ঋণ কেলেঙ্কারি, শাহজালাল ব্যাংকের পরিচালক গ্রেপ্তার

একটি দুর্বল কোম্পানিকে ১৪০ কোটি ঋণ দিয়েছে শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক৷ বেআইনিভাবে এ ঋণ দিতে ব্যাংকের পর্ষদকে প্রভাবিত করেছেন ওই ব্যাংকেরই পরিচালক মোহাম্মদ সোলায়মান৷
এস কে স্টিল নামক ওই প্রতিষ্ঠানের নামে এই ঋণ দেওয়া হলেও ব্যাংক পরে তদন্ত করে দেখেছে, এ থেকে বেশ কিছু টাকা স্থানান্তরিত হয়েছে প্যারাডাইস করপোরেশন নামক আরেকটি প্রতিষ্ঠানের হিসাবে৷ প্যারাডাইস করপোরেশনের মালিক মোহাম্মদ সোলায়মানেরা তিন ভাই৷ সোলায়মানের অন্য দুই ভাইয়ের নাম এনামুল হক ও আনিসুল হক৷ আর এতে সহযোগিতা করেছেন ব্যাংকের জুবিলি রোড শাখার সাবেক ব্যবস্থাপক আ ন ম জাহাঙ্গীর৷ বর্তমানে বরখাস্ত এই কর্মকর্তা মোহাম্মদ সোলায়মানদের আপন ভাগনে৷
গতকাল সন্ধ্যায় ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত এক সংবাদ সম্মেলনে ব্যাংকের চেয়ারম্যান এ কে আজাদ এসব কথা বলেন৷
এ ঘটনায় শাহজালাল ব্যাংকের পরিচালক ও সাবেক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সোলায়মানকে গতকাল বুধবার রাজধানী থেকে গ্রেপ্তার করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)৷ গত ১৩ এপ্রিল চট্টগ্রামের কোতোয়ালি থানায় শাহজালাল ব্যাংকের চট্টগ্রাম জুবিলি রোড শাখার বর্তমান ব্যবস্থাপক রাশেদ সরওয়ারের করা মামলায় তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয় বলে জানান এ কে আজাদ৷ ব্যাংকের কোনো পরিচালকের গ্রেপ্তার হওয়ার ঘটনা দেশের ইতিহাসে এই প্রথম৷
এ কে আজাদ আরও বলেন, ২০১০-১১ সালে মোহাম্মদ সোলায়মান নিজেও ব্যাংকটির চেয়ারম্যান ছিলেন৷ কিন্তু পরে মিথ্যা তথ্য দিয়ে ও প্রতারণার মাধ্যমে এস কে স্টিল নামক কোম্পানিকে ঋণ পাইয়ে দেন তিনি৷ ব্যাংকের পর্ষদকে তিিন এমন আশ্বাসও দিয়েছিলেন যে এই প্রতিষ্ঠান ঋণ ফেরত না দিলে তিনি নিজে দেবেন৷ ব্যাংক পরে তদন্ত করে দেখে, এস কে স্টিলের তহবিল থেকে মোহাম্মদ সোলায়মানের নিজের প্রতিষ্ঠানে ৬১টি চেকের মাধ্যমে ১৮ কোটি ৬৮ লাখ টাকা স্থানান্তরিত হয়েছে৷
তবে গ্রেপ্তারের ঠিক আগে মোহাম্মদ সোলায়মান প্রথম আলোকে বলেন, ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের দ্বন্দ্বে তাঁর বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ ওঠানো হয়েছে।øগতকাল বেলা আড়াইটায় গ্রেপ্তারের পরও মোহাম্মদ সোলায়মান দুদকের ভেতরে প্রবেশ করতে করতে সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমি এ কে আজাদের ষড়যন্ত্রের স্বীকার৷ তাঁর বিরুদ্ধে কথা বলায় আমার এ অবস্থা।’
এর আগে ৬ মার্চ এস কে স্টিলের বিরুদ্ধে প্রতারণা ও ১৪০ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে চট্টগ্রাম কোতোয়ালি থানাতেই আরেকটি মামলা করেন রাশেদ সরওয়ার। ওই মামলায় এস কে স্টিলের তিন অংশীদার (তিন সহোদর) নাজিমউদ্দিন চৌধুরী, এ এইচ এম কামাল হোসেন চৌধুরী, শিহাব উদ্দিন চৌধুরী ও তাঁদের স্ত্রীসহ মোট সাতজনকে আসামি করা হয়৷ তবে মোহাম্মদ সোলায়মানকে আসামি করা হয়নি।
এ বিষয়ে মামলার বাদী রাশেদ সরওয়ার প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রথমে আমরা এস কে স্টিলের বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাতের মামলা করি৷ তখনো শাখা ব্যবস্থাপক ও পরিচালক মোহাম্মদ সোলায়মানের সম্পৃক্ততার বিষয়টি জানা ছিল না৷ পরে ব্যাংকের করা তদন্তে এই দুজনের জড়িত থাকার বিষয়টি বেরিয়ে এলে আমরা মামলা করি৷’
গ্রেপ্তার: এই মামলার বিষয়ে খোঁজখবর করতে প্রথম আলোর পক্ষ থেকে মোহাম্মদ সোলায়মানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়৷ তিনি গতকাল বুধবার তাঁর রাজধানীর বিজয়নগরের কার্যালয়ে যেতে বলেন৷ তাঁর সঙ্গে কথা বলার সময়ই দুদকের একটি দল তাঁকে ধরে নিয়ে যায়৷
মোহাম্মদ সোলায়মান এস কে স্টিলের সঙ্গে ব্যবসায়িক সম্পৃক্ততার কথা এ সময় স্বীকার করে বলেন, ‘এস কে স্টিলের ব্যবসািয়ক লেনদেন ভালো৷ চট্টগ্রামের বেশ কটি ব্যাংকের সঙ্গে তাঁদের কোটি কোটি টাকা লেনদেন রয়েছে৷ আমাকে ফাঁসাতে এস কে স্টিলকে ইচ্ছে করেই খেলাপি বানানো হয়েছে।’
এদিকে সংবাদ সম্মেলনের আগে প্রধান কার্যালয়ে গতকাল ব্যাংকের জরুরি পর্ষদ সভাও অনুষ্ঠিত হয়৷ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফরমান অার চৌধুরীসহ ১২ জন পরিচালক এতে উপস্থিত ছিলেন৷ সভায় জয়নব স্টিল ও নাসির অ্যান্ড ব্রাদার্স নামক আরও দুই প্রতিষ্ঠানে বেআইনিভাবে ২৫ কোটি টাকা বিনিয়োগের ঘটনা নিয়ে অালোচনা হয়েছে বলে জানান এ কে আজাদ৷ তিনি বলেন, এ ঘটনায়ও মোহাম্মদ সোলায়মানের যোগসাজশ রয়েছে৷ জয়নব স্টিল থেকেও প্যারাডাইস করপোরেশনে সাত কোটি ৬২ লাখ টাকা স্থানান্তিরত হয়েছে৷ সে কারণে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ আরেকটি মামলা করার প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে জানান এ কে আজাদ৷
তাহলে কি ঋণ পাওয়ার ব্যাপারে ব্যাংকের পর্ষদকে প্রভাবিত করা যায় এমন এক প্রশ্নের জবাবে এ কে আজাদ বলেন, ‘সরল বিশ্বাসে তাঁর কথা পর্ষদ মেনে নিয়েছিল। আমরা বুঝতে পারিনি। সেই দায় স্বীকার করছি।’
সোলায়মানের বক্তব্য: দুদকে অপেক্ষমাণ সাংবাদিকদের মোহাম্মদ সোলায়মান গতকাল বলেন, ‘এ কে আজাদ ব্যাংকের পর্ষদ থেকে আমাকে অপমান ও অপসারণের অপচেষ্টা করছেন। তাঁর কারণেই শক্তিশালী আর্থিক ভিত্তির একটি ব্যাংক ক্রমেই দুর্বলতার দিকে যাচ্ছে।’ তিনি বলেন, ‘ভুয়া সনদধারী এ কে আজাদের বোন ও কয়েকজন পরিচালকের আত্মীয়ের তথ্য বের করা ও পর্ষদে ভুয়া বিলের বিরোধিতা করায় আমার এ অবস্থা।’
এ সময় সাংবাদিকেরা জানতে চান, ‘আপনি কি মনে করছেন এ কে আজাদ দুদককে ব্যবহার করেছে?’ তিনি বলেন, ‘আমি দুদকের বিষয়ে কিছু বলব না৷ আমি ষড়যন্ত্রের শিকার৷’