করের আওতায় আসতে পারে ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠান

.
.

ক্ষুদ্রঋণ বিতরণকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর করের খড়্গ নামছে। আগামী ২০১৪-১৫ অর্থবছরের বাজেটে এ ধরনের প্রতিষ্ঠানের আয়ের ওপর এক শতাংশ হারে আয়কর আরোপের প্রস্তাব করতে যাচ্ছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)।
এখন ক্ষুদ্রঋণ বিতরণকারী প্রতিষ্ঠানকে আয়ের ওপর কোনো ধরনের কর দিতে হয় না। শুধু বার্ষিক আয়-ব্যয়ের বিবরণী এনবিআরে জমা দেয় এসব প্রতিষ্ঠান।
নতুন কর হার বাস্তবায়িত হলে পরিচালন ব্যয় বাদ দিয়ে একটি ক্ষুদ্রঋণ বিতরণকারী প্রতিষ্ঠানের আয় যদি বছরে ১০ কোটি টাকা হয়, তবে ওই প্রতিষ্ঠানকে এক কোটি টাকা আয়কর দিতে হবে। এর ফলে ওই প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক মুনাফা এক কোটি টাকা কমে যাবে।
ক্ষুদ্রঋণ নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থার (এমআরএ) হিসাবমতে, দেশে নিবন্ধিত ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠান রয়েছে ৭২৫টি। সবই বেসরকারি খাত বা ব্যক্তিপর্যায়ের প্রতিষ্ঠান। ২০০৭ সালের জুলাই থেকে ২০১৩ সালের জুন পর্যন্ত সর্বমোট ৪৩ হাজার ২৩৮ কোটি টাকার ক্ষুদ্রঋণ বিতরণ করা হয়েছে। একই সময়ে পুঞ্জীভূত ঋণের পরিমাণ ২৫ হাজার ৭০১ কোটি টাকা। দুই কোটি ৪৬ লাখ দরিদ্র মানুষ এসব প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে জীবনমানের উন্নয়ন করছেন।
তবে করারোপের ফলে ক্ষুদ্রঋণ খাতটি ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে গ্রামীণ ব্যাংকের চেয়ারম্যান খন্দকার মোজাম্মেল হক প্রথম আলোকে বলেন, এ ধরনের করারোপ করা হলে ক্ষুদ্রঋণের সম্প্রসারণকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। মুনাফা কমলে ক্ষুদ্রঋণ বিতরণকারী প্রতিষ্ঠানগুলো গরিব মানুষকে আরও ঋণ দিতে আগ্রহী হবে না। এতে দেশের দরিদ্র মানুষেরাই ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। অন্যদিকে মুনাফার পরিমাণ ঠিক রাখতে প্রতিষ্ঠানগুলো সুদের হার বাড়িয়ে দিতে পারে বলে তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেন।
একই মত পোষণ করেছেন ক্ষুদ্রঋণবিষয়ক সরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান ইনস্টিটিউট অব মাইক্রোফিন্যান্সের (আইএনএম) নির্বাহী পরিচালক এম এ বাকী খলীলী। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘করারোপ করা হলে প্রতিষ্ঠানগুলোর মুনাফা কমে যাবে। আর এসব প্রতিষ্ঠান সাধারণত মুনাফার অর্থ আবার ঋণ দেয়। ভবিষ্যতে এভাবে মুনাফার টাকা পুনরায় ঋণ দেওয়ার প্রবণতা কমে যাবে। তখন পরিচালন খরচ কমাতে প্রতিষ্ঠানগুলো বড় ঋণ দেওয়ার দিকে ঝুঁকবে।’ এতে দরিদ্র গবির মানুষের ছোট ঋণ পাওয়ার সুযোগ সীমিত হবে বলে তিনি মনে করেন।
তবে এনবিআরের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা কিছুটা ভিন্নমত পোষণ করেছেন। একাধিক কর্মকর্তা এই প্রতিবেদককে জানিয়েছেন, ২০-২৫ বছর ধরে এই ক্ষুদ্রঋণ বিতরণকারী প্রতিষ্ঠানকে কর অব্যাহতি দিয়ে এ খাতটিকে সম্প্রসারণের সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে। একটি খাতকে অনন্তকাল ধরে কর অব্যাহতি দেওয়া উচিত নয়। এ ছাড়া করের আওতায় এলে ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানগুলোর আয়-ব্যয়ের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি আরও বাড়বে বলে তাঁরা মনে করেন।
ক্ষুদ্রঋণ ব্যবস্থার সফল প্রয়োগের জন্য বাংলাদেশ পথিকৃৎ দেশ হিসেবে সারা বিশ্বে পরিচিত। গ্রামীণ ব্যাংক, ব্র্যাকের মতো প্রতিষ্ঠান দেশে-বিদেশে সমাদৃত হচ্ছে। ক্ষুদ্রঋণের মাধ্যমে সামাজিক উন্নয়ন অবদানের জন্য ২০০৬ সালে গ্রামীণ ব্যাংক ও এর প্রতিষ্ঠাতা ড. মুহাম্মদ ইউনূস নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। এ ছাড়া আশা, প্রশিকা, টিএমএসএস বৃহৎ পরিসরে ক্ষুদ্রঋণ বিতরণ করে থাকে। এখন এসব প্রতিষ্ঠানকে কর দিতে হবে।
গ্রামীণ ব্যাংক ৮৩ লাখ সদস্যের মধ্যে ঋণ বিতরণ করে থাকে। তাঁদের প্রায় ৯৭ শতাংশই নারী। ২০১৩ সালের বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা অনুযায়ী, বর্তমানে দেশের বৃহৎ ক্ষুদ্রঋণ বিতরণকারী সংস্থা ব্র্যাক থেকে ঋণ নিয়ে সুবিধা পেয়েছেন ৫৮ লাখ ৩৫ হাজার ৮৬১ জন। আশার ঋণের সুবিধাভোগীর সংখ্যা ৪৬ লাখ ২০ হাজার। আর প্রশিকার ঋণ নিয়ে উপকার পেয়েছেন এক লাখ মানুষ।
ক্ষুদ্রঋণ বিতরণকারী প্রতিষ্ঠানগুলো জামানত ছাড়াই গরিব মানুষকে টাকা ধার দেয়। সাধারণত দুই হাজার থেকে ১২ লাখ টাকা পর্যন্ত ক্ষুদ্রঋণ দেওয়া হয়, যেন ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে তাঁরা বিনিয়োগমুখী সম্পদ তৈরি করতে পারেন। যাঁদের জামানত দেওয়ার মতো সম্পদ নেই, আবার প্রচলিত ব্যাংকিং ব্যবস্থা থেকে ঋণ নেওয়ার সুযোগও নেই, এমন জনগোষ্ঠীর জীবনমানের উন্নয়নের জন্য ক্ষুদ্রঋণ ব্যবস্থার গোড়াপত্তন হয়। স্বাধীনতার পর সত্তরের দশকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে বেসরকারি উদ্যোগে এ দেশে ক্ষুদ্রঋণ বিতরণ কার্যক্রম শুরু হয়। বড় বড় ক্ষুদ্রঋণ বিতরণকারী প্রতিষ্ঠান এখন দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের গরিব মানুষকে ঋণ দিচ্ছে।
n প্রতিষ্ঠানের আয়ের ওপর এক শতাংশ হারে আয়কর দিতে হবে
n বর্তমানে ক্ষুদ্রঋণ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো আয়কর দেয় না
n দেশে নিবন্ধিত ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠান রয়েছে ৭২৫টি
‘‘এসব প্রতিষ্ঠান সাধারণত মুনাফার অর্থ আবার ঋণ দেয়। ভবিষ্যতে এভাবে মুনাফার টাকা পুনরায় ঋণ দেওয়ার প্রবণতা কমে যাবে৷ এতে গরিব মানুষের ঋণ পাওয়ার সুযোগ কমে যেতে পারে এম এ বাকী খলীলী
নির্বাহী পরিচালক, আইএনএম