খাদের কিনার থেকে ঘুরে দাঁড়ানো কতটা স্বস্তির

প্রবাসী আয়ে রেকর্ডের পর পণ্য রপ্তানিতেও সুসংবাদ পেল বাংলাদেশ। চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে ৩৯১ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে, যা গত ১৩ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ। করোনার এই কঠিন সময়ে তিন মাসের ব্যবধানে রপ্তানি আয় ইতিবাচক ধারায় ফেরাটা দেশের অর্থনীতির জন্য অনেকটা ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ার মতো ব্যাপার।

করোনার আগেও দেশের পণ্য রপ্তানি খুব ভালো ছিল না। বিদায়ী ২০১৯-২০ অর্থবছরের দুই মাস ছাড়া কখনোই প্রবৃদ্ধি হয়নি। সে হিসেবে গত ডিসেম্বরের পর জুলাইয়ে রপ্তানি আয় আবার ইতিবাচক ধারায় ফিরল। প্রবৃদ্ধি মাত্র দশমিক ৫৯ শতাংশ হলেও বর্তমান সময়ে অর্থনীতিকে কিছুটা হলেও দুশ্চিন্তামুক্ত করেছে। রপ্তানিকারকদের বেশ সাহস জুগিয়েছে।

হঠাৎ করে রপ্তানি আয় এতটা বেড়ে যাওয়ার পেছনে যুক্তি কী? ধারাটি কি বজায় থাকবে? প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজতে কয়েকটি খাতের রপ্তানিকারকদের দ্বারস্থ হলাম আমরা। তাঁদের ভাষ্য, করোনায় যেসব ক্রয়াদেশ বাতিল ও স্থগিত হয়েছিল, তার একটি অংশ জুলাইয়ে রপ্তানি হয়েছে। আবার ঈদের আগে সব সময়ই পণ্য জাহাজীকরণের চাপ থাকে। ঈদের আগে প্রায় পুরো মাসই উৎপাদন হওয়ায় রপ্তানির পরিমাণ বেড়েছে। তবে ঈদের ছুটিতে ৭-১০ দিন কারখানা বন্ধ থাকায় চলতি মাসের রপ্তানি জুলাইয়ের চেয়ে অনেক কম হবে।

গত জুলাইয়ে ৩৯১ কোটি ডলারের রপ্তানির মধ্যে পোশাকশিল্প থেকেই ৩২৪ কোটি ডলার এসেছে। অথচ করোনায় ক্রয়াদেশ বাতিল ও স্থগিত হওয়ায় পোশাক রপ্তানি খাদের কিনারায় চলে গিয়েছিল। এপ্রিলে রপ্তানি হয় ৩৭ কোটি ডলারের পোশাক। পরের মাসে ১২৩ কোটি ডলার। তবে দুই মাসের ব্যবধানে পোশাক রপ্তানি কিছুটা ঘুরে দাঁড়ায়। জুনে রপ্তানি হয় ২২৫ কোটি ডলারের পোশাক। জুলাইয়ে সেটি আরও শতাধিক ডলার বেড়ে যায়।

জানতে চাইলে নিট পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর সহসভাপতি মোহাম্মদ হাতেম প্রথম আলোকে বলেন, বাতিল ও স্থগিত হওয়া ক্রয়াদেশের পণ্যের একটা অংশ রপ্তানি হয়েছে। তা ছাড়া ঈদের আগে পণ্য পাঠাতে অনেক ক্রেতা চাপ দিয়েছেন। তিনি বলেন, চলতি মাসে রপ্তানি কম হবে। ক্রয়াদেশ তুলনামূলক কম। অক্টোবর-নভেম্বরে রপ্তানি বাড়তে পারে।

 করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়লে সংক্রমণ রোধে লকডাউন জারি করে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের অনেক দেশ। দোকানপাট বন্ধ হয়ে যায়। তাতে গত মার্চে একের পর এক ক্রয়াদেশ বাতিল ও স্থগিতাদেশ আসতে থাকে। সব মিলিয়ে ৩১৮ কোটি ডলারের ক্রয়াদেশ বাতিল ও স্থগিত হয়। তাতে মালিকেরা আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। সরকার রপ্তানিমুখী শ্রমিকদের মজুরি দেওয়ার জন্য ৫ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করে। সেই তহবিল থেকে প্রায় ১ হাজার ৮০০ কারখানার মালিক ২ শতাংশ সেবা মাশুলে ঋণ নিয়ে তিন মাসের মজুরি দিয়েছেন। জুলাই মাসের মজুরি দেওয়ার জন্যও ঋণ পাচ্ছেন তাঁরা।

>জুলাইয়ে ৩৯১ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে, যা গত ১৩ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ

জানতে চাইলে পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সাবেক সহসভাপতি মাহমুদ হাসান খান বলেন, মজুরির জন্য ঋণ পাওয়ায় উদ্যোক্তারা বড় ধরনের চাপ থেকে স্বস্তি পেয়েছেন। তাতে ক্রেতাদের সঙ্গে দর-কষাকষিতে সুবিধা হয়েছে। তিনি জানান, ক্রেতাপ্রতিষ্ঠান ও ব্র্যান্ড ভেদে ক্রয়াদেশ কমবেশি হচ্ছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে নিট পোশাক ও সোয়েটারের ক্রয়াদেশ সন্তোষজনক, তবে ওভেন পোশাকের ক্রয়াদেশ কিছুটা কম।

নেতিবাচক ধারা থেকে বের হতে না পারলেও পোশাক রপ্তানির গতি যেভাবে ফিরেছে, সেটিকে সুখবরই বলছেন উদ্যোক্তারা। অন্যদিকে পাট ও পাটজাত পণ্যের রপ্তানি গত মাসে ৩৮ দশমিক ২৩ শতাংশ বেড়েছে। যদিও পাটের এই সুসময়ে রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়ে তা কার্যকর করেছে সরকার। যদিও পাট খাতের উদ্যোক্তারা বলছেন, গত মৌসুমে বন্যায় পাটের ব্যাপক ক্ষতি হয়। তাতে কাঁচা পাটের দাম বেড়েছে অনেক। সে জন্য রপ্তানি আয় বেড়েছে।

এদিকে প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্য রপ্তানিতে আবার সুসময় ফিরেছে। গত জুলাইয়ে ১০ কোটি ১০ লাখ ডলারের প্রক্রিয়াজাত খাদ্য রপ্তানি হয়েছে, যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে প্রায় ৩১ শতাংশ বেশি। বিদায়ী অর্থবছরে ৮৬ কোটি ডলারের প্রক্রিয়াজাত খাদ্য রপ্তানি হয়েছিল।

বাংলাদেশ অ্যাগ্রো প্রসেসরস অ্যাসোসিয়েশনের (বাপা) সহসভাপতি সৈয়দ মো. শোয়াইব হাসান প্রথম আলোকে বলেন, স্থগিত ক্রয়াদেশের পণ্য ক্রেতারা নেওয়ায় জুলাইয়ে রপ্তানি বেড়েছে। নতুন নতুন দেশ থেকে বর্তমানে অনেক ক্রয়াদেশ আসছে। করোনায় চীন ও মালয়েশিয়ার উদ্যোক্তারা আগের মতো রপ্তানি করতে না পারায় সুযোগটি তৈরি হয়েছে।

প্রক্রিয়াজাত খাদ্যের মতো জুলাইয়ে হিমায়িত খাদ্য, চামড়াবিহীন জুতা, প্রকৌশল পণ্য, হোম টেক্সটাইল, ওষুধ, কার্পেট, রাসায়নিক পণ্য, হস্তশিল্প ও আসবাবের রপ্তানি বেড়েছে। অন্যদিকে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য এবং প্লাস্টিক পণ্যের রপ্তানি কমেছে।

চলতি অর্থবছরের জন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ৪ হাজার ১০০ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। জুলাইয়ে যে রপ্তানি হয়েছে, তা ধারাবাহিক থাকলে লক্ষ্যমাত্রা সহজেই অর্জিত হওয়ার কথা। করোনাকালে তেমনটি হবে না, সেটি ধরে নিয়েই কঠোর নজরদারি লাগবে। সাবধানে পা ফেলতে হবে সরকার ও উদ্যোক্তাদের।