করোনা কেড়ে নিল ৩০ বছরের দারিদ্র্যবিমোচন সাফল্য

করোনার কারণে এপ্রিল থেকে জুন মাস পর্যন্ত রাজধানীর আশকোনার আবদুস সালামের সেলুন পুরোপুরি বন্ধ ছিল। রোজগার বন্ধ থাকায় সঞ্চয় ভেঙে সংসার চালিয়েছেন। কিছু ধার-কর্জও করেছেন। উপায়ান্তর না দেখে জুনের শেষ সপ্তাহে ঝুঁকি নিয়ে সেলুন খোলেন সালাম। কিন্তু রোজগার আগের মতো নেই। আগে যেখানে দিনে ৮০০-৯০০ টাকা রোজগার করতেন সালাম, এখন তা ৩৫০-৪০০ টাকায় নেমেছে। 

একইভাবে বিপাকে পড়েছেন এয়ারপোর্ট মোড়ের ওয়ান্ডার ইন রেস্তোরাঁর কর্মী রিপন। গত ২৫ মার্চ থেকে রিপন বেকার। জমানো টাকায় কোনোমতে সংসার চালিয়েছেন। ড্রাইভিং লাইসেন্স থাকায় রিপন এখন মাঝেমধ্যে ভাড়ায় গাড়ি চালান। এ ছাড়া যখন যে কাজ পান, তা–ই করেন।

করোনার কারণে বেকার হয়ে পড়া সালাম, রিপনের মতো এমন কষ্টের জীবন কাটাচ্ছেন দিনমজুর, রিকশাচালক, ফুটপাতের দোকানিসহ দেশের লাখ লাখ শ্রমজীবী। করোনা শুরুর দু-তিন মাস সবকিছু বন্ধ থাকায় তাঁদের অধিকাংশই বেকার বসে ছিলেন। করোনা সংকটে দেশে গরিব মানুষের সংখ্যা বেড়েছে। পুরোনো গরিবেরা আরও গরিব হয়ে গেছেন। গত তিন দশকের দারিদ্র্যবিমোচনের সাফল্য করোনার এক ধাক্কায় যেন বেসামাল হয়ে পড়েছে।

করোনাকালের দারিদ্র্য নিয়ে একাধিক প্রতিষ্ঠান গবেষণা করছে। সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষণা পরিচালক বিনায়ক সেন ‘করোনাকালের দারিদ্র্য: বাংলাদেশে প্রবণতা, চালিকা শক্তি, ঝুঁকি ও নীতি সহায়তা’ শীর্ষক গবেষণা করেছেন। তাঁর গবেষণায় বলা হয়েছে, গত এপ্রিল-জুন সময়ে সবকিছু বন্ধ থাকায় ১ কোটি ৬৪ লাখ মানুষ নতুন করে গরিব হয়েছেন। আর সুবিধাভোগীদের তালিকায় নাম না থাকায় তাঁরা সরকারের সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি সুবিধাও পাননি।

ওই গবেষণার হিসাবে, তিন মাসের ব্যবধানে সার্বিক দারিদ্র্য হার ২০ শতাংশ থেকে এক লাফে ২৯ শতাংশ হয়েছে। করোনা পরিস্থিতির উন্নতি না হলে বছর শেষে তা ৩৩ দশমিক ২ শতাংশে উঠে যাবে।

জুন ও জুলাই মাসে ধীরে ধীরে দোকানপাট, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, কারখানা—এসব খুলতে শুরু করেছে; যা সেলুনকর্মী সালামের মতো কাজ হারানো মানুষকে আশার আলো দেখাচ্ছে। এ নিয়ে বিনায়ক সেনের গবেষণায় বলা হয়েছে, আগামী ছয় মাসে শ্রমজীবী মানুষের আয় বাড়তে বাড়তে করোনার আগের ৮০ শতাংশের সমান হলেও পরিস্থিতি বদলে যাবে। তখন বছর শেষে দারিদ্র্য ২৫ শতাংশের মতো হবে।

টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যের (এসডিজি) দারিদ্র্যমুক্ত হওয়ার লক্ষ্য অর্জনের পথে যেসব দেশ এগিয়ে আছে, বাংলাদেশ তাদের একটি। কারণ, এক দশক ধরে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) গড় প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশের ওপরে আছে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে তা ৮ দশমিক ১৩ শতাংশে পৌঁছেছে। প্রবৃদ্ধির এই ধারাবাহিকতা থাকলে ২০২৭ সালেই এসডিজির লক্ষ্য অর্জন করত বাংলাদেশ।

কিন্তু করোনা সবকিছু ওলটপালট করে দিয়েছে। গবেষণা বলছে, আগামী এক দশক মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি গড়ে ৮ শতাংশ অর্জিত হলেও ২০৩১ সাল নাগাদ দারিদ্র্য হার কোনোভাবেই ৩ শতাংশের নিচে নামানো যাবে না।

দেড় দশক আগে অর্থাৎ ২০০৫ সালে তৈরি করা একমাত্র দারিদ্র্যবিমোচন কৌশলপত্রের খসড়ার প্রণেতা ছিলেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হোসেন জিল্লুর রহমান। এ বিষয়ে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘এত দিন ধরে দারিদ্র্যবিমোচনের প্রক্রিয়া যে সফলভাবে চলছিল, করোনার কারণে তা বড় ধরনের ধাক্কা খেয়েছে। তাই দারিদ্র্যবিমোচনের আগের গতিতে ফিরে যাওয়া কঠিন হবে। দারিদ্র্য কমানোর শক্তির জায়গাগুলো দুর্বল হয়ে গেছে। করোনার পরে বৈশ্বিক পরিস্থিতিও কতটা অনুকূলে থাকবে, তা নিয়েও সন্দেহ আছে।’

করোনা সংকটে দারিদ্র্য

করোনার শুরুতে (এপ্রিল-জুন) সবকিছু বন্ধ করে দিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। তখন শহর-গ্রামনির্বিশেষে দিন আনে দিন খায় মানুষের অবস্থা কেমন হয়েছিল, তা দেখানো হয়েছে বিনায়ক সেনের গবেষণায়। এই সময়কালকে কঠোর লকডাউন হিসেবে বলা হয়েছে। গবেষণায় দেখানো হয়েছে, ওই সময়ে শহরের বহু মানুষ বেকার হন, অনেকের রোজগার ৫ ভাগের ১ ভাগে নেমেছে। আর গ্রামের শ্রমিকদের আয় প্রায় এক-তৃতীয়াংশ পর্যন্ত কমেছে। ফলে ওই তিন মাসে ৯৩ লাখ ৬০ হাজার থেকে ৩ কোটি ৫৪ লাখ মানুষ নতুন করে গরিব হয়েছেন। এপ্রিল-জুনে শহরের শ্রমজীবীদের আয় ৮০ শতাংশ এবং গ্রামের শ্রমিকদের আয় ১০ শতাংশ কমেছে—এই চিত্র সবচেয়ে বাস্তবসম্মত বলা হয়েছে। এই হিসাবে, প্রায় ১ কোটি ৬৪ লাখ মানুষ নতুন করে গরিব হয়েছেন। পুরোনো গরিবদের কষ্ট তিন গুণ বেড়েছে।

শ্রমজীবীদের কষ্টের কথা চিন্তা করে অর্থনীতি পুনরুদ্ধার কার্যক্রম চালুর সুপারিশ করা হয়েছে ওই গবেষণায়। স্বাস্থ্যবিধি মেনে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, দোকানপাট, কারখানা খুলে দেওয়া হলে দিনমজুর, খেটে খাওয়া মানুষের আয়ের পথ কিছুটা হলেও সচল হবে। একে শিথিল লকডাউন বা মানবিক লকডাউন বলা হয়েছে। এর ফলে চলতি তৃতীয় প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) ওই সব শ্রমজীবীর আয় আগের অর্ধেক হয় এবং পরের প্রান্তিকে (অক্টোবর-ডিসেম্বর) তাঁদের আয় বেড়ে ৮০ শতাংশ হয়; তাহলে আগামী ছয় মাস গরিব মানুষের সংখ্যা বাড়বে না; বরং কমবে। দারিদ্র্য হার ২৯ শতাংশ (জুন মাসের হিসাব) থেকে ডিসেম্বর নাগাদ ২৫ দশমিক ১৩ শতাংশে নেমে যাবে; যা ২০১৬ সালে দেশে যে দারিদ্র্য হার ছিল, এর চেয়ে একটু বেশি। এর মানে হচ্ছে, অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ালেও করোনা সংকট দারিদ্র্যকে পাঁচ বছর আগের জায়গায় ফিরিয়ে নিল।

৮% প্রবৃদ্ধি যথেষ্ট নয়

এসডিজির দারিদ্র্যমুক্ত হওয়ার লক্ষ্য অর্জন করতে দারিদ্র্য হার অন্তত ৩ শতাংশের নিচে নামাতে হবে। গবেষণায় ফল অনুযায়ী, পরিস্থিতির উন্নতি না হলে এ বছরের শেষে দারিদ্র্য হার বেড়ে যদি ৩৩ দশমিক ২ শতাংশ হয়, তাহলে আগামী এক দশক জিডিপি প্রবৃদ্ধি গড়ে ৮ শতাংশ হলেও ২০৩১ সাল নাগাদ দারিদ্র্য হার বড়জোর ১১ দশমিক ২ শতাংশে নামবে। প্রবৃদ্ধি আরও কমে গেলে দারিদ্র্যও আরও বাড়বে।

অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার কার্যক্রম শুরু হওয়ায় বছর শেষে যদি দারিদ্র্য হার ২৫ দশমিক ১৩ শতাংশ হয়, তাহলে পরের ১০ বছরে যদি জিডিপি প্রবৃদ্ধি গড়ে ৮ শতাংশ হয়, তারপরও ২০৩১ সালে দেশের ৩ দশমিক ১ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করবেন।

গবেষণায় বলা হয়েছে, করোনা না হলে প্রবৃদ্ধির বর্তমান ধারা (৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি) অব্যাহত থাকলে ২০২৭ সালেই দারিদ্র্য হার ৩ শতাংশের নিচে নেমে যেত।

এই বিষয়ে বিনায়ক সেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘এসডিজির দারিদ্র্য কমানোর লক্ষ্য অর্জন করা এত সহজ হবে না। করোনা–পরবর্তী বৈশ্বিক বাণিজ্য প্রেক্ষাপট বিবেচনা করে ৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করা কঠিন হবে। ৬-৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হলেও ভালো। তাই প্রবৃদ্ধি কম হলেও তা যদি আগের চেয়ে বেশি দারিদ্র্য কমায়, তাহলে এসডিজির লক্ষ্য অর্জন বা কাছাকাছি যাওয়া সম্ভব হবে। যখন প্রবৃদ্ধির সুফল তৃণমূলের গরিবেরা যত বেশি পাবেন, তখনই এর দারিদ্র্য কমানোর ক্ষমতা বাড়বে। আয়বৈষম্য যেমন কমাতে হবে, তেমনি সম্পদের বৈষম্যও কমাতে হবে।

অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার খসড়ার তৈরির জন্য ১৬টি খাতের পটভূমিপত্র (ব্যাকগ্রাউন্ড পেপার) তৈরি করা হয়েছে। দারিদ্র্যবিষয়ক ওই গবেষণা একটি পটভূমিপত্র (ব্যাকগ্রাউন্ড পেপার) হিসেবে নিয়েছে পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগ (জিইডি)। গবেষণায় বিনায়ক সেনের সঙ্গে ছিলেন বিআইডিএসের অপর দুই গবেষক জুলফিকার আলী ও মুনতাসির মোর্শেদ।

পরিকল্পনা কমিশনও মনে করছে, করোনার কারণে এসডিজির লক্ষ্য অর্জন কঠিন হবে। জিইডির সদস্য শামসুল আলম এ নিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আগামী এক দশক গড়ে ৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হলেও পুরোপুরি দারিদ্র্যমুক্ত করা কঠিন হবে। আগামী পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা প্রণয়নের জন্য বিনায়ক সেনের গবেষণায় প্রাপ্ত ফলাফল বিবেচনায় নিচ্ছি।’ তিনি জানান, অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে তিন বছরের বিশেষ পরিকল্পনা করা হচ্ছে।

দারিদ্র্য বেড়েছে সব গবেষণায়

করোনাকালে গরিব মানুষের আয়-রোজগার ও দারিদ্র্য নিয়ে সমীক্ষা করেছে বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান। গত জুন মাসে গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) বলেছে, করোনার কারণে দারিদ্র্য বেড়ে ৩৫ শতাংশ হয়েছে। গত এপ্রিল মাসে করা এক যৌথ সমীক্ষায় পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) ও ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (বিআইজিডি) বলেছে, মোট জনগোষ্ঠীর ৪৩ শতাংশ দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে গেছে। দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সংখ্যা প্রায় সাত কোটি। করোনায় বৈশ্বিক দারিদ্র্য পরিস্থিতিও খারাপ হচ্ছে। গত ১০ জুন বিশ্বব্যাংক বলেছে, করোনার কারণে এ বছর ৭ থেকে ১০ কোটি মানুষ হতদরিদ্র হয়ে যাবেন।

ঢেলে সাজানোর পরামর্শ

‘করোনাকালের দারিদ্র্য: বাংলাদেশে প্রবণতা, চালিকা শক্তি, ঝুঁকি ও নীতি সহায়তা’ গবেষণায় করোনা–পরবর্তী সংকট মোকাবিলা করতে বেশ কিছু সুপারিশ করা হয়েছে। গবেষণায় বলা হয়েছে, শুধু আয় বৈষম্য কমালেই হবে না; অন্যান্য সামাজিক সূচকেও বৈষম্য কমাতে হবে। সুপারিশগুলো হলো, সর্বজনীন স্বাস্থ্যসুবিধার জন্য মধ্য মেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ; মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) অনুপাতে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি; সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থা ঢেলে সাজানো; প্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি; উদ্ভাবনী উপায়ে সম্পদের জোগান এবং প্রবৃদ্ধির দারিদ্র্য কমানোর ক্ষমতা বৃদ্ধি করা। এসব সংস্কার হলে পুরোনো গরিবদের পাশাপাশি নতুন গরিব হওয়া রিপন, সালামরা বিপদের সময় সহায়তা পাবেন। সারা বছর স্বাস্থ্য-শিক্ষার মতো মৌলিক সুবিধা পাওয়ার সুযোগ বাড়বে।

এ বিষয়ে বিনায়ক সেন বলেন, বর্তমান ত্রুটিপূর্ণ ব্যবস্থা দিয়ে করোনা–পরবর্তী সংকট মোকাবিলা করা যাবে না। স্বাস্থ্য, সামাজিক সুরক্ষা, প্রবৃদ্ধির কাঠামো—সবকিছু ঢেলে সাজাতে হবে।