নির্ধারিত সময়ে কনটেইনার টার্মিনাল চালুই বড় চ্যালেঞ্জ

চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে কনটেইনার পরিবহন সূচনার ৩৭ বছর পূর্ণ হচ্ছে আজ ২২ মার্চ। এই দীর্ঘ যাত্রাপথে কনটেইনার পরিবহনের নানা দিক নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন বন্দরের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল নিজামউদ্দিন আহমেদ

নিজামউদ্দিন আহমেদ
নিজামউদ্দিন আহমেদ

প্রথম আলো: ৩৭ বছরে কনটেইনারে পণ্য পরিবহনে কতটুকু অগ্রগতি হয়েছে?
নিজামউদ্দিন আহমেদ: ১৯৭৭ সালের ২২ মার্চ ‘এস এস ট্যানাসিটি’ জাহাজে ছয় কনটেইনার পরিবহনের মাধ্যমে দেশে কনটেইনার পরিবহনের সূচনা হয়। এখন বন্দর দিয়ে বছরে সাড়ে ১৫ লাখ একক কনটেইনার পরিবহন হচ্ছে। এ সংখ্যাই বলে দিচ্ছে, কনটেইনারে পণ্য পরিবহনে যেমন জনপ্রিয় হচ্ছে, তেমনি বন্দরও এ বিপুলসংখ্যক কনটেইনার পরিবহনে সক্ষমতা অর্জন করেছে।
প্রথম আলো: পোশাক খাতের ব্যবসায়ীরা ছয় বছর আগে নির্মিত সবচেয়ে বড় কনটেইনার টার্মিনাল ‘এনসিটি’ পুরোপুরি চালুর দাবিতে সব সময় সোচ্চার ছিলেন। তাঁরা এখন হতাশ। বন্দর এখনো টার্মিনালটি কেন চালু করতে পারছে না?
নিজামউদ্দিন আহমেদ: এখন রপ্তানি পণ্যের মূল্যের হিসাবে প্রায় ৮০ শতাংশ এবং পরিমাণের হিসাবে ৪৫ শতাংশই পোশাকশিল্পের পণ্য, যেগুলো শুধু কনটেইনারে পরিবহন হয়। পোশাক খাতের পণ্য পরিবহনের কার্যক্রম গতিশীল করতে এনসিটি চালুর প্রক্রিয়া শেষ পর্যায়ে ছিল। কিন্তু দরপত্র নিয়ে মামলার কারণে কিছু করা যায়নি। ইতিমধ্যে মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে। এখন আমরাই অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি কিনে বেসরকারি অপারেটর দিয়ে পরিচালনা করব। এ জন্য আমাদের প্রস্তুতিও রয়েছে। সরকারি অনুমোদন পাওয়ার পরই কাজ শুরু হবে। বর্তমানে কিন্তু টার্মিনালটির ৩৫ শতাংশ ক্ষমতা ব্যবহার হচ্ছে।
প্রথম আলো: গত ১০ বছরে গড়ে ১০ শতাংশ করে কনটেইনার পরিবহন বাড়ছে। এই বৃদ্ধির হারের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় কতটুকু প্রস্তুত বন্দর?
নিজামউদ্দিন আহমেদ: কনটেইনার পরিবহনের হার বৃদ্ধির সঙ্গে নিয়মিত কনটেইনারকেন্দ্রিক উন্নয়নকাজ বাস্তবায়ন হচ্ছে। কনটেইনার রাখার চত্বর বাড়ানো হচ্ছে। জার্মানির গবেষণা-প্রতিষ্ঠান হামবুর্গ পোর্ট কনসাল্টিংয়ের হিসাবে, ২০২০ সালে দুই দশমিক ৯৪ মিলিয়ন একক, ২০৩০ সালে প্রায় ছয় মিলিয়ন একক এবং ২০৪৩ সালে ১০ দশমিক ২০ মিলিয়ন একক কনটেইনার পরিবহনের সম্ভাবনা আছে।
আমরা হিসাব করে দেখেছি, কনটেইনার পরিবহনের প্রবৃদ্ধির হার অনুযায়ী ২০১৫ সালের মধ্যে এনসিটি টার্মিনালটি চালু করতে হবে। না হলে বন্দরে কনটেইনার পরিবহন বাধাগ্রস্ত হবে। আবার ২০১৮ সালের মধ্যে কর্ণফুলী কনটেইনার টার্মিনাল চালু করতে হবে। এই টার্মিনালটি নির্মাণের আগে প্রা থমিক কাজ শেষ পর্যায়ে আছে। আগামী বছর কাজ শুরু করতে পারলে আমরা লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারব। এই নির্ধারিত সময়ের মধ্যে এই কনটেইনার টার্মিনাল চালু ও নির্মাণের কাজ শেষ করাই বড় চ্যালেঞ্জ মনে করছি। এরপর পর্যায়ক্রমে কনটেইনারকেন্দ্রিক উন্নয়ন কার্যক্রম অব্যাহত রাখার বিকল্প নেই।
প্রথম আলো: কনটেইনার ওঠানো-নামানোর সক্ষমতায় বন্দর যতটুকু এগিয়ে গেছে, সেই তুলনায় কনটেইনার পণ্য পরিবহনের পশ্চাদ্মুখী সংযোগে এখনো সক্ষমতা বাড়েনি। ফলে ব্যবসায়ীদেরও খরচ-সময় বেশি গুনতে হচ্ছে। এর পেছনে মূল কারণ কী?
নিজামউদ্দিন আহমেদ: পশ্চাদ্মুখী সংযোগের বিষয়টি এককভাবে বন্দরের হাতে নেই। কনটেইনার বন্দর থেকে খালাসের পর সড়ক, নৌ ও রেলপথে পরিবহনের মাধ্যম আছে। রেলের সক্ষমতা না বাড়ায় খুব বেশি কনটেইনার ঢাকার কমলাপুরে আনা-নেওয়া করা যাচ্ছে না। এ জন্য পর্যাপ্ত ওয়াগন এবং রেললাইনের সংস্কার জরুরি। আমরা রেলওয়েকে তাগাদাও দিচ্ছি। আবার অভ্যন্তরীণ নৌ-পথে সবে কনটেইনার পরিবহন শুরু হয়েছে। নৌ-পথে ২৪ ঘণ্টা কনটেইনার পরিবহনের জন্য নদী খননকাজের প্রক্রিয়া চলছে। আশা করি, এক বছরের মধ্যে নৌ-পথে বিপুলসংখ্যক কনটেইনার পরিবহন হবে। সড়কপথের ওপর নির্ভরতা কমাতে হলে রেল এবং নৌ-পথে কনটেইনার পরিবহনের বিকল্প নেই।
প্রথম আলো: কনটেইনারে পণ্য পরিবহনের পদ্ধতি উদ্ভাবনের সময় মূল উদ্দেশ্য ছিল ‘ডোর টু ডোর’ বা সরাসরি কারখানা, গুদাম বা ব্যবসায়ীর পছন্দমতো জায়গায় পণ্য আনা-নেওয়ার সেবা প্রদান। ব্যবসায়ীরা কখন এই সুবিধা পাবেন।
নিজামউদ্দিন আহমেদ: আমাদের এখানে পদ্ধতিগত সমস্যার কারণে কনটেইনারাইজেশনের মূল উদ্দেশ্য পুরোপুরি বাস্তবায়ন কঠিন। কারণ, এখনো বন্দর চত্বর থেকে কনটেইনার খুলে পণ্য খালাস নিতে হচ্ছে ব্যবসায়ীদের। এই পদ্ধতি থেকে দ্রুত বেরিয়ে আসার উপায় নেই। কারণ, এখন এনবিআর মাত্র ২৯টি আমদানি পণ্য বেসরকারি ডিপোতে খালাসের বাধ্যবাধকতা দিয়েছে। আবার এই ২৯টি পণ্যও বন্দর থেকে নিয়ে ১৭টি ডিপোতে খালাসে অনেক সময় জট তৈরি হচ্ছে। আমি মনে করি, বেসরকারি খাতে ডিপোর সংখ্যা আরও বাড়ানো দরকার। কারখানা বা গুদাম চত্বরে পণ্য খালাস বা বোঝাইয়ের অনুমতি দেয় এনবিআর। সনাতন পদ্ধতি থেকে ধাপে ধাপে বেরিয়ে এলে কনটেইনারাইজেশনের মূল উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন হবে।
প্রথম আলো: গ্যান্ট্রি ক্রেনে ঘণ্টায় সাধারণত ২৫টি কনটেইনার ওঠানো-নামানো হলেও আমাদের এখানে এখনো এই হার ঘণ্টায় ১৫টি। কনটেইনারের উৎপাদনশীলতা বাড়াতে বন্দর কী পদক্ষেপ নিচ্ছে?
নিজামউদ্দিন আহমেদ: সনাতন পদ্ধতিতে বা জাহাজের ক্রেনের মাধ্যমে কনটেইনার ওঠানো-নামানোর হার এখানে এখনো বেশি। এনসিটিতে আধুনিক গ্যান্ট্রি ক্রেনের সাহায্যে কনটেইনার ওঠানো-নামানো হলে উৎপাদনশীলতার হার অনেক বাড়বে। এরপর কেসিটি পুরো বাস্তবায়ন হলে সনাতন পদ্ধতিও উঠে যাবে। এর পরও বর্তমানে সিসিটি টার্মিনালে উৎপাদনশীলতা ভালো। কারণ, এই টার্মিনালের দুটি জেটি ব্যবহার করে বছরে ছয় লাখ একক কনটেইনার ওঠানো-নামানো হচ্ছে।
[সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মাসুদ মিলাদ, চট্টগ্রাম]