পাবনা থেকে মধ্যপ্রাচ্যে

বেঙ্গল মিট, গ্রামীণ ফিশারিজ অ্যান্ড লাইভস্টক ফাউন্ডেশন, ফাস্ট ব্ল্যাক বেঙ্গল, নর্দান ফুডস  ও প্রিমিয়াম হালাল মাংস রপ্তানি করে
বেঙ্গল মিট, গ্রামীণ ফিশারিজ অ্যান্ড লাইভস্টক ফাউন্ডেশন, ফাস্ট ব্ল্যাক বেঙ্গল, নর্দান ফুডস ও প্রিমিয়াম হালাল মাংস রপ্তানি করে

থার্মোমিটার যন্ত্র দিয়ে মাংসখণ্ডের পরীক্ষা করছেন রিপাতুন নাহার। তাপমাত্রা ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে। তারপর পুরোটা ভালো করে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখলেন। অবশেষে অনুমতি দিলেন। মাংসখণ্ডটি চলে গেল কাটিং টেবিলে। করাত দিয়ে প্রথমে মাঝারি ও পরে চাপাতি দিয়ে ছোট ছোট পিস করছেন কয়েকজন শ্রমিক। তারপর মোড়কজাত হয়ে হিমাগারের পথে দ্রুত চলে গেল।
কারখানার অন্য পাশে যেতেই দেখা গেল, একের পর এক গরু জবাই হচ্ছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই তা উঠে যাচ্ছে ছাদ বরাবর ইস্পাতের লাইনে। মেশিনে চামড়া ছড়িয়ে ভেতরের অন্যান্য অংশ বের করা হচ্ছে। তারপর চর্বি ছড়িয়ে ঠান্ডা ও গরম পানিতে ধুয়ে সরাসরি চলে যাচ্ছে চিলারে (হিমঘরে)। সেখানে মাংসকে ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়ামুক্ত করতে তিন থেকে পাঁচ ঘণ্টা রেখে তাপমাত্রা ৩৫ ডিগ্রি থেকে কমিয়ে আনা হয় ৭ ডিগ্রির নিচে। প্রায় একইভাবে মুরগি ও ছাগলের মাংসও প্রক্রিয়াজাত করা হয়।
পাবনার কাশিনাথপুরের বেঙ্গল মিটের প্রসেসিং কারখানায় ১৭ নভেম্বর ঘুরে এমন কর্মযজ্ঞেরই দেখা মিলল। প্রতিষ্ঠানের জ্যেষ্ঠ নির্বাহী রিপাতুন নাহার বললেন, গরু জবাইয়ের আগে টিবি, অ্যানথ্রাক্সসহ বিভিন্ন রোগের পরীক্ষা করা হয়। এ ছাড়া মাংস প্রক্রিয়াকরণের সব পর্যায়ে তাপমাত্রা বজায় রাখা হয়।
জানা যায়, অস্ট্রেলিয়ার অন রেল ড্রেসিং প্রযুক্তিতে ২০০৬ সালে ১২ একর জায়গার ওপর কারখানাটি প্রতিষ্ঠা করা হয়। বর্তমানে এখানে ২৫০ জনের মতো কাজ করেন, যাঁদের অধিকাংশই স্থানীয়। প্রতিদিন গড়ে ৫০টি গরু এবং ৯০-১০০টি ছাগল জবাই করা হয়। এ ছাড়া চার টনের মতো মুরগি প্রক্রিয়াকরণ করা হয়। তবে কোরবানির ঈদের পর মাস দেড়েক চাহিদা কম থাকায় এই পরিমাণ কিছু কমে। প্রক্রিয়াজাত হওয়া এসব মাংসের বড় অংশই যায় স্থানীয় বাজারে, বিশেষ করে পাঁচতারকা হোটেল। এ ছাড়া খুচরা বিক্রির জন্য বেঙ্গলের আছে ২৪টি বিক্রয়কেন্দ্র। তবে রপ্তানি বাজার মাথায় রেখেই প্রতিষ্ঠানটির যাত্রা শুরু হয়েছিল।
বর্তমানে বেঙ্গলের প্রক্রিয়াজাত করা গরুর মাংস দুবাই, কুয়েত, মালদ্বীপ ও বাহরাইনে রপ্তানি হয়। মূলত প্রবাসী বাংলাদেশিরাই এই মাংসের ক্রেতা। এ ক্ষেত্রে বিশেষত্ব হচ্ছে, দেশে বেঙ্গলের মাংস ৩৬০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়। বিদেশে বসেও প্রবাসীরা একই মূল্য এই মাংস কিনে খেতে পারেন। মাংস রপ্তানিতে সরকারের দেওয়া ১৫ শতাংশ নগদ সহায়তার জন্য এটি সম্ভব হয়েছে বলে জানালেন বেঙ্গলের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) আ ফ ম আসিফ।
২০১২ সালে দুই লাখ এক হাজার ৩৮৩ কেজি ও পরের বছর আট লাখ ৭৫ হাজার ৬৩১ কেজি রপ্তানি হয়। আর চলতি বছর এখন পর্যন্ত ১০ লাখ ১০ হাজার ১৮৮ কেজি গরুর মাংস রপ্তানি করেছে বেঙ্গল মিট। দুবাই, কুয়েত, মালদ্বীপ ও বাহরাইন ছাড়াও ওমান, কাতার ও মালয়েশিয়ায় মাংস রপ্তানির অনুমতি পেয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। এই তিন দেশে মাংস রপ্তানি প্রক্রিয়ার মধ্যে আছে। এ ছাড়া সৌদি আরবে রপ্তানি করা নিয়েও আলাপ-আলোচনা চলছে বলে জানালেন বেঙ্গলের সিইও।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্যানুযায়ী, চলতি ২০১৪-১৫ অর্থবছরে (জুলাই-অক্টোবর) ১১ লাখ ২৬ হাজার ৫৫৬ মার্কিন ডলারের গরুর মাংস রপ্তানি হয়। এর মধ্যে সংযুক্ত আরব আমিরাতে আট লাখ ৩৭ হাজার, কুয়েতে এক লাখে ৮৫ হাজার, বাহরাইনে ৬৬ হাজার, কোরিয়ায় ২৫ হাজার ও মালদ্বীপে ১২ হাজার ডলার। সর্বশেষ ২০১৩-১৪ অর্থবছরে রপ্তানি হয় ৪৬ লাখ ৫৮ হাজার ডলার। আর ২০১২-১৩ অর্থবছরে এই আয় ছিল ৩৩ লাখ ৫৯ হাজার ডলার। গরুর পাশাপাশি ছাগল ও ভেড়ার মাংসও রপ্তানি হচ্ছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে তিন লাখ ডলার এবং গত অর্থবছর ৩২ লাখ ডলারের রপ্তানি হয় এসব মাংস। ২০১২-১৩ অর্থবছরে এই আয় ছিল নয় লাখ ডলার।
ইপিবি জানায়, বেঙ্গল মিট ছাড়াও গ্রামীণ ফিশারিজ অ্যান্ড লাইভস্টক ফাউন্ডেশন, ফাস্ট ব্ল্যাক বেঙ্গল, নর্দান ফুডস ও প্রিমিয়াম হালাল মাংস রপ্তানি করে। তবে এখন পর্যন্ত এই খাতের রপ্তানি আয়ের নেতৃত্ব দেওয়ার দাবি করলেও বেঙ্গল মিটের হিস্যা কতটুকু তা জানাতে চাননি প্রতিষ্ঠানের সিইও আসিফ। তবে তিনি বলেন, প্রতি মাসে গড়ে দেশের বাজারে প্রায় পাঁচ কোটি টাকার মাংস বিক্রি হয়।
রপ্তানি বাজারে আরও ভালো অবস্থানে না পৌঁছাতে পারার কারণ হিসেবে বেঙ্গলের সিইও বললেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলো হালাল মাংসের বড় বাজার। তবে কিছু শর্তের কারণে সম্ভব হচ্ছে না। কী শর্ত জানতে চাইলে তিনি বলেন, পশুপালন ও প্রক্রিয়া হবে সেই নির্দিষ্ট এলাকাকে রোগমুক্ত ঘোষণা করতে হয়। প্রথমে সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় এটি করার পর ওয়ার্ল্ড অ্যানিমেল হেলথ অর্গানাইজেশন থেকেও ছাড়পত্র নিতে হয়। এ ক্ষেত্রে ইপিজেডের মতো একটি বিশেষ অঞ্চল করতে পারে সরকার এমন পরামর্শ দিলেন আসিফ। তিনি জানালেন, বর্তমানে সারা বিশ্বে হালাল মাংসের বাজার চার ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারের (এক লাখ কোটি ডলারে এক ট্রিলিয়ন)। ফলে এ খাতের প্রচুর সম্ভাবনা আছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
এদিকে নিজেদের মাংস হালাল বলে জানায় বেঙ্গল মিট। তবে এ বিষয়ে সরকারের কোনো সুর্নিদিষ্ট নীতিমালা নেই। জানতে চাইলে প্রতিষ্ঠানটির সহকারী মহাব্যবস্থাপক মাহমদু আল মামুন বলেন, ‘মালয়েশিয়া সরকারের হালাল সনদ দেওয়ার কর্তৃপক্ষ জাকিম থেকে আমরা সনদ নিয়েছি। এ ছাড়া দেশের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অনুমতিক্রমে ইসলামিক ফাউন্ডেশন আমাদের একটি গাইডলাইন করে দিয়েছে। সে অনুযায়ী পশু জবাই করা হয়। আর পুরো প্রক্রিয়া সরেজমিনে দেখার জন্য ফাউন্ডেশনের একজন কর্মচারী বেঙ্গলের কারখানায় উপস্থিত থাকেন।’
বেঙ্গলের এই কারখানার পুরো এলাকাটি বেশ সাজানো-গোছানো। প্রক্রিয়াকরণ কারখানার বাইরে গরু ও ছাগল পালনকেন্দ্র আছে। তবে স্থানীয় বাজার থেকেই চাহিদার বড় অংশ সংগ্রহ করে প্রতিষ্ঠানটি। এ জন্য ১২ জন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সরবরাহকারী আছে। তারাই আশপাশের এলাকা থেকে গরু ও ছাগল সংগ্রহ করে। আর মুরগি আনা হয় স্থানীয় খামার থেকে। মাংস প্রক্রিয়াকরণের পাশাপাশি কিছু ফাস্টফুড প্রস্তুত করে বেঙ্গল। যেমন—মিট বল, নাগেট, চিকেন কর্ডন ব্লু, বিফ ট্রেন্ডস ব্লেক, ল্যামন গ্রাস ললিপপ ইত্যাদি।
কথা প্রসঙ্গে আসিফ জানালেন, রপ্তানি বাজার সম্প্রসারণের পাশাপাশি দেশের বাজারে ব্যবসা আরও বাড়াতে কাজ করছে বেঙ্গল। তিনি বলেন, দেশে-বিদেশে স্বাস্থ্যসম্মত মাংসের বেশ চাহিদা থাকায় সরকার এ খাতে নজর দিতে পারে। একই সঙ্গে সম্ভাবনাময় এ খাতে নতুন বিনিয়োগ হতে পারে বলে মন্তব্য করেন তিনি। অবশ্য বেঙ্গল মিটের কারখানায় এখন পর্যন্ত কত টাকার বিনিয়োগ করা হয়েছে সে বিষয়ে প্রশ্ন করলেও আসিফ বলতে অপারগতা প্রকাশ করেন।
রপ্তানি করে
বেঙ্গল মিট, গ্রামীণ ফিশারিজ অ্যান্ড লাইভস্টক ফাউন্ডেশন, ফাস্ট ব্ল্যাক বেঙ্গল, নর্দান ফুডস ও প্রিমিয়াম হালাল মাংস রপ্তানি করে
রপ্তানি হয়
সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই), কুয়েত, বাহরাইন, কোরিয়া ও মালদ্বীপে রপ্তানি হয়