ঋণ পাচ্ছেন না উদ্যোক্তারা

তৈরি পোশাকশিল্পের উদ্যোক্তারা যত সহজে প্রণোদনা তহবিলের ঋণ পেয়েছেন, অন্যদের ক্ষেত্রে ঋণপ্রাপ্তি তত সহজ হচ্ছে না। পোশাকশিল্পেরই সহযোগী বস্ত্র ও সরঞ্জাম খাতের উদ্যোক্তাদের অনেকে ব্যাংকে আবেদন করলেও ঋণ পাচ্ছেন হাতে গোনা কিছু উদ্যোক্তা।

বস্ত্র ও সরঞ্জাম খাতের উদ্যোক্তারা অভিযোগ করছেন, ঋণের বিপরীতে নতুন করে জামানত

দাবি করছে কিছু বেসরকারি ব্যাংক। কিন্তু জামানত দেওয়ার সক্ষমতা না থাকায় তাঁদের অনেকে আবেদনই করতে পারছেন না। যে কারণে বহু উদ্যোক্তা এখন ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে হিমশিম খাচ্ছেন। ফলে সরকার যে উদ্দেশ্য নিয়ে প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে, তা পুরোপুরি বাস্তবায়ন হচ্ছে না।

অর্থনীতিতে করোনাভাইরাসের বিরূপ প্রভাব মোকাবিলায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ২৬ মার্চ ও ৫ এপ্রিল দুই দফায় ৭২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেন। এর মধ্যে রয়েছে পোশাকসহ অন্য রপ্তানিমুখী শিল্পপ্রতিষ্ঠানের শ্রমিক-কর্মচারীদের মজুরি দেওয়ার জন্য ৫ হাজার কোটি টাকা, শিল্প ও সেবা খাতের জন্য স্বল্প সুদে ৩০ হাজার কোটি টাকা এবং ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের (এসএমই) জন্য স্বল্প সুদে ২০ হাজার কোটি টাকা। তার বাইরে রপ্তানি উন্নয়ন তহবিলে ১২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা ও পুনঃ অর্থায়ন তহবিল কর্মসূচি ঋণ চালুর জন্য ৫ হাজার কোটি টাকা দেওয়া হয়।

রপ্তানিমুখী খাতের শ্রমিক-কর্মচারীদের মজুরি দিতে পাঁচ হাজার কোটি টাকার তহবিলের বড় অংশই নিয়েছেন পোশাকশিল্পের মালিকেরা। এ তহবিল থেকে মাত্র ২ শতাংশ সেবা মাশুলে ঋণ নিয়ে প্রায় ১ হাজার ৮০০ পোশাক কারখানা এপ্রিল, মে ও জুন মাসে শ্রমিক-কর্মচারীদের মজুরি দিয়েছে। এর বাইরে জুলাই মাসের মজুরি দেওয়ার জন্য নতুন করে আবারও প্রণোদনা তহবিল থেকে ঋণ পাচ্ছেন পোশাক খাতের উদ্যোক্তারা। যদিও এবার সুদের হার সাড়ে ৪ শতাংশ।

প্রণোদনা তহবিল থেকে রপ্তানিমুখী পোশাক কারখানাকে ২ শতাংশ সেবা মাশুলে ঋণ দিলেও সহযোগী বস্ত্র খাতকে ৩০ হাজার কোটি টাকার তহবিল থেকে ঋণ নিতে বলা হয়। এ ক্ষেত্রে সুদের হার ৯ শতাংশ। তবে সরকার ভর্তুকি দেবে সাড়ে ৪ শতাংশ। তার মানে উদ্যোক্তাদের দিতে হবে সাড়ে ৪ শতাংশ। পোশাকশিল্পের চেয়ে আড়াই শতাংশ বেশি সুদ হলেও তহবিলের ঋণসুবিধা পাওয়ার খবরে খুশি হয়েছিলেন বস্ত্র খাতের উদ্যোক্তারা। তবে সেটি মিলিয়ে যেতে সময় লাগেনি।

বস্ত্রকলমালিকদের সংগঠন বিটিএমএ জানিয়েছে, তহবিল থেকে ঋণ পেতে তাদের ৫৬ সদস্য প্রতিষ্ঠান আবেদন করেছে। তার মধ্যে কেবল চারটি প্রতিষ্ঠান ঋণ পেয়েছে। আবেদনের বিপরীতে অনুমোদিত ঋণের পরিমাণ কম হওয়ায় দুটি প্রতিষ্ঠান তা নেয়নি। আটটি প্রতিষ্ঠানের ঋণ আবেদন বাতিল করেছে ব্যাংক। বাকি ৪২টি প্রতিষ্ঠানের আবেদন এখন প্রক্রিয়াধীন।

জানতে চাইলে বিটিএমএ সভাপতি মোহাম্মদ আলী প্রথম আলোকে বলেন, প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণার পর গত তিন মাস কোনো আবেদনই নেয়নি বেসরকারি ব্যাংক। পরে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের চাপে গত জুলাই মাস থেকে আবেদন নিতে শুরু করে ব্যাংকগুলো। এ কারণে প্যাকেজ ঘোষণার চার মাস পেরিয়ে গেলেও ঋণ পেয়েছে মাত্র কয়েকটি প্রতিষ্ঠান।

>সরকার যে উদ্দেশ্যে প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে, তা বাস্তবায়িত হচ্ছে না
অনেক উদ্যোক্তাই টিকিয়ে রাখতে হিমশিম খাচ্ছেন
বস্ত্রকলমালিকদের সংগঠন বিটিএমএর মাত্র চারটি সদস্য প্রতিষ্ঠান ঋণ পেয়েছে।

বিটিএমএর সভাপতি অভিযোগ করে বলেন, যেসব উদ্যোক্তা উচ্চপর্যায়ে তদবির করতে পারছেন, তাঁরাই কেবল ঋণ পাচ্ছেন। তিনি আরও বলেন, বেসরকারি ব্যাংক ঋণের বিপরীতে নতুন করে জামানত চাইছে। সে কারণে অনেকে আবেদনই করতে পারছেন না। যেসব ব্যাংক জামানত দাবি করছে, তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি করেন এই উদ্যোক্তা।

বিটিএমএ জানায়, সংগঠনটির সদস্যদের মধ্যে ৪৫০টি স্পিনিং, ৮৫০টি উইভিং এবং ১৭০টি ডাইং ও ফিনিশিং কারখানা রয়েছে। বস্ত্র খাতে মোট ৭০ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ হয়েছে। তাতে নিট পোশাকের প্রয়োজনীয় সুতার ৮০-৮৫ শতাংশ এবং ওভেন পোশাকের প্রয়োজনীয় কাপড়ের ৩৫-৪০ শতাংশ জোগান দিচ্ছে দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলো।

ঋণের বিষয়ে জানতে চাইলে পূবালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুল হালিম চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, যেহেতু নতুন ঋণ, তাই নতুন করে বন্ধকি চাওয়া হচ্ছে। তবে গ্রাহকেরা সবাই দিতে রাজি হচ্ছেন না। ঋণ কারা পাবে, তা খুব দেখেশুনে দেওয়া হচ্ছে, যাতে টাকা ফেরত আসে। অনেক ভালো গ্রাহক কিন্তু বেতনের জন্য ঋণও নিচ্ছে না।

এদিকে ২০ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা তহবিল থেকে ঋণ না পাওয়ার অভিযোগ তুলেছেন পোশাকশিল্পের সহযোগী সরঞ্জাম ও মোড়কপণ্যের উদ্যোক্তারা। তাঁরা বলছেন ব্যাংক-গ্রাহক সম্পর্কের ভিত্তিতে প্রণোদনা তহবিল থেকে ঋণ দেওয়ার কথা। তবে সেই সম্পর্ক মাপার কোনো একক নেই। ফলে ব্যাংকগুলো নানা অজুহাত দেখাচ্ছে, যাতে ঋণ দিতে না হয়।

বাংলাদেশ গার্মেন্টস অ্যাকসেসরিজ অ্যান্ড প্যাকেজিং ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিজিএপিএমইএ) জানায়, তাদের ২৭টি সদস্য প্রতিষ্ঠান আবেদন করেছে। তার

মধ্যে মাত্র দুটি প্রতিষ্ঠান ঋণ পেয়েছে। দুটির আবেদন বাতিল হয়েছে। বাকি ২৩টির আবেদন প্রক্রিয়াধীন। পোশাক খাতের প্রয়োজনীয় ৯০-৯৫ শতাংশ সরঞ্জাম সরবরাহ করে এই সংগঠনের হাজারখানেক সদস্য।

জানতে চাইলে বিজিএপিএমইএর সভাপতি আবদুল কাদের খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘সরকার আন্তরিক থাকলেও জটিল ব্যাংকিং নিয়মনীতির কারণে আমরা প্রণোদনা তহবিলের ঋণ পাচ্ছি না। ঋণের জন্য নতুন করে জামানত চাইছে ব্যাংক। অধিকাংশ উদ্যোক্তারই সেই জামানত দেওয়ার সক্ষমতা নেই। আবার করোনায় যারা সময়মতো আগের ঋণের কিস্তি দিতে পারেনি, তারাও ঋণ পাচ্ছে না।’

আবদুল কাদের খান আরও বলেন, আগামী অক্টোবর পর্যন্ত ক্রয়াদেশ তেমন নেই। শ্রমিকদের বেতন-ভাতা দিতে হিমশিম খাচ্ছেন উদ্যোক্তারা। এভাবে চললে কিছুদিনের মধ্যে অনেক কারখানা বন্ধ হওয়ার শঙ্কা রয়েছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে

সহজ শর্তে প্রণোদনা তহবিলের ঋণ না দিলে পরোক্ষভাবে পোশাক রপ্তানি ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।