'হয়রানি চাই না, মূসক দিতে চাই'

নরসিংদী শহরের সাটিরপাড়া এলাকায় ছোট একটি কারখানা দিয়ে মেসার্স টেকনো ড্রাগসের যাত্রা শুরু হয় ১৯৯৬ সালে।এই ওষুধ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান প্রথমে ২০-৩০ জন কর্মী দিয়ে কারখানা চালু করে।বর্তমানে এই প্রতিষ্ঠানে সাড়ে পাঁচ শ কর্মী কাজ করেন। আর প্রতিষ্ঠানটির ব্যবসা সম্প্রসারিত হওয়ায় নরসিংদীর বিসিকে আরও দুটি কারখানা নির্মাণ করা হয়েছে।প্রতিষ্ঠানটি প্রতিবছরই রাষ্ট্রের কোষাগারে উৎপাদন ও বিক্রির ওপর মূল্য সংযোজন কর (মূসক) দেয়।

১৯৯৬-৯৭ অর্থবছরে ১২ লাখ টাকা মূসক দিয়েছিল প্রতিষ্ঠানটি।ব্যবসা সম্প্রসারিত হওয়ায় প্রতিবছরই মূসকের পরিমাণও বেড়েছে। সর্বশেষ ২০১২-১৩ অর্থবছরে টেকনো ড্রাগস মোট ১১ কোটি ৯০ লাখ টাকা মূসক দিয়েছে, যা উৎপাদন পর্যায়ে নরসিংদী জেলায় সর্বোচ্চ।এর স্বীকৃতিস্বরূপ জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) এ বছর প্রতিষ্ঠানটিকে বিশেষ সম্মাননা দিয়েছে।

প্রতিষ্ঠানটির মহাব্যবস্থাপক অখিল দত্ত প্রথম আলোকে বলেন, ‘কর মানেই একটি ভীতির বিষয় ছিল। কর প্রদান ব্যবস্থা সহজ করায় এখন অনেক প্রতিষ্ঠানই মূসক প্রদানে উৎসাহিত হচ্ছে। এ ছাড়া এনবিআর আমাদের মতো জেলা পর্যায়ের প্রতিষ্ঠানকে সম্মাননা দেওয়ায় অন্য প্রতিষ্ঠানগুলো মূসক প্রদানে আরও উৎসাহিত হবে। এনবিআরের এ ধরনের উদ্যোগ খুবই ভালো ও অনুপ্রেরণাদায়ক। তবে হয়রানি কমানো গেলে আরও বেশি রাজস্ব আদায় করা সম্ভব।’

শুধু টেকনো ড্রাগস নয়, এ বছর মোট ১২২টি প্রতিষ্ঠানকে বিশেষ সম্মাননা দিয়েছে এনবিআর। মহাখালীর রাওয়া মিলনায়তনে এ সম্মাননা অনুষ্ঠান হয় গতকাল বৃহস্পতিবার। 

প্রচার-প্রচারণার অংশ হিসেবে তিন বছর ধরে ১০ জুলাই মূসক দিবস পালন করছে এনবিআর। দিবসটি উপলক্ষে প্রতিবছরই জাতীয় ও জেলা পর্যায়ে সর্বোচ্চ মূসক প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানকে সম্মাননা দেয় দেশের প্রধান রাজস্ব আদায়কারী সংস্থাটি। উৎপাদন, সেবা ও ব্যবসা—এ তিন ক্যাটাগরিতে জাতীয় ও জেলা পর্যায়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে সম্মাননা দিয়ে এনবিআর মূলত কর প্রদানের সংস্কৃতিকে উৎসাহিত করার চেষ্টা করছে।

জাতীয় পর্যায়ে নয়টি প্রতিষ্ঠানকে এবার সম্মাননা দেওয়া হয়েছে। প্রতিষ্ঠানগুলো হলো উৎপাদন পর্যায়ে হবিগঞ্জের রশিদপুর কনডেনসেট ফ্রাকশনেশন প্লান্ট লিমিটেড, মৌলভীবাজারের ফেঞ্চুগঞ্জ গ্যাসফিল্ড প্রজেক্ট লিমিটেড ও বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম এক্সপ্লোরেশন অ্যান্ড প্রডাকশন লিমিটেড, সেবা পর্যায়ে আরএফএল প্লাস্টিকস লিমিটেড, টিইউভি এসইউডি বাংলাদেশ (প্রাইভেট) লিমিটেড ও ন্যাশনাল টেলিভিশন লিমিটেড, ব্যবসা পর্যায়ে হুওয়াই টেকনোলজিস বিডিস লিমিটেড, মেসার্স এম এম ইস্পাহানী এবং ব্র্যাক আড়ং। এ ছাড়া জেলা পর্যায়ে তিনটি ক্যাটাগরিতে মোট ১১৩টি প্রতিষ্ঠান এ সম্মাননা পেয়েছে।

উল্লেখ্য, এনবিআর যে পরিমাণ রাজস্ব আদায় করে, এর ৩৬ শতাংশের বেশি মূসক খাত থেকে আসে। ২০১২-১৩ অর্থবছরের মূসক খাত থেকে ৪০ হাজার কোটি টাকা আদায় হয়েছিল। সে বছর এনবিআর মূসক, শুল্ক ও আয়কর থেকে মোট এক লাখ ১০ হাজার কোটি টাকা আদায় করেছিল।  

 তবু অভিযোগের অন্ত নেই: মূসক প্রদানে উৎসাহিত করার জন্য প্রতিবছর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে সম্মাননা দেয় এনবিআর। এ সম্মাননা দেওয়ার উদ্দেশ্য হলো মূসকদাতা প্রতিষ্ঠানের মালিকেরা নিয়মিত মূসক প্রদানে উৎসাহিত হবেন, ফাঁকি দেবেন না। তবে অভিযোগ রয়েছে, মূসক কর্মকর্তারা দোকান বা ছোট ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে গিয়ে কর ফাঁকির অভিযোগ এসে নথিপত্র জব্দ করে নিয়ে আসেন। বিষয়টি ‘সুরাহা’ না হওয়া পর্যন্ত এসব দলিল জব্দ করে রাখেন মূসক কর্মকর্তারা। 

গতকালের সম্মাননা প্রদান অনুষ্ঠানে বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ, প্রধানমন্ত্রীর অর্থনীতিবিষয়ক উপদেষ্টা মসিউর রহমানের উপস্থিতিতে মূসক কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে হয়রানির অভিযোগের আঙুল তুললেন অনেক ব্যবসায়ী। তাঁরা অভিযোগ করেন, মাঠপর্যায়ে মূসক কর্মকর্তারা নানা ধরনের হয়রানি করেন। ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে গিয়ে কাগজপত্র জব্দ করে নিয়ে আসেন। এ ছাড়া অন্যায্যভাবে মূসক আদায়ের অভিযোগও করেন তাঁদের অনেকে।

এ সময় অনুষ্ঠানে উপস্থিত এনবিআরের কর্মকর্তারা বিব্রতবোধ করেন। এনবিআরের সদস্য ফরিদউদ্দিন এসব অভিযোগ এ ধরনের অনুষ্ঠানে না করার অনুরোধ করেন।

ঢাকা মহানগর দোকান মালিক সমিতির সভাপতি তৌফিক হাসান জানান, ঈদের মৌসুমের বেচাকেনা যখন বাড়ছে, তখন রাজধানীর বিভিন্ন দোকানে গিয়ে নথি জব্দ করেছেন মূসক কর্মকর্তারা। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ব্যবসায়ীরা এ সময় হাততালি দিয়ে এ অভিযোগের সঙ্গে একমত প্রকাশ করেন।

পরে প্রধান অতিথির ভাষণে তোফায়েল আহমেদ ব্যবসায়ীদের হয়রানি না করার নির্দেশ দিয়ে বলেন, রোজার মাসে খাতাপত্র নিয়ে যাওয়া হয়, এগুলোর ব্যাপারে আরও যত্নবান হতে হবে। এনবিআর যেন বাড়াবাড়ি না করে। ব্যবসায়ী ও এনবিআর কর্মকর্তাদের মধ্যে যেন মধুর সম্পর্ক থাকে, সেই চেষ্টা করতে হবে।

ব্যবসায়ীদের আশ্বস্ত করে এনবিআর সদস্য ফরিদউদ্দিন বলেন, ‘কোনো ধরনের হয়রানি হলে সরাসরি আমাদের জানাবেন। সঙ্গে সঙ্গে আমরা ব্যবস্থা নেব।’  

বগুড়ার সৈকত হোটেলের চেয়ারম্যান ও বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির মহাসচিব এম রেজাউল করিম সরকার মনে করেন, বাংলাদেশে এখনো কর প্রদানের সংস্কৃতি গড়ে ওঠেনি। তিনি বলেন, ‘আমরা (রেস্তোরাঁ মালিক) হলাম মূসক সংগ্রহকারী। সেবা গ্রহণকারীর কাছ থেকে মূসক আদায় করে এনবিআরকে তা দিই আমরা। কিন্তু রেস্তোরাঁয় খেতে এলে আমরা জোর করে তাঁদের কাছ থেকে মূসক আদায় করতে পারি না। তাহলে বছরের পর বছর কেন আমরা এনবিআরকে মূসক দেব? এটা তো আমাদের দেওয়ার কথা নয়।’

অনুষ্ঠানে জাতীয় পর্যায়ে সম্মাননাপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের হাতে ক্রেস্ট ও সম্মাননা সনদ তুলে দেন বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ। এ ছাড়া অনুষ্ঠানে ঢাকা বিভাগের ঢাকা, মুন্সিগঞ্জ, নরসিংদী, গাজীপুর, ময়মনসিংহ, মানিকগঞ্জ, টাঙ্গাইল, জামালপুর, নেত্রকোনা জেলার ২৭ জন মূসকদাতাকে এ সম্মাননা দেওয়া হয়।

এদিকে মূসক দিবসের প্রচারণার অংশ হিসেবে সকালে সেগুনবাগিচা রাজস্ব ভবনের সামনে থেকে একটি বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা বের করা হয়। এতে এনবিআরের কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ বিভিন্ন স্তরের মানুষ অংশ নেন। শোভাযাত্রাটি মৎস্য ভবন, প্রেসক্লাব হয়ে আবার রাজস্ব ভবনের সামনে এসে শেষ হয়।