গত অর্থবছরের এডিপি বাস্তবায়ন: সব দোষ যেন করোনার

বর্তমানে ছয়টি উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ (আইআরডি)। এর মধ্যে অন্যতম হলো ভ্যাট অনলাইন প্রকল্প। এ ছাড়া আগারগাঁওয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) নতুন ভবন নির্মাণ এবং বন্ড ব্যবস্থাপনা আধুনিকায়নের প্রকল্প আছে। সব মিলিয়ে ওই ছয়টি প্রকল্পে বিদায়ী ২০১৯–২০ অর্থবছরের সংশোধিত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) ২৩০ কোটি টাকা দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু বছর শেষে খরচ হয়েছে মাত্র ৩৫ কোটি টাকা। তাতে আইআরডির প্রকল্প বাস্তবায়ন হার মাত্র ১৫ শতাংশ।

একইভাবে পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের ১৪টি প্রকল্পের বিপরীতে বরাদ্দ দেওয়া হয় ৪৪৭ কোটি টাকা। সারা বছর খরচ হয়েছে মাত্র ১৭৬ কোটি টাকা। বাস্তবায়ন হার ৩৯ শতাংশ।

বিদায়ী এডিপিতে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দ ছিল ৪৬৩ কোটি টাকা। এই টাকা ওই মন্ত্রণালয়ের পাঁচ প্রকল্পে খরচ করার কথা। কিন্তু খরচ করা সম্ভব হয়েছে মাত্র ২১৭ কোটি টাকা। বাস্তবায়ন হার প্রায় ৪৭ শতাংশ।

এই হলো উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের চিত্র। সব মিলিয়ে সাতটি মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও সংস্থা সারা বছরে বরাদ্দের অর্ধেক টাকাও খরচ করতে পারেনি। অন্য চারটি মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলো হলো আইএমইডি, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), সরকারি কর্ম কমিশন এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

প্রকল্পের কাজ ঠিকমতো হচ্ছে কি না, তা তদারকির দায়িত্ব আইএমইডির। অথচ এ বিভাগটিও নিজেদের তিনটি প্রকল্পের অর্ধেক টাকাও খরচ করতে পারেনি। আইএমইডির তিন প্রকল্পে বরাদ্দ ছিল ১৫২ কোটি টাকা। বাস্তবায়ন হার মাত্র ৪৭ শতাংশ। আবার বিভিন্ন প্রকল্পের দুর্নীতির খোঁজ রাখে যে সংস্থাটি, সেটি দুদক। কিন্তু উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে নিজেদের সক্ষমতা বা পারদর্শিতা দেখাতে পারেনি সংস্থাটি। দুদকের দুই প্রকল্পে বিদায়ী অর্থবছরে বরাদ্দ ছিল ৯ কোটি ৭২ লাখ টাকা, যার অর্ধেকও খরচ হয়নি বছর শেষে। সরকারি কর্ম কমিশনের দুই প্রকল্পে বিদায়ী বছরে ৫২ কোটি ৫৩ লাখ টাকা খরচের কথা ছিল। অথচ বরাদ্দের ৪৫ শতাংশ খরচ করতে পেরেছে সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তা নিয়োগের সঙ্গে সম্পৃক্ত গুরুত্বপূর্ণ এ সংস্থাটি। আর পুরো বাজেটের অর্থের নিয়ন্ত্রণ যাদের হাতে, সেই অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ ছয় প্রকল্পে ১১৪ কোটি টাকা বরাদ্দের বিপরীতে খরচ করতে পেরেছে অর্ধেক টাকা।

এবারের এডিপির প্রকল্প বাস্তবায়ন না হওয়ার কারণ হিসেবে একযোগে সবাই করোনা সংকটের কথা বলছেন। কিন্তু আসলেই কি তাই? বিশ্লেষকেরা বলছেন, করোনা অন্য সব কারণগুলোর মতো একটি কারণ মাত্র। প্রকল্প বাস্তবায়ন না হওয়া বা ধীরগতির মূল কারণ সক্ষমতার ঘাটতি। অথচ নিজেদের ব্যর্থতার জন্য সবাই এখন করোনাকে দুষছেন। 

জানতে চাইলে বেসরকারি সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান প্রথম আলোকে বলেন, ‘শুধু করোনাকে দায়ী করা ঠিক নয়। মন্ত্রণালয় বা বিভাগগুলোর সক্ষমতার অভাব আছে। এটি অনেক পুরোনো সমস্যা। কেন মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলো টাকা খরচ করতে পারে না, তা নিয়ে কখনো মূল্যায়ন হয়নি। এ নিয়ে একটি মূল্যায়ন করা উচিত।’ 

বাংলাদেশে করোনার সংক্রমণ শুরু হয়েছে মার্চ মাসের শেষের দিকে। তখন পর্যন্ত তিন প্রান্তিক শেষ হয়ে গেছে। এবার দেখা যাক, ওই তিন প্রান্তিকে সাতটি মন্ত্রণালয় ও বিভাগ বরাদ্দের কত টাকা খরচ করতে পেরেছে। আইএমইডির প্রতিবেদন অনুযায়ী, একমাত্র আইএমইডি ছাড়া বাকি ছয়টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগের কেউ গত অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে বরাদ্দের ২০ শতাংশের বেশি খরচ করতে পারেনি। সেই হিসাবে দেখা যাচ্ছে, করোনার সময়ে বছরের বাকি ৯ মাসের চেয়ে বেশি খরচ হয়েছে।

আইএমইডি সূত্রে জানা গেছে, এবার সংশোধিত এডিপির বরাদ্দের ৬০ শতাংশ খরচ করতে পারেনি সব মিলিয়ে ১২টি মন্ত্রণালয়। করোনার মধ্যে প্রকল্পের কাজ এগিয়ে নেওয়ার ভালো উদাহরণও আছে। যেমন, সবচেয়ে বেশি ৯৯ দশমিক ৬০ শতাংশ টাকা খরচ করেছে সেতু বিভাগ। আর দ্বিতীয় স্থানে থাকা শিল্প মন্ত্রণালয় ৯৯ দশমিক ১৭ শতাংশ এবং তৃতীয় স্থানে থাকা প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় ৯৮ দশমিক ৫ শতাংশ অর্থ খরচ করেছে।

প্রতিবছর মে-জুন মাসে এডিপির টাকা খরচের হিড়িক পড়ে। ফলে প্রকল্পের গুণগত মান ঠিক থাকে না। এটিকে মে-জুন সিনড্রোম বলা হয়। করোনার কারণে অবশ্য এবার তা হয়নি। কারণ বহু প্রকল্পের কাজ বন্ধ ছিল। চলতি অর্থবছরের মূল এডিপির আকার ছিল ২ লাখ ১৫ হাজার ১১৪ কোটি টাকা। কাঙ্ক্ষিত হারে বাস্তবায়ন না হওয়ায় গত এপ্রিলে তা কমিয়ে ২ লাখ ১ হাজার ১১৯ কোটি টাকায় নামিয়ে আনা হয়।