ব্যবসায়ীদের যোগসাজশে পানির দরে চামড়া বিক্রি

কোরবানির পশুর চামড়া নিয়ে গতবারের নৈরাজ্যের পরও শক্ত কোনো পদক্ষেপ নেয়নি সরকার। বিপর্যয় ঠেকাতে শেষ সময়ে হটলাইন চালু, কাঁচা চামড়া রপ্তানির অনুমতি এবং তার আগে লবণযুক্ত চামড়ার দাম নির্ধারণ করেই দায়িত্ব সেরেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। সেই সুযোগে আড়তদার ও ট্যানারির মালিকেরা চামড়ার দাম কমিয়ে দিয়েছেন। অনেকটা পানির দরেই বিক্রি হয়েছে কোরবানির পশুর চামড়া। দাম না পেয়ে চামড়া নষ্টের ঘটনাও ঘটেছে। 

ঈদের দিন পুরান ঢাকার চামড়া আড়ত পোস্তায় গরুর চামড়া আকারভেদে ১৫০ থেকে ৬০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। ছাগলের চামড়ার দাম ২ থেকে ১০ টাকা। বিনা পয়সায়ও ছাগলের চামড়ার আড়তে রেখেও গেছেন কেউ কেউ। চট্টগ্রামে গরুর চামড়া আকারভেদে ১৫০ থেকে ৪০০ টাকা বিক্রি হয়। অথচ চলতি বছর কোরবানির পশুর চামড়ার দাম অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে সর্বনিম্ন নির্ধারণ করা হয়েছিল। 

কোরবানির পশুর চামড়ার দাম কমের বিষয়ে নানা রকম অজুহাত দিচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। তাঁদের মধ্যে আড়তদারেরা বলছেন, অধিকাংশ ট্যানারির মালিক ঈদের আগে বকেয়া অর্থ দেননি। তাই অর্থাভাবে আড়তদারেরা বেশি দামে চামড়া কিনতে পারেননি। অন্যদিকে ট্যানারিমালিকদের একাংশ বলছেন, আড়তদারদের কাছে তাঁদের বকেয়া নেই। ঢাকার বাইরের ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, করোনায় চামড়া ও চামড়াপণ্যের রপ্তানি কমে যাওয়ার পাশাপাশি প্রচুর পরিমাণ মজুতের কারণে আড়তদার ও ট্যানারির মালিকেরা যত কম দামে কেনা যায়, সেই পরামর্শ দিয়েছেন। সে কারণে তাঁরা সরকার–নির্ধারিত দামের চেয়ে কমে চামড়া কিনেছেন। অন্যথায় পুঁজি ওঠানো নিয়ে শঙ্কা থাকবে।

জানতে চাইলে বাণিজ্যসচিব মো. জাফরউদ্দীন প্রথম আলোকে বলেন, ‘কোরবানির চামড়ার কম দামের পেছনে কারা দায়ী, তাদের চিহ্নিত করা হচ্ছে। কয়েক দিনের মধ্যে বৈঠক হবে। তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা হচ্ছে। তবে লবণযুক্ত চামড়ার দাম ততটা কমেনি। আমাদের নির্ধারিত দামের কাছাকাছি রয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘করোনার কারণে চলতি বছর ৩০-৪০ শতাংশ কোরবানি কম হয়েছে। এরপরও চট্টগ্রামে ১০০০-১২০০ চামড়া নদীতে ফেলার ঘটনায় কষ্ট পেয়েছি।’

গতবার চামড়া নিয়ে নৈরাজ্যের পর ২৮ আগস্ট সচিবালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেছিলেন, ‘চামড়া নিয়ে এবার আমার শিক্ষা হয়েছে। এবারের অভিজ্ঞতা বিবেচনায় রেখে একটি পরিকল্পনা নিতে যাচ্ছি। যে পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে ভবিষ্যতে কাঁচা চামড়া সংগ্রহে বড় ধরনের কোনো সংকট তৈরি হবে না।’

বাণিজ্য মন্ত্রণালয় কেবল দাম নির্ধারণ করে বসে থাকায় কোরবানির চামড়ার দাম বিপর্যয়ের অন্যতম কারণ বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক  মো. আবু ইউসুফ। গতকাল তিনি প্রথম আলোকে বলেন, কোরবানির চামড়া বেচাকেনা প্রচলিত বাজারব্যবস্থার ওপর ছেড়ে দেওয়ায় ব্যবসায়ীরা সুযোগ নিয়েছেন। 

 দায় আছে শিল্প মন্ত্রণালয়েরও। ২০০৩ সালে সাভারের হেমায়েতপুরে আধুনিক চামড়াশিল্প নগরী প্রকল্প শুরু করে আজও পুরোপুরি শেষ করতে পারেনি তারা। যে কেন্দ্রীয় বর্জ্য পরিশোধনাগার (সিইটিপি) ১৮ মাসে শেষ হওয়ার কথা, তা আট বছরেও হয়নি। সিইটিপির কাজ শেষ না হওয়ায় ধলেশ্বরী নদী দূষিত হচ্ছে।

গত বছর কোরবানির ঈদে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় চামড়ার অস্থায়ী বাজারে ছোট গরুর একেকটি চামড়া ৩০০–৪০০ টাকা, মাঝারি আকারের গরুর চামড়া ৫০০–৬০০ এবং বড় চামড়া ৮০০ টাকা থেকে ১ হাজার টাকায় বিক্রি হয়। রাতে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়।  

কতটা কমে বিক্রি 

বাণিজ্য মন্ত্রণালয় গত সপ্তাহে চামড়াশিল্পের উদ্যোক্তাদের সঙ্গে বৈঠক করে কোরবানির পশুর চামড়ার দাম নির্ধারণ করে। ঢাকায় লবণযুক্ত গরুর চামড়ার দাম প্রতি বর্গফুট ৩৫–৪০ টাকা দর ধরা হয়। আর ঢাকার বাইরে প্রতি বর্গফুট ২৮–৩২ টাকা। এ ছাড়া সারা দেশে খাসির চামড়া প্রতি বর্গফুট ১৩–১৫ টাকা নির্ধারণ করা হয়। দরপতন ঠেকাতে কেস টু কেস ভিত্তিতে ২৯ জুলাই কাঁচা ও ওয়েট-ব্লু চামড়া রপ্তানির অনুমতি দেয় মন্ত্রণালয়। 

আড়তদারেরা জানান, বড় আকারের গরুর চামড়া ৩৫-৪০ বর্গফুট, মাঝারি আকারের গরুর চামড়া ২৫-৩০ বর্গফুট এবং ছোট আকারের গরুর চামড়া ১৬-২০ বর্গফুটের হয়। তাতে সরকার–নির্ধারিত দাম হিসাব করলে লবণযুক্ত বড় চামড়া কমপক্ষে দেড় হাজার টাকা, মাঝারি চামড়া ১ হাজার টাকা ও ছোট চামড়ার দাম হয় কমপক্ষে ৬০০ টাকা। 

তাহলে দাম কতটা কমেছে, তা জানতে একজন ট্যানারিমালিককে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, কোরবানির সময় মাঝারি আকারের চামড়াই বেশি আসে। তাতে প্রায় ২৪ বর্গফুট চামড়া থাকে। প্রতি বর্গফুটের দাম সরকারের নির্ধারিত সর্বনিম্ন ৩৫ টাকা ধরলেও ২৪ বর্গফুটের দাম আসে ৮৪০ টাকা। তার থেকে লবণ ও শ্রমিকের মজুরি বাবদ ১৫০ টাকা ও আড়তদারের মুনাফা বাবদ ৫০ টাকা বাদ দিলে ৬৪০ টাকা দাম হওয়ার কথা। অথচ সেই চামড়া বিক্রি হয়েছে ৩০০–৩৫০ টাকায়। 

ব্যবসায়ীদের পুরোনো যুক্তি

চামড়ার কম দামের কারণ জানতে চাইলে বাংলাদেশ হাইড অ্যান্ড স্কিন মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আফতাব খান প্রথম আলোকে বলেন, কাঁচা চামড়া যে দামে বিক্রি হচ্ছে, তা ঠিকই আছে। কারণ প্রতি বর্গফুট চামড়া প্রক্রিয়াজাত করতে আট টাকা খরচ হয়। তা ছাড়া আড়তদারেরা নগদ অর্থের সংকটে রয়েছেন। বেশির ভাগ ট্যানারিমালিক আড়তদারদের বকেয়া পরিশোধ করেননি। 

অবশ্য আড়তদারদের কাছে ৫৩ ট্যানারিমালিকের বকেয়া নেই বলে দাবি করেন বাংলাদেশ ফিনিশড লেদার, লেদারগুডস অ্যান্ড ফুটওয়্যার এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান মহিউদ্দিন আহমেদ।

কোরবানির চামড়ার নৈরাজ্য বন্ধে নতুন করে ভাবতে হবে বলে মন্তব্য করেন অধ্যাপক মো. আবু ইউসুফ। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ধান–চালের মতো কোরবানির চামড়া সংগ্রহে সরকারের হস্তক্ষেপ লাগবে। সরকার বড় ট্যানারির সঙ্গে চুক্তি করে প্রত্যন্ত এলাকা থেকে চামড়া কিনে তাদের দিতে পারে। সে ক্ষেত্রে স্থানীয় প্রশাসনকে কাজে লাগানো যেতে পারে।