অর্থনীতিকে টেনে নিচে নামাচ্ছেন রাজনীতিকেরা

চলমান রাজনৈতিক সহিংসতার শিকার হচ্ছে সাধারণ মানুষ। ক্ষতির মুখে পড়ছে ব্যবসা-বাণিজ্য। দেশের সর্বোচ্চ রপ্তানি আয় ও কর্মসংস্থানের জোগান দেওয়া তৈরি পোশাকশিল্পও সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। বিদেশি ক্রেতারা আসছেন না। ক্রয়াদেশ কমে গেছে। এসব বিষয় নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন তৈরি পোশাকশিল্পের মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর

মো. আতিকুল ইসলাম
মো. আতিকুল ইসলাম

সভাপতি মো. আতিকুল ইসলাম
প্রথম আলো: টানা হরতাল-অবরোধে তৈরি পোশাকশিল্পের কী অবস্থা?
আতিকুল ইসলাম: যেকোনো ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য একটা প্ল্যাটফর্ম দরকার; যাতে করে ভালোভাবে ব্যবসা করে শ্রমিক-কর্মচারীর বেতন, ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ এবং নতুন বিনিয়োগ করে আরও উন্নতি করা যায়। সরকার, বিরোধী দলসহ সব রাজনৈতিক দলের উচিত সেই পরিবেশটা নিশ্চিত করা। সব দেশের রাজনীতিকদের এজেন্ডা থাকা উচিত কীভাবে দেশের অর্থনীতিকে আরও উন্নত করা যায়। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে মনে হচ্ছে, আমাদের দেশের রাজনীতিকেরা কীভাবে দেশের অর্থনীতিকে টেনে নিচে নামানো যায়, সে চেষ্টাই করছেন। তাঁরা মানুষ মেরে, ব্যবসাকে জিম্মি করে রাজনীতি করছেন। এটা খুবই দুঃখজনক। চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে ১২টি পোশাক কারখানার ১২৯ কোটি টাকার ক্ষতির হিসাব আমরা পেয়েছি। তা ছাড়া এক দিনের হরতাল-অবরোধে ৬৯৫ কোটি টাকার পোশাক রপ্তানি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এ রকম ক্ষয়ক্ষতি তো হচ্ছেই, পরিসংখ্যানও পাওয়া যাচ্ছে। তবে পোশাকশিল্পের জন্য ইতিবাচক ভাবমূর্তি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই ক্ষতি কোনো পাল্লা দিয়েই মাপা যাবে না। বিদেশি ক্রেতারা বাংলাদেশে আসা বন্ধ করে দিয়েছেন। দেশজুড়ে হরতাল-অবরোধ, পেট্রলবোমা আর চোরাগোপ্তা হামলা ও আতঙ্কের পরিবেশ থাকলে এ রকমটাই হওয়া স্বাভাবিক।
বাংলাদেশের রাজনীতিকেরা মনে করেন, এ দেশ থেকে কখনোই তৈরি পোশাকের ব্যবসা যাবে না। তবে এটা বোঝা উচিত, বিদেশি ক্রেতারা নাকে খত দিয়ে বলেন নাই যে তাঁরা বাংলাদেশেই ব্যবসা করবেন। তাঁরা প্রয়োজনে বেশি টাকা দিয়ে অন্য দেশ থেকে পোশাক কিনতে চলে যাবেন। ইতিমধ্যে সেই প্রবণতা শুরু হয়ে গেছে। রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে আশির দশকে শ্রীলঙ্কার ২০০ পোশাক কারখানার কাজ বাংলাদেশে চলে এসেছিল। তার পরই তিলে তিলে উন্নতি করে আজকের এই অবস্থানে দাঁড়িয়েছে পোশাক খাত। ফলে উদাহরণ কিন্তু আছে। তাই শিগগিরই সমস্যার সমাধান করে আমাদের ক্রেতাদের ইতিবাচক বার্তা দিতে হবে যে আমরা প্যাভিলিয়নে নয়, ব্যবসায় ফিরেছি। অনিশ্চয়তার কারণে ৩০ শতাংশের মতো ক্রয়াদেশ কমিয়ে দিয়েছে ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলো। ক্রেতা প্রতিষ্ঠান তাদের প্রতিনিধিদের জন্য কেবল অফিস বা বাসা পর্যন্ত বিমা-সুবিধা দিয়ে থাকে। এ জন্য কেউ ঝুঁকি নিয়ে অফিস থেকে সাভার, গাজীপুর বা অন্য কোনো জায়গার কারখানায় পণ্যের নমুনা দেখতে ও পরিদর্শন করতে যাচ্ছেন না। সে কারণে অনেক ক্ষেত্রেই পণ্য উৎপাদন বিলম্বিত হচ্ছে। আর সেটি হলেই ক্রেতারা বলছেন, উড়োজাহাজে পণ্য পাঠাও। এটি করতে গিয়ে বিশাল ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে ব্যবসায়ীদের। পুলিশ ও বিজিবির পাহারায় পণ্য ও কাঁচামাল ঢাকা-চট্টগ্রামে আনা-নেওয়া করা যাচ্ছে। তবে এটা স্বাভাবিক অবস্থা নয়।

প্রথম আলো: ২০১২ সালে তাজরীণ ফ্যাশনসের অগ্নিকাণ্ড, ২০১৩ সালে রানা প্লাজা ধস ও পরে রাজনৈতিক সহিংসতা এবং চলতি বছরের শুরু থেকেই আবার টানা হরতাল-অবরোধ। একের পর এক আঘাতে জর্জরিত পোশাকশিল্পের ভবিষ্যৎ কী?
আতিকুল ইসলাম: তাজরীন ও রানা প্লাজা ধসের পর কারখানার কর্মপরিবেশ ও নিরাপত্তা নিয়ে প্রচুর কাজ করেছি আমরা। কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছেন উদ্যোক্তারা। ক্রেতাদের জোট-অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্সের কারখানা পরিদর্শনের পর সারা বিশ্বে একটি ইতিবাচক বার্তা গেছে। তা ছাড়া গত ডিসেম্বরে অ্যাপারেল সামিট আয়োজন করে ২০২১ সালের মধ্যে পোশাক খাতের রপ্তানি ৫ হাজার কোটি ডলারে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছি আমরা। গত তিন অর্থবছর পোশাক খাতের রপ্তানি প্রবৃদ্ধির গড় ছিল ৮ শতাংশ। এটিকে ১১ শতাংশে উন্নীত করতে পারলেই এ লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব। সে জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষ শ্রমিক, অভিজ্ঞতা ও পশ্চাদমুখী সংযোগশিল্প আমাদের আছে। ক্রেতারাও আমাদের ক্রয়াদেশ বাড়ানোর ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। তবে বর্তমান পরিস্থিতি চলতে থাকলে ৫ হাজার কোটি ডলারের রপ্তানি নয়, এ দেশের মাটিতে পোশাকশিল্পের কবর রচনা হবে। আমরা চাই না এমনটা হোক।
প্রথম আলো: আপনারা বলেছিলেন, ২০১৩ সালে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে পোশাকশিল্পর মালিকদের মূল্যছাড় দিতে হয়েছিল ৯ হাজার কোটি টাকার পণ্য। আর বেশি অর্থ দিয়ে উড়োজাহাজে পাঠাতে হয়েছিল সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকার পণ্য। সেই ক্ষতি কি মালিকেরা পুষিয়ে উঠতে পেরেছিলেন?
আতিকুল ইসলাম: সেই ক্ষতি পুষিয়ে উঠতে পারেননি উদ্যোক্তারা। ওই বছর প্রত্যেক মালিকই লোকসান গুনেছিলেন। এর সঙ্গে মড়ার উপর খড়ার ঘাঁ হিসেবে হাজির হয়েছিল অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্স কারখানা পরিদর্শন কার্যক্রম। এতে করে কারখানার কর্মপরিবেশ উন্নতি করতে কোটি কোটি টাকা খরচ করতে হয়েছে। অবশ্য গত একটি বছর শান্তিপূর্ণ পরিবেশে উদ্যোক্তারা আশায় বুক বেঁধে ছিলেন। তাঁরা ভেবেছিলেন, চলতি বছর থেকে আবার এ খাতের চাকা দারুণভাবে ঘুরতে শুরু করবে। গত ছয় মাসে যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, কানাডায় পোশাক রপ্তানিতে ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি হয়েছে। একই সময় প্রতিযোগী ভিয়েতনামের প্রবৃদ্ধি অনেক। এদিকে দেশটির সরকার যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ট্রান্সফার প্যাসিফিক পার্টনারশিপ (টিপিপি) করার উদ্যোগ নিয়েছে। আর এটি হলে ভিয়েতনামের তৈরি পোশাক বিনা শুল্কে রপ্তানি হবে। এখন আমাদের উচিত ছিল এ ধরনের নীতিনির্ধারণী বিষয় নিয়ে কাজ করা, যাতে রপ্তানি বাড়ে। ব্যবসা বড় হয়। তা না করে এখন আমরা উল্টো পথেই হাঁটছি।
প্রথম আলো: রাজনৈতিক অস্থিরতা বন্ধে আপনারা ব্যবসায়ীরা তো রাস্তায় নামলেন। মানববন্ধন করলেন। প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপির চেয়ারপারসনকে স্মারকলিপি দিয়েছেন। এতে কি সমস্যার সমাধান হবে বলে মনে হয়? না হলে আপানারা আবার কি কোনো উদ্যোগ নেবেন?
আতিকুল ইসলাম: রাস্তায় নামার বিষয়ে আমরা সম্মত ছিলাম না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়েছি। আমরা বিশ্বাস করি, মানববন্ধন ও স্মারকলিপির মধ্য দিয়ে রাজনীতিকদের বোঝাতে পেরেছি। আশা করছি, বর্তমান সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধান হবে। আর না হলে সময়ই বলে দেবে আমরা কী করব। অবশ্যই রাজনৈতিক দলের কর্মসূচি পালন করার অধিকার আছে। তবে সবাই মিলে আমাদের একটি উপায় বের করতে হবে, মানুষ না মেরে কীভাবে ব্যবসা বৃদ্ধি করা যায়। কীভাবে বর্তমান সহিংস রাজনীতির ধরন পরিবর্তন করা যায়।
সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন শুভংকর কর্মকার