পেঁয়াজের দাম হঠাৎ লাগামছাড়া

বাজারে ভারতীয় পেঁয়াজ
বাজারে ভারতীয় পেঁয়াজ

অনেক খোঁজাখুঁজির পর এখন বাজারে দেখা মিলছে ভারতীয় পেঁয়াজের। দেশি পেঁয়াজ পাওয়া গেলেও বিক্রি হচ্ছে চড়া দামে। ঈদের পর থেকেই পেঁয়াজের দাম লাগামছাড়া হয়ে গেছে।
বাজারে দেশি ও ভারতীয় দুই ধরনের পেঁয়াজের কেজিই এখন ৬০ থেকে ৬৫ টাকা। এক সপ্তাহ আগেও দেশি পেঁয়াজ ৪৮ থেকে ৫২ এবং ভারতীয় পেঁয়াজ ৪৪ থেকে ৪৫ টাকায় বিক্রি হতো।
আমদানিকারক ও পাইকারি ব্যবসায়ীরা বলছেন, ঈদের পর ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানি আশঙ্কাজনকভাবে কমে গেছে। দেশটিতে কয়েক দিন ধরে পেঁয়াজের দাম বাড়ায় আমদানিকারকেরা বেশি দামে পেঁয়াজ আমদানি করছেন না। তাই সরবরাহের সংকট দেখা দিয়েছেন। এতে দামও বেড়েছে।
মূলত দেশে চাহিদা অনুযায়ী উৎপাদন না হওয়ায় প্রতিবছর কয়েক লাখ টন পেঁয়াজের ঘাটতি থেকে যায়। আর এ ঘাটতি মেটাতে হয় আমদানি করে। আর দেশে বেশির ভাগ পেঁয়াজই আমদানি হয় ভারত থেকে। আর আমদানির্ভরতার এ সুযোগটাই নেন আমদানিকারক ও মধ্যস্বত্বভোগীরা। ভারত রপ্তানি বন্ধ বা সীমিত করলে কিংবা বৃষ্টিতে ভারতে পেঁয়াজের উৎপাদন বাধাগ্রস্ত হলেই দেশের বাজারে দাম বাড়তে খুব একটা সময় লাগে না।
গত ফেব্রুয়ারিতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে দেওয়া বাংলাদেশ ট্যারিফ কমিশনের এক প্রতিবেদনেও আমদানিনির্ভরতাকেই পেঁয়াজের সে সময়ের মূল্যবৃদ্ধির বড় কারণ বলে উল্লেখ করা হয়।
বাজারচিত্র: রাজধানীর কারওয়ান বাজারে গতকাল বুধবার বেশির ভাগ বিক্রেতাই দেশি ও ভারতীয় উভয় পেঁয়াজের দাম হাঁকেন ৬৫ টাকা কেজি। তবে গুটি কয়েক বিক্রেতাকে ৬০ টাকা দরে দেশি পেঁয়াজ বিক্রি করতে দেখা গেছে। আর বাজারে কেবল হাতে গোনা কয়েকজনের কাছেই ভারতীয় পেঁয়াজ দেখা গেছে। বিক্রেতা খায়ের মিয়া বলেন, ‘সরবরাহ কম। তাই ইন্ডিয়ান পেঁয়াজ বাজারে নাই।’ তিনি আরও বলেন, ইন্ডিয়ানটা না এলে দেশি পেঁয়াজের দাম কমবে না।
রাজধানীতে পেঁয়াজের বড় পাইকারি বাজার শ্যামবাজারের আমদানিকারকেরা জানান, তাঁদের কাছে এখন ভারতীয় পেঁয়াজের মজুত খুবই কম। দেশি ও ভারতীয় দুই ধরনের পেঁয়াজই এখন পাইকারিতে ৬০ থেকে ৬৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
শ্যামবাজারের আমদানিকারক পপুলার বাণিজ্যালয়ের স্বত্বাধিকারী রতন সাহা প্রথম আলোকে বলেন, ‘ভারতে দাম বাড়তে থাকা আর ঈদের চাহিদা পূরণ হয়ে যাওয়ায় রোজার শেষ দিকে পেঁয়াজ আমদানি কমে যায়। ভারতে এখন দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেছে। নাসিক থেকে আমদানি করে ভোমরা স্থলবন্দর পর্যন্ত আনতে প্রতি কেজি পেঁয়াজের দাম পড়ে ৭০ টাকা। অনেকেই এ দামে আমদানি করার মতো ঝুঁকি নিতে চাইছেন না। সে কারণে পেঁয়াজ আমদানি অনেকটাই কমে গেছে।’ তিনি বলেন, ভারতের বেঙ্গালুরুতে আগামী ১৫-২০ দিনের মধ্যে পেঁয়াজের একটি ফলন উঠবে। সেই পেঁয়াজ বাজারে এলে দেশটিতে দাম কমতে পারে। দেশি যে পেঁয়াজটা এখন বিক্রি হচ্ছে, তা ‘হালি পেয়াজ’ নামে পরিচিত। এই পেঁয়াজটা চৈত্রের শেষ এবং বৈশাখের শুরুতে বাজারে আসে। এবার ভারতের পেঁয়াজের চেয়ে এর মান ভালো হওয়ায় বাজারে আসার পর থেকেই দেশি পেঁয়াজ বেশি বিক্রি হতে থাকে। সে কারণে এ বছর ভালো ফলন হওয়ার পরও দেশি পেঁয়াজের মজুত প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। রতন সাহা মনে করেন, ভারত যদি পেঁয়াজ রপ্তানি পুরোপুরি বন্ধ করে দেয়, তাহলে দেশি পেঁয়াজ দিয়ে বড়জোর এক মাসের চাহিদা মেটানো যাবে। তবে ভারত হয়তো পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করবে না।
চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জের পাইকারি ব্যবসায়ীরাও ভারত থেকে আমদানি কমে যাওয়াকে মূল্যবৃদ্ধির কারণ বলে মন্তব্য করেছেন। তবে আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে পেঁয়াজের দরপতন ঘটবে বলে তাঁরা ইঙ্গিত দেন। গতকাল খাতুনগঞ্জে ভারত থেকে আমদানি করা নাসিক পেঁয়াজ ৬০ থেকে ৬৫ টাকা দরে বিক্রি হয়। খুচরা বাজারে তা বিক্রি হচ্ছিল ৭০ থেকে ৭৫ টাকা দরে। আর দেশি পেঁয়াজের পাইকারি দর ছিল ৫৮ থেকে ৬০ টাকা। খুচরা বাজারে তা ৬৫ থেকে ৬৮ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছিল।
খাতুনগঞ্জের পাইকারি বিক্রেতা ও সততা বাণিজ্যালয়ের মালিক রতন রায় প্রথম আলোকে বলেন, ভারতের পাটনার নাসিক এলাকায় বন্যায় পেঁয়াজ উৎপাদনে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। এ কারণে ভারত থেকে পেঁয়াজের আমদানি কমে গেছে, যার প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশের বাজারে।
রতন রায় আরও বলেন, দেশি পেঁয়াজের সরবরাহ বেড়ে গেছে। তাই পেঁয়াজের মূল্যবৃদ্ধির আর কোনো আশঙ্কা নেই। কারণ, ভারতে ১২ মাস ধরে কোনো না কোনো প্রদেশে পেঁয়াজ উৎপাদিত হয়। আরেকটি নতুন মৌসুম আসতে সপ্তাহ দুয়েক লাগবে। তখন আমদানি বেড়ে গেলে বাংলাদেশের বাজারে পেঁয়াজের দাম পড়ে যাবে। আমদানিচিত্র: ভারতীয় পেঁয়াজের বড় অংশই দেশে আসে সাতক্ষীরার ভোমরা স্থলবন্দর দিয়ে। বন্দরের সহকারী কমিশনার উত্তম বিশ্বাস প্রথম আলোকে বলেন, এখন প্রতিদিন পেঁয়াজবোঝাই ৩০ থেকে ৩৫টি ট্রাক এই বন্দর দিয়ে ঢুকছে। সপ্তাহ খানেক আগে প্রতিদিন ঢুকেছে ২০ থেকে ২৫টি ট্রাক। তবে সাতক্ষীরার পেঁয়াজ আমদানিকারক মোমেন খান চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, এই বন্দর দিয়ে দেড়-দুই মাস আগেও প্রতিদিনি ১৫০ থেকে ১৬০ ট্রাক পেঁয়াজ আসত।
দুজনই জানান, ভারতে পেঁয়াজের দাম কয়েক দিনে তিন গুণ বেড়ে যাওয়ায় আমদানিকারকেরা আমদানি কমিয়ে দিয়েছেন।
বেনাপোল স্থলবন্দর সূত্র জানায়, এ বন্দর দিয়ে ফেব্রুয়ারিতে ১১ হাজার ৫৫৪ টন পেঁয়াজ আমদানি হলেও এর পর থেকে প্রতি মাসেই আমদানি কমেছে। মার্চে তিন হাজার ১৫৪, এপ্রিলে এক হাজার ৬৬৮, মে মাসে এক হাজার ৮৫১ আর জুনে এক হাজার ৪৩৮ টন। অবশ্য রোজা সামনে রেখে জুলাইতে দুই হাজার ১৫৮ টন পেঁয়াজ এ বন্দর দিয়ে আমদানি হয়। রতন সাহা বলেন, ‘শ্যামবাজারে স্বাভাবিক সময়ে প্রতিদিন ৩০ থেকে ৪০ ট্রাক পেঁয়াজ ঢোকে। তবে এখন ঢুকছে পাঁচ-ছয় ট্রাক। প্রতি ট্রাকে পেঁয়াজ থাকে ১৫ থেকে ১৭ টন।’
ভারতের একাধিক গণমাধ্যমের খবর থেকে জানা যায়, দেশটিতে নাসিকের লাসালগাঁওয়ে (এশিয়ার পেঁয়াজের সবচেয়ে বড় পাইকারি বাজার) তিন দিনের ব্যবধানে পেঁয়াজের কেজি ২৫ শতাংশ বেড়েছে। প্রতি কেজি পেঁয়াজ গতকাল খুচরা বিক্রি হয়েছে ৮০ রুপিতে।
খরার কারণে ভারতের নাসিকে এবার পেঁয়াজের উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আর কর্নাটকসহ পেঁয়াজ উৎপাদনকারী অন্যান্য এলাকার উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হয় অতিবৃষ্টিতে।
[প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন প্রথম আলোর নিজস্ব প্রতিবেদক কল্যাণ ব্যানার্জি (সাতক্ষীরা)ও মনিরুল ইসলাম (যশোর)]: