সাড়ে পাঁচ বছরে খেলাপি ঋণ বৃদ্ধি ২৮৪৪ শতাংশ

আওয়ামী লীগ ২০০৯ সালে ক্ষমতা নেওয়ার সময় রাষ্ট্রমালিকানাধীন বেসিক ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ছিল ১৪১ কোটি ২৩ লাখ টাকা। সাড়ে পাঁচ বছর পর সেই খেলাপি ঋণ বেড়ে হয়েছে চার হাজার ১৫৭ কোটি ৫০ লাখ টাকা। খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির হার দুই হাজার ৮৪৪ শতাংশ। আবার সে সময়ে ব্যাংকটির মুনাফা ছিল ৬৪ কোটি টাকা, এখন লোকসান ৫৩ কোটি টাকা।
এই সরকারেরই নিয়োগ দেওয়া ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদ একসময়ের অন্যতম ভালো এই ব্যাংকটিকে ধ্বংসের মুখে নিয়ে গেছে। গত সাড়ে পাঁচ বছরে বেসিক ব্যাংক থেকে প্রায় সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। আর এ কাজে সব ধরনের সহযোগিতা করেছে ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদ।
গতকাল বৃহস্পতিবার সংসদ ভবনে সরকারি প্রতিষ্ঠান-সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে সংসদীয় কমিটি সরকারি টাকা লোপাটের জন্য ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদকে অভিযুক্ত করে দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে সুপারিশ করেছে। এ ছাড়া দুর্নীতির বিষয়টি তদন্ত করে তা সংসদীয় কমিটিকে জানাতে বলা হয়েছে।
সংসদীয় কমিটিকে অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ ব্যাংকটির বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে একটি প্রতিবেদন দিয়েছে। সেখানেও পর্ষদের নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির বিবরণ দেওয়া হয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয় পর্ষদকে দায়ী করলেও তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থাই নেওয়া হয়নি। সে সময় ব্যবস্থা নেওয়া হলে অর্থ আত্মসাতের পরিমাণ অনেক কম হতো।
গণমাধ্যমে প্রায় দুই বছর ধরে লেখালেখি হলেও অর্থ মন্ত্রণালয় ৬ জুলাই ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দেয়। তার আগে ৪ জুলাই অভিযুক্ত চেয়ারম্যান শেখ আবদুল হাই স্বাস্থ্যগত কারণ দেখিয়ে পদত্যাগ করেন। তাঁর পদত্যাগপত্র সরকার গ্রহণ করে ৬ জুলাই। আর এর মাধ্যমেই সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের মূল দায়ী ব্যক্তিকে ‘সম্মানজনক’ বিদায় দেয় সরকার। একই দিন নতুন চেয়ারম্যান হিসেবে আলাউদ্দিন এ মজিদকে নিয়োগ দেওয়া হয়। ৭ জুলাই আরও চারজন পরিচালক নিয়োগ করা হয়।
গতকাল বৈঠক শেষে কমিটির সভাপতি শওকত আলী সাংবাদিকদের বলেন, যাঁরা জড়িত তাঁদের বরখাস্ত করা যথেষ্ট নয়। তাঁদের আইনের আওতায় এনে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে এবং তাঁদের কাছ থেকে সরকারের টাকা আদায় করতে হবে। কমিটি এখন পর্যন্ত এই দুর্নীতির সঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংশ্লিষ্টতা পায়নি বলে কমিটির সভাপতি জানান।
এদিকে দুর্নীতির তদন্ত নিয়েও রয়েছে নানা বিভ্রান্তি। সংসদীয় কমিটিকে দেওয়া প্রতিবেদনে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ বলছে, ইতিমধ্যে দুদক ও বাংলাদেশ ব্যাংক সংঘটিত অনিয়মের বিষয়ে তদন্ত শুরু করেছে। অথচ গত সোমবার দুদক বলেছে, তারা বেসিক ব্যাংক নিয়ে কোনো তদন্ত করছে না। মূলত সরকারের শীর্ষ মহলের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত শেখ আবদুল হাইকে রক্ষার জন্যই কোনো তদন্ত করছে না দুদক।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ সামগ্রিক বিষয়ে প্রথম আলোকে বলেন, বেসিক ব্যাংকের খারাপ অবস্থার চিত্র বাংলাদেশ ব্যাংক সব সময়ই অর্থ মন্ত্রণালয়কে জানিয়ে আসছিল। কিন্তু মালিক হিসেবে অর্থ মন্ত্রণালয় কোনো দায়িত্ব পালন করেনি বা কারও বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।
উদাহরণ দিয়ে সাবেক এই ডেপুটি গভর্নর বলেন, এক মাস আগেই বেসিক ব্যাংকের পর্ষদ ভেঙে দেওয়ার সুপারিশ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। অর্থ মন্ত্রণালয় সেই সুপারিশ আমলে না নিয়ে বরং ধরে রেখেছে। পর্ষদের চেয়ারম্যানকে পদত্যাগের সুযোগ করে দিয়েছে। এতে ক্ষতি যেটা হয়েছে, জনগণের কাছে এমন একটা ধারণা গেছে যে, বেসিক ব্যাংকের চেয়ারম্যানের পেছনে সরকারের শক্তিশালী একটি অংশ রয়েছে।
এদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, ঋণের নামে বেসিক ব্যাংকে যে সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে, এরই বড় অংশকে খেলাপি হিসেবে শ্রেণিবিন্যাস করা হয়েছে। এই অর্থ আদায়ের সম্ভাবনা নেই বলেই মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। সংসদীয় কমিটিকে দেওয়া মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনেও বলা হয়েছে, ২০০৯ সালের পর থেকে ক্রমান্বয়ে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ বেড়েছে। ২০১০ সালে ছিল ২২৪ কোটি টাকা, ২০১১ সালে ২৪৯ কোটি, ২০১২ সালে ৭০৬ কোটি এবং ২০১৩ সালে তিন হাজার ১৪৫ কোটি টাকা। আর সর্বশেষ জুন পর্যন্ত হিসাবে খেলাপি ঋণ ছিল চার হাজার ১৪৭ কোটি ৫০ লাখ টাকা।
২০০৯ সালে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৪ দশমিক ৮৩ শতাংশ, বর্তমানে তা ৩৬ দশমিক ৫৫ শতাংশ।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বেসিক ব্যাংক ২০০৯ সালে নয়টি প্রতিষ্ঠানকে মোট মূলধনের ৪৫৬ কোটি টাকা, ২০১০ সালে আটটি প্রতিষ্ঠানকে মোট মূলধনের ৪৯৪ কোটি টাকা, ২০১১ সালে ১২টি প্রতিষ্ঠানকে মোট মূলধনের ৮৮১ কোটি টাকা, ২০১২ সালে ২৩টি প্রতিষ্ঠানকে মোট মূলধনের এক হাজার ৯৬৫ কোটি টাকা এবং ২০১৩ সালে ২০টি প্রতিষ্ঠানকে মোট মূলধনের দুই হাজার ৩০৫ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে। বর্তমানে ব্যাংকটির মূলধন ঘাটতির পরিমাণ এক হাজার ৩৭ কোটি টাকা। মূলধন থাকার কথা এক হাজার ১৩৩ কোটি টাকা, আছে ৪৭৪ কোটি টাকা। এ ক্ষেত্রে ঘাটতির পরিমাণ ৬৫৮ কোটি টাকার বেশি।
ঋণ বিতরণে অনিয়ম সম্পর্কে মন্ত্রণালয় বলেছে, কার্যক্রম-সংক্রান্ত নিরীক্ষায় দেখা গেছে, বেসিক ব্যাংকের গুলশান শাখায় ১৮টি প্রতিষ্ঠানের ঋণ, কারওয়ান বাজার শাখায় আটটি প্রতিষ্ঠান, শান্তিনগর শাখায় পাঁচটি, প্রধান শাখায় ১৪টি এবং দিলকুশা শাখায় ১১টি প্রতিষ্ঠানের ঋণ অনুমোদনে বড় ধরনের অনিয়ম হয়েছে। ব্যাংকঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে নিয়মবহির্ভূতভাবে তৃতীয় পক্ষের জাল দলিল বন্ধক হিসেবে গ্রহণ করেছে। এ ছাড়া ব্যবসাস্থল পরিদর্শন না করে ঋণপ্রস্তাব পেশ, অনেক গ্রাহকের খেলাপি ঋণ-সংক্রান্ত প্রতিবেদন সংগ্রহ না করা, তড়িঘড়ি চলতি হিসাব খুলে অল্প সময়ের মধ্যে ঋণপ্রস্তাব অনুমোদন, প্রয়োজনীয় আমানত ছাড়াই ঋণপ্রস্তাব অনুমোদন, ঋণের জন্য কোনো কোনো গ্রাহকের আবেদনপত্র না থাকা, ঋণ অনুমোদনের পর গ্রাহকের কাছ থেকে টিআইএন সনদ গ্রহণ করা, গ্রাহক ঋণের টাকা ব্যবসায় না খাটিয়ে তা দিয়ে জমি কিনে সেটাকে ঋণের জামানত হিসেবে দেখানো ইত্যাদি অনিয়ম হয়েছে।
মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, অনিয়ম ও দুর্নীতির দায়ে বেসিক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কাজী ফখরুল ইসলামকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়েছে। নতুন চেয়ারম্যানকে এক মাসের মধ্যে অনিয়ম তদন্ত করে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। সরকার দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে দুর্নীতি দমন কমিশনে মামলা করবে।
ব্যাংকটির ভেঙে দেওয়া পরিচালনা পর্ষদে ছিলেন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের অতিরিক্ত সচিব কামরুন্নাহার আহমেদ, ইপিবির ভাইস চেয়ারম্যান শুভাশিস বসু, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সাবেক মহাপরিচালক নীলুফার আহমেদ, বিসিকের চেয়ারম্যান (পদাধিকারবলে), হিসাববিদ আনোয়ারুল ইসলাম ও ব্যবসায়ী আনিস আহমেদ। তারও আগে গত বছরের জুলাইতে পর্ষদের সদস্য এ কে এম কামরুল ইসলাম এবং এ কে এম রেজাউর রহমান বেসিক ব্যাংকের অনিয়ম ও দুর্নীতির চিত্র তুলে ধরে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগকে চিঠি দেন। অনিয়মের প্রতিবাদে তাঁরা পরিচালনা পর্ষদ থেকে পদত্যাগও করেন।
অর্থমন্ত্রী গত শনিবার সাংবাদিকদের বলেছেন, কোথায় কী অনিয়ম হয়েছে, তা নতুন পর্ষদ তদন্ত করে দেখবে।
শওকত আলীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত গতকালের বৈঠকে কমিটির সদস্য আবদুল কুদ্দুস, মুহিবুর রহমান, সুবিদ আলী ভূঁইয়া, হাবিবর রহমান, আবদুর রউফ, নাভান আক্তার প্রমুখ অংশ নেন।