রপ্তানি আটকে চিংড়ির স্তূপ

.
.

দেশের চিংড়ি রপ্তানিকারকদের কারখানাগুলোতে অন্তত ১০ হাজার ৯৪০ টন রপ্তানিযোগ্য চিংড়ির মজুত জমে গেছে। এর বাজারমূল্য প্রায় ১ হাজার ৪৫২ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ হিমায়িত খাদ্য রপ্তানিকারক সমিতি সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। সংগঠনটির নেতারা বলছেন, টানা অবরোধ আর হরতালে রপ্তানি করতে না পারায় এই মজুত জমেছে।
রপ্তানিকারকেরা বলছেন, বিশ্ববাজারে এমনিতেই চিংড়ি রপ্তানি কমে গেছে। সেই অবস্থায় দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা চলছে। এর কারণে ঠিকমতো পণ্য জাহাজীকরণ করা যাচ্ছে না। কিন্তু কারখানার খরচ ঠিকই গুনতে হচ্ছে। সব মিলিয়ে রপ্তানিমুখী চিংড়িশিল্পে প্রতিদিনের ক্ষতির পরিমাণ ৮ থেকে ১০ কোটি টাকা। সে হিসাবে, গতকাল শুক্রবার পর্যন্ত টানা অবরোধ-হরতালের ২৫ দিনে এ খাতে অন্তত ২০০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে।
আর রাজনৈতিক অস্থিরতা এভাবে চলতে থাকলে চলতি ২০১৪-১৫ অর্থবছরে চিংড়ি রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা তো অর্জিত হবেই না, বরং তা ২৫ শতাংশ পর্যন্ত কমে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন রপ্তানিকারকেরা।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ হিমায়িত খাদ্য রপ্তানিকারক সমিতির সভাপতি মো. আমিন উল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে রপ্তানি কমে গেছে। উৎপাদনও কমিয়ে দিতে হয়েছে। তবু ১০ হাজার টনের মতো চিংড়ি জমে গেছে। কিন্তু কারখানার খরচ তো কমেনি। সে কারণে এ খাতে প্রতিদিন ক্ষতি হচ্ছে ৮ থেকে ১০ কোটি টাকা।
আমিন উল্লাহ আরও জানান, বিশ্ববাজারের চিংড়ির রপ্তানি ভালো নয়। সে কারণে এমনিতেই এবার লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৮ থেকে ১০ শতাংশ রপ্তানি কম হতে পারে। কিন্তু এই হরতাল-অবরোধ চলতে থাকলে বছর শেষে রপ্তানি ২৫ শতাংশ পর্যন্ত কমার আশঙ্কা হচ্ছে।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) দেশ থেকে ৩২ কোটি ৩৭ লাখ ডলারের চিংড়ি রপ্তানি হয়েছে। এটি আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে ২ দশমিক ৩০ শতাংশ কম। আগের বছরের একই সময়ে রপ্তানি হয়েছিল ৩৩ কোটি ১৩ লাখ ডলারের চিংড়ি।
গত গোটা অর্থবছরে ৫৫ কোটি ডলারের চিংড়ি রপ্তানি হয়। চলতি বছরের রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হয়েছে ৬৩ কোটি ৫৫ লাখ ডলার। এই লক্ষ্যমাত্রা নিয়েই এখন শঙ্কিত রপ্তানিকারকেরা।
প্রসঙ্গত, বাগদা (লোনা পানির চিংড়ি) ও গলদা জাতের চিংড়ি (মিঠা পানির চিংড়ি) দেশ থেকে বিদেশে রপ্তানি হয়। এর মধ্যে ৮০ শতাংশই বাগদা। বিশ্বব্যাপী রপ্তানি হওয়া চিংড়ির মধ্যে অন্য একটি জাত রয়েছে, যার নাম ভেনামি। বাংলাদেশে এই ভেনামি জাতের চিংড়ির চাষ হয় না।
কমেছে রপ্তানি: চিংড়ি রপ্তানিকারক সমিতি বলছে, দেশে প্রতি মাসে গড়ে সাড়ে চার হাজার থেকে পাঁচ হাজার টন চিংড়ি রপ্তানি হয়। ডিসেম্বর-জানুয়ারিতে রপ্তানি কিছুটা কমে যায়।
সমিতির তথ্য অনুযায়ী, গত ডিসেম্বরে যেখানে ৪ হাজার ২৯ টন চিংড়ি রপ্তানি হয়েছিল, সেখানে এই জানুয়ারির প্রথম ২৮ দিনে হয়েছে ২ হাজার ৮৯৯ টন।
রপ্তানিকারকেরা বলছেন, এই রপ্তানি কমার বড় কারণ চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতা। রপ্তানিপণ্য ঠিকমতো বন্দরে না পৌঁছানোয় সময়মতো জাহাজীকরণ করা যায়নি। এসব কারণেই রপ্তানি কমেছে।
রপ্তানিকারক সমিতির তথ্যে দেখা গেছে, গত জুলাইতে দেশ থেকে চিংড়ি রপ্তানি হয় ৫ হাজার ১৬ টন। আগস্টে ৪ হাজার ৬৯৮ টন, সেপ্টেম্বরে ৫ হাজার ১২ টন, অক্টোবরে ৪ হাজার ৪৩ টন। নভেম্বরে অবশ্য রপ্তানি বেশ কমে যায়, হয় ৩ হাজার ৬৯৬ টন।
আগের বছরের সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যায়, শুধু ডিসেম্বর ছাড়া সব মাসেই আগের বছরের চেয়ে রপ্তানি কমে গেছে। আগের বছরের জুলাই মাসে রপ্তানি হয়েছিল ৫ হাজার ৩৪৫ টন, আগস্টে ৫ হাজার ১২৩ টন, সেপ্টেম্বরে ৫ হাজার ৪২৭ টন, অক্টোবরে ৪ হাজার ৯৫০ টন, নভেম্বরে ৩ হাজার ৮৯০ টন চিংড়ি রপ্তানি হয়েছিল। আর আগের বছরের ডিসেম্বর মাসে রপ্তানি হয় ৩ হাজার ৯৬৪ টন।
রপ্তানিকারক সমিতির আমিন উল্লাহ বলেন, ‘মার্চ-এপ্রিলে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে চিংড়ি সংগ্রহ করা হয়। ফলে ওই সময় প্রচুর পরিমাণে চিংড়ি রপ্তানি হয়। সেই সময় পর্যন্ত যদি রাজনৈতিক অস্থিরতা চলতে থাকে, তাহলে তা আমাদের জন্য অশনিসংকেত।’
রাজনৈতিক অস্থিরতা ছাড়াও রপ্তানি কমে যাওয়ার কয়েকটি কারণ চিহ্নিত করেছেন রপ্তানিকারকেরা। এর একটি হচ্ছে রাশিয়ার বাজারে চিংড়ি রপ্তানিতে ধস। তাঁরা বলছেন, বাংলাদেশ থেকে সারা বিশ্বে যত চিংড়ি রপ্তানি হয়, তার প্রায় ৫ শতাংশ যায় রাশিয়ায়। কিন্তু গত ডিসেম্বর ও জানুয়ারির প্রথম ২৮ দিনে দেশটিতে কোনো চিংড়ি রপ্তানি হয়নি। নভেম্বরে তিনটি চালানে রপ্তানি হয় মাত্র ছয় টন চিংড়ি। এর আগে অক্টোবরে ১১টি চালানে চিংড়ি রপ্তানি হয় মাত্র সাড়ে ২১ টন।
ইউরোপ ও রাশিয়ার মধ্যে পাল্টাপাল্টি নিষেধাজ্ঞা আরোপ এবং রাশিয়া থেকে যুক্তরাষ্ট্রের জ্বালানি তেল না কেনায় ডলারের বিপরীতে রুবলের বড় ধরনের দরপতন ঘটেছে। এর প্রভাবে পণ্য আমদানি করতে রাশিয়ার আমদানিকারকদের আগের চেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে। সে কারণে তাঁরা বিভিন্ন পণ্যের আমদানি কমিয়ে দিয়েছে। এর মধ্যে পড়ে গেছে বাংলাদেশের চিংড়িও।
আবার বাংলাদেশের চিংড়ির ৬৫ শতাংশই যায় ইউরোপের দেশগুলোতে। ডলারের বিপরীতে ইউরোরও দরপতন ঘটেছে। সে কারণে তারাও চিংড়ি আমদানি কমিয়ে দিয়েছে।
অন্যদিকে অর্থনৈতিক মন্দায় ক্রয়ক্ষমতা কমে যাওয়ায় ইউরোপের ক্রেতারা ভেনামি চিংড়ির দিকে ঝুঁকছেন। এক পাউন্ডে দেশের বাগদা চিংড়ি যেখানে থাকে ১৬ থেকে ২০টি, সেখানে ভেনামি চিংড়ি থাকে ৩৬ থেকে ৪০টি। আবার এক পাউন্ড বাগদার দাম ৭ থেকে ৮ ডলার হলেও ভেনামি কেনা যায় ৩ থেকে ৪ ডলারে। ফলে ইউরোপসহ বিভিন্ন দেশে ভেনামি চিংড়ি জনপ্রিয় হচ্ছে। এর প্রভাবে বাগড়া চিংড়ি রপ্তানি কমছে।
প্রসঙ্গত, ২০১১-১২ ও ২০১২-১৩ অর্থবছরে দেশ থেকে ৫২ হাজার ৬০০ টনের বেশি চিংড়ি রপ্তানি হলেও গত অর্থবছরে হয়েছে ৪৯ হাজার ৫৬৭ টন। অবশ্য ওই দুই বছরের চেয়ে গত বছরের রপ্তানি আয় ছিল বেশি।
জমেছে মজুত: চিংড়ি রপ্তানিকারক সমিতির সদস্য এখন ৯৭। এর মধ্যে সক্রিয়ভাবে চিংড়ি রপ্তানি করছে ৫০ থেকে ৫৫টি প্রতিষ্ঠান।
অবরোধ-হরতালে রপ্তানি করতে না পেরে কারখানায় ২৫ জানুয়ারি পর্যন্ত কী পরিমাণ চিংড়ির মজুত জমেছে, সম্প্রতি সেই তথ্য সংগ্রহ করেছে চিংড়ি রপ্তানিকারক সমিতি। অবশ্য ৪২টি প্রতিষ্ঠান সমিতিকে তথ্য দিয়েছে।
সমিতি বলছে, সেসব কারখানায় ১০ হাজার ৯৪০ টন চিংড়ির মজুত জমেছে। এর বাজারমূল্য প্রায় ১ হাজার ৪৫২ কোটি টাকা। এর মধ্যে আর্ক সি ফুডের ৪৪৫ টন, জাহানাবাদ সি ফুডে ৩৬৬ টন, জালালাবাদ ফ্রোজেন ফুডে ৪১৪ টন, কুলিয়াচর সি ফুডে ৮৭৪ টন, সার অ্যান্ড কোংয়ে ৬০৪ টন, ফ্রেশ ফুডে ৪৫৮ টন চিংড়ি জমে আছে।
রপ্তানিকারক সভাপতির সভাপতি আমিন উল্লাহ বলেন, ‘চিংড়ির যে মজুত জমেছে, তা আমাদের লোকসান দিয়ে বিক্রি করতে হবে। আমরা তা-ই করতে চাই। কিন্তু বিশ্ববাজারে চিংড়ির চাহিদা কমে যাওয়ায় অর্ডার আসছে কম। তাই মজুত চিংড়ি নিয়ে শঙ্কায় আছি।’
জানা গেছে, লকপুর গ্রুপের পাঁচটি প্রতিষ্ঠান চিংড়ি রপ্তানি করে থাকে। এর মধ্যে বাগেরহাট সি ফুডে ৩২০ টন, লকপুর ফিশ প্রসেসিংয়ে ২৬০ টন, রূপসা ফিশে ১৮৪ টন, সাউদার্ন ফুডসে ২৭৪ টন ও শম্পা আইস অ্যান্ড কোল্ড স্টোরেজে ১৪৭ টন চিংড়ি মজুত পড়ে আছে।
যোগাযোগ করা হলে লকপুর গ্রুপের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক খান হাবিবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘মজুত চিংড়ি নিয়ে সমস্যায় আছি। যদিও ২৪ মাস পর্যন্ত এই চিংড়ির মান ভালো থাকে। কিন্তু এত মজুত জমেছে যে, ক্রেতারা যে দাম চাইবে, সে দামেই তা ছেড়ে দিতে হবে। আর কোনো উপায় নেই।’
খান হাবিবুর রহমান আরও বলেন, ‘গত মাসে অর্ডার পাওয়া ১০ কনটেইনার চিংড়ি এই মাসে জাহাজীকরণ করার কথা ছিল কিন্তু আমরা তা করতে পারিনি। আমরা চিংড়িও ঠিকমতো সংগ্রহ করতে পারিনি, কাঁচামালও ঠিকমতো আনতে পারিনি। ফলে ক্রেতাদের চাহিদা অনুযায়ী আমরা চিংড়িও প্রস্তুত করতে পারিনি।’
হরতাল-অবরোধের প্রভাব রপ্তানিমুখী চিংড়িশিল্পে
প্রতিদিনের ক্ষতি ৮-১০ কোটি টাকা
 সারা দেশের কারখানায় ১০ হাজার ৯৪০ টন চিংড়ি জমেছে। বাজারমূল্য ১৪৫২ কোটি টাকা
 ডিসেম্বরে যেখানে রপ্তানি হয়েছিল ৪ হাজার ২৯ টন চিংড়ি, সেখানে জানুয়ারির প্রথম ২৮ দিনে হয়েছে ২৮৯৯ টন
 ডিসেম্বর ও জানুয়ারিতে একটি চিংড়িও রাশিয়ায় রপ্তানি হয়নি

চিংড়ি রপ্তানি
মাস ২০১৩–১৪ ২০১৪–১৫
জুলাই ৫,৩৪৫ টন ৫,০১৬ টন
আগস্ট ৫,১২৩ টন ৪,৬৯৮ টন
সেপ্টেম্বর ৫,৪২৭ টন ৫,০১২ টন
অক্টোবর ৪,৯৫০ টন ৪,০৪৩ টন
নভেম্বর ৩.৮৯০ টন ৩,৬৯৫ টন
ডিসেম্বর ৩,৯৬৪ টন ৪,০২৯ টন
সূত্র: হিমায়িত খাদ্য রপ্তানিকারক সমিতি ও ইপিবি

‘‘এমনিতেই এবার লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৮ থেকে ১০ শতাংশ রপ্তানি কম হতে পারে। কিন্তু এই হরতাল-অবরোধ চলতে থাকলে বছর শেষে রপ্তানি ২৫ শতাংশ পর্যন্ত কমার আশঙ্কা রয়েছে
মো. আমিন উল্লাহ
সভাপতি, বাংলাদেশ হিমায়িত খাদ্য রপ্তানিকারক সমিতি