আবারও সুগন্ধি চাল রপ্তানির সুযোগ

অর্থ পাচার রোধ ও অভ্যন্তরীণ সরবরাহ ঠিক রাখার স্বার্থে ছয় বছর আগে সব ধরনের চাল রপ্তানিই বন্ধ করে দিয়েছিল সরকার৷ বিশ্বমন্দার কারণে তখন বিশ্বজুড়েই খাদ্যপণ্যের দাম বেড়ে গিয়েছিল৷ পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে এলে দুই বছর আগে শুধু সুগন্ধি চাল রপ্তানির সুযোগ দেয় সরকার, বর্তমানেও যা অব্যাহত রয়েছে৷
সম্প্রতি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে জারি হয় আরেক নতুন আদেশ। এতে সুগন্ধি চাল রপ্তানির সুযোগটি বৃদ্ধি করা হয় আরও এক বছরের জন্য৷
এতে বলা হয়, ২৫ প্রজাতির সুগন্ধি চাল এখন রপ্তানি করা যাবে। তবে সুগন্ধি ছাড়া অন্য কোনো চাল রপ্তানি করা যাবে না। আবার সুগন্ধি চাল রপ্তানি করতে চাইলেও সরকারের অনুমতি নিতে হবে৷ অভ্যন্তরীণ বাজারে চালের সরবরাহ বৃদ্ধি, বাজারমূল্য নিয়ন্ত্রণ ও মূল্যের ঊর্ধ্বগতি রোধের কথা বিবেচনা করে সাধারণ চাল বাদ দিয়ে শুধু সুগন্ধি চালের ব্যাপারেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় বলে আদেশে উল্লেখ করা হয়। আদেশের কার্যকারিতা বহাল থাকবে আগামী ১ জুলাই থেকে ২০১৫ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত।
দেশে অনেক ধরনের সুগন্ধি চাল থাকলেও রপ্তানিযোগ্য সুগন্ধি চালের একটি তালিকা রয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের। আদেশে বলা হয়েছে, এই তালিকার বাইরে কোনো সুগন্ধি চাল রপ্তানি করা যাবে না। রপ্তানিযোগ্য সুগন্ধি চালগুলো হচ্ছে: কালিজিরা, কািলজিরা টিপিএল-৬২, চিনিগুঁড়া, চিনিআতপ, চিনিকানাই, বাদশাভোগ, কাটারিভোগ, মদনভোগ, রাঁধুিনপাগল, বাঁশফুল, জটাবাঁশফুল, বিন্নাফুল, তুলসীমালা, তুলসীআতপ, তুলসীমণি, মধুমালা, খোরমা, সাককুর খোরমা, নুনিয়া, পশুশাইল, বিআর-৫ (দুলাভোগ), ব্রি ধান-৩৪, ব্রি ধান-৩৭, ব্রি ধান-৩৮ ও ব্রি ধান-৫০৷
শর্তসাপেক্ষে প্রতিবছরই সরকার সুগন্ধি চাল রপ্তানির সুযোগ দিয়ে থেকে। বিশ্বমন্দার সময় (২০০৭-০৮) বিশ্বব্যাপী খাদ্যপণ্যের মূল্য বেড়ে গেলে স্বাভাবিক কারণে তার প্রভাব পড়ে বাংলাদেশেও। ওই সময় বাংলাদেশ থেকে সুগন্ধি চালের আড়ালে সাধারণ চালও রপ্তানি হচ্ছিল বলে সরকারের নজরে আসে৷ এক শ্রেণির ব্যবসায়ী অর্থ পাচার করতে তখন এ হীন কৌশল বেছে নিয়েছিলেন বলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে৷
মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, এ কারণে ২০০৮ সালে গত তত্ত্বাবধায়ক সরকার সব ধরনের চাল রপ্তানিতেই নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে৷ ২০০৯ সালের ১৯ মে জারি করা এক আদেশে ওই নিষেধাজ্ঞা বহাল রাখে আওয়ামী লীগ সরকারও৷ তবে তখনকার নিষেধাজ্ঞার একটি নেতিবাচক প্রভাবও পড়ে৷ এই ফাঁকে বাংলাদেশের সুগন্ধি চাল রপ্তানির বাজার দখল করে নেয় ভারত ও পাকিস্তান৷ দেশ দুটির বাসমতি চাল রপ্তানির সুযোগ তখন বেড়ে যায়৷ বাংলাদেশ হারায় তার নিজের বাজার।
বাংলাদেশ চাল রপ্তানিকারক সমিতির সভাপতি (তিনি নিজেও একজন সুগন্ধি চাল রপ্তানিকারক) শাহ আলম প্রথম আলোকে বলেন, শুধু প্রবাসী বাংলাদেশি নয়, সুগন্ধি চালের ব্যাপারে সম্প্রতি বিদেশিদেরও আগ্রহ দেখা যাচ্ছে৷ সুগন্ধি চাল রপ্তানির নামে যাদের বিরুদ্ধে অর্থ পাচারের অভিযোগ রয়েছে, বিচারের আওতায় নিয়ে আসা উচিত শুধু তাঁদেরই৷ জাতীয় স্বার্থে কখনো সুগন্ধি চাল রপ্তানিও যদি বন্ধ করতেই হয়, মন্ত্রণালয়ের উচিত হবে এর চতুর্মুখী প্রভাব বিশ্লেষণ করা৷
তবে সরকার ২০১২ সালে আবার সুগন্ধি চাল রপ্তানির সুযোগ দেয়, যা এখনো অব্যাহত রয়েছে৷ কোনো জাল-জালিয়াতি না থাকলে প্রতিবছরই এই আদেশ দেওয়া হবে বলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে জানান।
দেশে ঈদ, পূজা, বিয়ে, জন্মদিনসহ বিশেষ অনুষ্ঠান ও উৎসবে সুগন্ধি চালের ব্যবহার রয়েছে৷ তবে রপ্তানি করা সুগন্ধি চালের প্রধান ভোক্তা প্রবাসী বাংলাদেশিরা৷ বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, ২০ জন রপ্তানিকারককে গত এক বছরে ১০ হাজার ৯৭২ টন সুগন্ধি চাল রপ্তানির অনুমোদন দেওয়া হয়েছে৷ এর মধ্যে রপ্তানি হয়েছে তিন হাজার ৯২৭ টন সুগন্ধি চাল। এক বছরে বৈদেশিক মুদ্রা আয় হয়েছে প্রায় ৬৮ লাখ ডলার।
আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিটন (এক টনে এক হাজার কেজি) সুগন্ধি চালের গড় দাম দেড় হাজার থেকে এক হাজার ৭০০ ডলার৷ দেশ থেকে সবচেয়ে বেশি সুগন্ধি চাল প্রাণ গ্রুপের মাধ্যমে রপ্তানি হয় বলে মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়। প্রাণ গ্রুপ সূত্র জানায়, গত বছর যুক্তরাষ্ট্রে তারা যে চাল রপ্তানি করে, ২৫ কেজি চালের বস্তার দাম ছিল ৪২ ডলার। বাংলাদেশি মুদ্রায় এক কেজির দাম পড়ে ১৩২ টাকা৷
যোগাযোগ করলে প্রাণ গ্রুপের বিপণন বিভাগের পরিচালক কামরুজ্জামান খান কামাল তা স্বীকার করে জানান, যুক্তরাষ্ট্র, দক্ষিণ কোরিয়া, মালয়েশিয়া, মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ, এমনকি ভারতেও তারা সুগন্ধি চাল রপ্তানি করেন৷ বেশি করেন চিনিগুঁড়া প্রজাতির চাল। দুই হাজার ৫০০ টন চাল রপ্তানির অনুমোদন চেয়ে মন্ত্রণালয়ে আবেদন রয়েছে বলেও জানান তিনি৷
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিআরআরআই) ব্রি ধান ৫০ নামে একটি সুগন্ধি চাল উদ্ভাবন করে৷ ২০০৮ সালে এই ধান কৃষকের কাছে আসে ‘বাংলামতি’ নাম নিয়ে। সুগন্ধির মধ্যে বর্তমানে এর উৎপাদনই সবচেয়ে বেশি৷