে মোটরসাইকেলে যাত্রী তুলে এই শহরে টিকে থাকার লড়াই করছেন বলে জানান আনিসুজ্জামান।

রাইড শেয়ারিং সেবায় কেন এলেন, জানতে চাইলে মো. আনিসুজ্জামান জীবনের গল্প বলতে শুরু করেন। বলেন, ‘একটু ভালো থাকার আশায় ২০০৩ সালে শেরপুর থেকে ঢাকায় আসি। প্রতি মাসে সাড়ে তিন হাজার টাকা বেতনে কাভার্ড ভ্যান চালানো শুরু করি।। ধীরে ধীরে বেতনও বাড়ছিল। তবে কাভার্ড ভ্যান চালানোর কোনো সময়সীমা ছিল না। দিন–রাত বলে কিছু ছিল না। এরপরও ২০১৮ সাল পর্যন্ত কাভার্ড ভ্যান চালাই।’ 

একটু অপেক্ষা করে বলেন, ‘দেখলাম সবাই মোটরসাইকেল চালাচ্ছে। সব সময় যাত্রীও পাচ্ছে। ইচ্ছা হলে চালানো যায়, ইচ্ছেমতো বিশ্রামও নেওয়া যায়। এটা একটা স্বাধীন পেশা। তাই কাভার্ড ভ্যান ছেড়ে ২০১৯ সালের শুরুতে মোটরসাইকেল কিনলাম। পাঠাওয়ে নিবন্ধন করে যাত্রী বহন শুরু করি। এতে জীবন ভালোভাবে চলতে শুরু করে। প্রতিদিন খরচ বাদে এক হাজার টাকা নিয়ে বাসায় যেতে পারতাম।’ 

করোনা পরিস্থিতিতে কী করেছেন, জানতে চাইলে মো. আনিসুজ্জামান বলেন, ‘প্রথমে আতঙ্কে ঘর থেকে বের হতাম না। অফিস খোলার পর বের হচ্ছি। কিন্তু সারা দিন ঘুরেও ৫০০ টাকা হয় না। আগে বের হলেই এক হাজার টাকা নিয়ে বাসায় যেতাম। এখন অ্যাপস বন্ধ, সড়কে ঘুরে ঘুরে যাত্রী খুঁজতে হয়।’

আসলেই তাই। এখন সড়কের মোড়ে মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকেন মোটরসাইকেলের চালকেরা। আগের মতো মোবাইল অ্যাপসের স্ক্রিনে যাত্রী খোঁজার সুযোগ নেই। সে জন্য কাউকে দেখলে ডাকাডাকি করেন বা জানতে চান, কোথাও যাবেন কি না।

মোটরসাইকেলের চালকদের মধ্যে অনেক ছাত্রও আছেন, আবার কম বেতনে চাকরি করা ব্যক্তিরাও সময়ে পেলে রাইড শেয়ার করেন। তবে মো. আনিসুজ্জামানের মতো পুরোপুরি রাইড শেয়ারিং করা ব্যক্তিদের সংখ্যাই বেশি।

জানা গেছে, পাঠাও, উবার, সহজ, ও ভাইসহ বিভিন্ন সেবার মাধ্যমে দুই লাখের বেশি মানুষ রাইড শেয়ারিং সেবার সঙ্গে যুক্ত।

উবার জানিয়েছে, ঢাকায় তাদের অধীনে পাঁচ হাজার নিবন্ধিত গাড়ি চলাচল করছে। আর মোটরসাইকেল রাইড বন্ধ থাকায় চালকেরা উবার কানেক্টে যুক্ত হতে পারছেন। এর ফলে সহজেই পার্সেল পৌঁছানো যাচ্ছে। এ ছাড়া উবারের অন্য সেবায় যুক্ত হতে পারছেন মোটরসাইকেলের চালকেরা। তবে সেই সংখ্যা কম বলে জানা গেছে। 

ও ভাইয়ের পক্ষ থেকে জানানো হয়, করোনা শুরুর পর মোটরসাইকেল রাইড অনেক কমে গিয়েছিল। এখন সেই ধাক্কা সামলে রাইড আবার ভালো হচ্ছে। এখন যেহেতু মোটরসাইকেলের চালকেরা অ্যাপসের মাধ্যমে রাইড নিতে পারছেন না, তাই তাঁদের অনেককে ও ভাই পার্সেল সার্ভিসে কাজ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া করোনার শুরুতে চালকদের আর্থিক সহায়তাও দেওয়া হয়েছে। 

মো. আনিসুজ্জামানের কাছে জানতে চাইলাম, আপনার আয় তো কমে গেছে। খরচ কীভাবে সামাল দিচ্ছেন? সরাসরি জবাব, ‘আয় কমেছে, সব খরচ এমনিতেই কমে গেছে। পকেটে পয়সা নেই, আবার খরচ কিসের? আগে মাংস খেতাম মাসে চারবার। এখন একবারও জুটছে না। গত চার মাসে একবারও কাপড় কেনা হয়নি। কবে হবে, তা–ও জানি না।’ 

বাড্ডায় স্ত্রীকে নিয়ে একটি ভাড়া বাসায় থাকেন মো. আনিসুজ্জামান। ভাড়া পাঁচ হাজার টাকা। সরকার থেকে কোনো সহায়তা পেয়েছেন কি না, জিজ্ঞেস করতেই বলেন, ‘না ভাই, কে দেখবে আমাদের? আগে অ্যাপস দিয়ে যাত্রী খুঁজতাম। সেটা বন্ধ করে দিয়েছে। অথচ সব অফিস খুলে গেছে। আমরা যাঁরা যাত্রী পরিবহন করি, তাঁদের দিকে দেখেও তো অ্যাপস খুলে দিতে পারত।’ 

কথা বলতে বলতে একজন যাত্রী পেয়ে যান আনিসুজ্জামান। সাতরাস্তা থেকে বাড্ডার দিকে ছোটেন ৭০ টাকা ভাড়ার যাত্রী নিয়ে। 

রাইড শেয়ারিং সেবাদাতা পাঠাও জানিয়েছে, সারা দেশে তাদের নিবন্ধিত মোটরসাইকেল সাড়ে তিন লাখ। এর মধ্যে ঢাকাতেই আড়াই লাখ। এ ছাড়া ৫০ হাজারের বেশি নিবন্ধিত গাড়ি রয়েছে। তিন মাস বন্ধের পর ২ জুলাই থেকে ঢাকায় দুই হাজার গাড়ি চলাচল শুরু করেছে। পাঠাও জানায়, তারা মোটরসাইকেলের চালকদের সহায়তা দিতে বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন, অভিযাত্রিক ফাউন্ডেশন, ফিড এ ফ্যামিলি, উৎসর্গ প্রভৃতি সংস্থার সঙ্গে কাজ করছে। 

২০১৬ সালে উবার প্রথম ঢাকায় রাইড শেয়ারিং সেবা চালু করে। এরপর স্থানীয় কিছু কোম্পানিও রাইড শেয়ারিং সেবা চালু করে। ২০১৮ সালে এ নিয়ে নীতিমালা প্রণয়ন করে সরকার।

অ্যাপস খুলে দিতে সরকারের কাছে আবেদন করা হয়েছে জানিয়ে সহজ ডটকমের প্রতিষ্ঠাতা ব্যবস্থাপনা পরিচালক মালিহা কাদির প্রথম আলোকে বলেন, করোনায় জীবন ও জীবিকায় বড় প্রভাব পড়েছে। যাঁরা শুধু এই পেশার ওপর নির্ভরশীল, তাঁরা গ্রামে চলে গেছেন। খাবার সরবরাহ করার জন্য আমরা চালক খুঁজে পাচ্ছি না। যাঁরা ঢাকায় ছিলেন, তাঁরা বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনের খাবার বিতরণের কাজ করেছেন।

মালিহা কাদির আরও বলেন, করোনা হলেও অফিস খোলা। মানুষ বের হচ্ছে। আবার অ্যাপস বন্ধ থাকলেও রাইড শেয়ার তো বন্ধ নেই। এর ফলে ঝুঁকি নিয়ে মানুষ অন্যের মোটরসাইকেলে উঠছে। এই চলাচলের কোনো রেকর্ড থাকছে না অ্যাপসের মাধ্যমে সেবা বন্ধ রাখার কারণে।

আনিসুজ্জামানেরাও আশা করেন, যেহেতু মানুষ ঘর থেকে বের হচ্ছে, সেহেতু মোটরসাইকেলের রাইড শেয়ারিং অ্যাপস চালু করে দিলে তাঁরা একটু ভালোভাবে বাঁচার চেষ্টা করতে পারবেন।