যুক্তরাজ্য-চীনের দুই দশকের সম্পর্ক এখন কোথায়

যুক্তরাজ্য ও চীনের মধ্যে সুবিধাজনক যে সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল, দুই দেশের মধ্যে তা হুমকির মুখে পড়েছে। ছবি: রয়টার্স
যুক্তরাজ্য ও চীনের মধ্যে সুবিধাজনক যে সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল, দুই দেশের মধ্যে তা হুমকির মুখে পড়েছে। ছবি: রয়টার্স

গত দুই দশকে যুক্তরাজ্য এবং চীনের মধ্যে অর্থনৈতিক সম্পর্ক উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। ১৯৯৯ সালে যেখানে চীন ছিল যুক্তরাজ্যের ২৬তম রপ্তানি বাজার, সেখানে এখন তারা ষষ্ঠ স্থানে উঠে এসেছে। অবকাঠামোগত বড় প্রকল্প ও শিক্ষার ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা পালন করে গত বছর দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য রেকর্ড পরিমাণে পৌঁছে। তবে এ সম্পর্কে এবার ফাটল ধরেছে।

সম্প্রতি মিত্র যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যোগ দিয়ে চীনা কোম্পানি হুয়াওয়ের আর কোনো ৫-জি পণ্য না কেনার নির্দেশ দিয়েছে ব্রিটিশ সরকার। ২০২৭ সালের মধ্যে ব্রিটিশ নেটওয়ার্ক থেকে হুয়াওয়ের ৫-জি যন্ত্রাংশ সরিয়ে ফেলার নির্দেশও দেওয়া হয়েছে। এর এর মাধ্যমে সুবিধাজনক যে সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল, দুই দেশের মধ্যে তা হুমকির মুখে পড়েছে।কোন কোন খাতে জড়িত দুই দেশের সম্পর্ক তা নিয়ে বিবিসি অনলাইনে এক প্রতিবেদনে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।

বাণিজ্য: যুক্তরাজ্যের সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত বছর চীন ছিল দেশটির ষষ্ঠ বৃহত্তম রপ্তানি বাজার। গত বছর চীনে ৩ হাজার ৭০ কোটি পাউন্ডের রপ্তানি করে তারা—যা এযাবৎকালের সর্বোচ্চ। শুধু তাই নয়, চীন হলো যুক্তরাজ্যের চতুর্থ বৃহত্তম আমদানির উৎস। গত বছর তারা ৪ হাজার ৯০০ কোটি পাউন্ডের পণ্য আমদানি করে চীন থেকে।

অবকাঠামো: পারমাণবিক শক্তি ক্ষমতাসহ নানা ধরনের অবকাঠামোগত ক্ষেত্রে চীন যুক্তরাজ্যের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। চীন জেনারেল পারমাণবিক বিদ্যুৎ (সিজিএন) আংশিকভাবে সমারসেটে ২০ বিলিয়ন ডলার হিংকলে পয়েন্ট পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ভবনের জন্য অর্থায়ন করেছে।

চীনের শিক্ষার্থী: ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ ইকোনমিকস অ্যান্ড সোশ্যাল রিসার্চের (এনআইইএসআর) তথ্য অনুসারে ২০০৬ সালের পর থেকে এখন পর্যন্ত যুক্তরাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে চীনা শিক্ষার্থীর সংখ্যা তিন গুন হয়েছে। চীনা শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে টিউশন ফি বাবদ যুক্তরাজ্যের শিক্ষা প্রতিষ্ঠাগুলো প্রতি বছর প্রায় ১৭০ কোটি পাউন্ড আয় করে।

বিশেষজ্ঞরা হুঁশিয়ারি দিয়েছেন যে চীন তার শিক্ষার্থীদের যুক্তরাজ্যে আসায় নিষেধাজ্ঞা দিলে যুক্তরাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আর্থিকভাবে বিপাকে পড়বে। বিশ্লেষকেরা মনে করেন, এ ক্ষেত্রে যুক্তরাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে তাদের ব্যয় সামঞ্জস্য করতে হবে বা উপার্জনের অন্য উৎস খুঁজতে হবে। তবে ব্রিটিশ কাউন্সিল মনে করছে, বিদেশে পড়াশোনার দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা স্বল্পমেয়াদি রাজনৈতিক সম্পর্কের দ্বারা প্রভাবিত হওয়ার সম্ভাবনা কম। যুক্তরাজ্য সব সময়ই চীনা শিক্ষার্থীদের প্রিয় গন্তব্যস্থল।

প্রযুক্তিগত:
২০০৫ সাল থেকে যুক্তরাজ্যে বড় বিনিয়োগ করে আসছে চীনা প্রতিষ্ঠান হুয়াওয়ে। যদিও হুয়াওয়ে আর নতুন ৫-জি পণ্য সরবরাহের ক্ষেত্রে যুক্ত থাকবে না, তবে এটি যুক্তরাজ্যের বিদ্যমান টেলিকম অবকাঠামোর সঙ্গে জড়িত। এ ছাড়া আলোচনার বেশির ভাগ হুয়াওয়েকে নিয়ে হলেও, এটিই যুক্তরাজ্য চীনের একমাত্র প্রযুক্তি সংস্থা না।

চীনে যুক্তরাজ্যের ব্যবসা: চীনেও যুক্তরাজ্যের অনেক বড় বড় ব্যবসা যুক্ত রয়েছে। ব্রিটিশ কোম্পানিগুলো চীনে শক্তি, গাড়ি উৎপাদন, ফার্মাসিউটিক্যালস এবং আর্থিক পরিষেবার মতো খাতে ছড়িয়ে রয়েছে।

মাত্র পাঁচ বছর আগেও চীনের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে এক 'সোনালি দশকেরও' কথা বলছিল ব্রিটেন। সে সময় চীন সফরে গিয়ে এমন মন্তব্য করেছিলেন তৎকালীন ব্রিটিশ অর্থমন্ত্রী জর্জ অসবোর্ন। কিন্তু দুই দেশের সম্পর্কের সেই সোনালি দশকের ক বছর না যেতেই তিক্ত শীতল যুদ্ধের মোড় নিয়েছে দুই দেশের সম্পর্কে। রাজনীতি আর আন্তর্জাতিক সম্পর্কে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে মধুর স্মৃতিতে ভাটা পড়েছে এ বেলায়।

আসলে এই পাঁচ বছরে বিশ্ব রাজনীতিতে নাটকীয় সব পরিবর্তন ঘটে গেছে। ব্রেক্সিট, অর্থাৎ ব্রিটেন ইউরোপীয় ইউনিয়ন ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে নির্বাচনে জিতে ক্ষমতায় এসেছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। এর পথ ধরে চীন-মার্কিন সম্পর্কে অবনতি এবং বাণিজ্য যুদ্ধের সূচনা হয়েছে। হংকং এ গণতন্ত্রপন্থীদের বিক্ষোভ দমনে বেইজিং নিয়েছে কঠোর অবস্থান। চীনা কোম্পানি হুয়াওয়ে নিয়েও শুরু হয়েছে বিতর্ক। যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে কিছু পশ্চিমা দেশ এই কোম্পানির বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। সর্বশেষ তাদের কাতারে গিয়ে শামিল হয়েছে যুক্তরাজ্য। এখন দেখার বিষয় এ সম্পর্ক কত তিক্ত অবস্থায় যায়।