বিশ্বব্যাংক উৎপাদন খাতে মেয়াদি ঋণ দেবে

বাংলাদেশের উৎপাদন খাতে মেয়াদি ঋণ দিতে সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিশ্বব্যাংক। সংস্থাটি মনে করে, এ দেশের শিল্প খাতের জন্য মেয়াদি ঋণ জোগানের প্রয়োজন রয়েছে এবং এ বিষয়ে বিশ্বব্যাংক সিদ্ধান্তও নিয়েছে।

ঢাকায় সফররত বিশ্বব্যাংকের দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলের ভাইস প্রেসিডেন্ট অ্যানেট ডিক্সনের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল গতকাল মঙ্গলবার বিকেলে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আতিউর রহমানের সঙ্গে বৈঠকে এ সিদ্ধান্তের কথা জানায়।

এদিকে দুপুরে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের সঙ্গে বৈঠক করেন অ্যানেট ডিক্সন। অর্থমন্ত্রী বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের জানান, সরকার বিশ্বব্যাংকের কাছে বাজেট সহায়তা চেয়েছে। উল্লেখ্য, বিশ্বব্যাংক এ দেশের বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে অর্থায়ন করে আসছে। এ অর্থায়ন সুনির্দিষ্ট প্রকল্পে ব্যয় হয়। এখন সরকার বাজেটের জন্য সহায়তা চাইছে।

সূত্র জানায়, বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে বৈঠকে ডিক্সন বলেন, তিনি ইতিমধ্যে চেম্বার ও ব্যবসায়ী নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। সেসব বৈঠকে ব্যবসায়ীদের কথায় তিনি অত্যন্ত আশাবাদী হয়েছেন। ব্যবসায়ীদের মধ্যে বিনিয়োগ ও উৎপাদন বৃদ্ধির সাংঘাতিক রকমের আগ্রহে তিনি এ আশাবাদী হন।

জানা যায়, ডিক্সন কৃষিঋণ, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে (এসএমই) অর্থায়ন এবং বড় শিল্পে অর্থায়ন প্রবাহ কীভাবে সম্ভব হচ্ছে তা জানতে চান। গভর্নর জবাব দিয়ে বলেন, বেসরকারি সংস্থা (এনজিও) মূলত ক্ষুদ্রঋণ বিতরণ করে। আর ব্যাংকগুলোর জন্য বেঁধে দেওয়া কৃষি, এসএমই ঋণের অর্থ এনজিওর মাধ্যমে অনেক ক্ষেত্রে বিতরণ করা হচ্ছে। অন্যদিকে বড় শিল্পের ঋণগুলো ব্যাংকগুলো নিজেই বিতরণ করছে।

এ অর্থায়ন প্রবাহকে অত্যন্ত ইতিবাচক বলে মত দেন ডিক্সন। একই সঙ্গে এটা বিভিন্ন দেশের কাছে অনুকরণীয় বলেও মন্তব্য করেন দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলের এই শীর্ষ কর্মকর্তা।

সূত্র জানায়, ডিক্সন আশাবাদের পাশাপাশি বাংলাদেশে প্রলম্বিত রাজনৈতিক অস্থিরতার প্রভাব ব্যবসা-বাণিজ্যে পড়বে বলেও শঙ্কা প্রকাশ করেন।

তবে বৈঠক শেষে উপস্থিত সাংবাদিকদের রাজনৈতিক অস্থিরতা বিষয়ে কোনো কথা বলেননি ডিক্সন। তিনি বলেন, দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে তাঁদের মধ্যে আলোচনা হয়েছে। বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করতে হলে বেসরকারি খাতে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ দরকার। সে বিষয়ে বিশ্বব্যাংক সহায়তা করবে।

উল্লেখ্য, দেশের রপ্তানিমুখী উৎপাদন খাতে স্বল্প সুদে ঋণ দেওয়ার জন্য বিশ্বব্যাংক ৩০ কোটি ডলারের একটি তহবিল দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

এর আগে সচিবালয়ে বৈঠকের পর অর্থমন্ত্রী উপস্থিত সাংবাদিকদের বলেন, ‘এটা আসলে বাজেট সহায়তা না, কর্মসূচি (প্রোগ্রাম) বাজেট। বিশ্বব্যাংকের কাছে বড় আকারে (ব্রড পলিসি) আমরা প্রস্তাব দিই। এর খসড়া তৈরির কাজ চলছে এখন।’

খসড়া অবশ্য একরকম করাই থাকে উল্লেখ করে মুহিত বলেন, নতুন বিষয় বাকি থাকে তারিখ। অর্থাৎ কবে তারা টাকাটা দেবে।

অর্থমন্ত্রী বলেন, বিশ্বব্যাংক থেকে ঋণ আসে, অনুদান নয়। সংস্থাটির সঙ্গে বড় বড় কর্মসূচি হবে। চারটি প্রকল্পের মধ্যে তিনটির ব্যাপারে ইতিমধ্যে ১ কোটি ২০ লাখ ডলারের চুক্তি সই হয়েছে।

অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে কী আলোচনা হলো—বৈঠকের পর জানতে চাইলে ডিক্সন সাংবাদিকদের বলেন, ‘বাংলাদেশে এটা আমার প্রথম সফর। বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের একটা লম্বা ইতিহাস রয়েছে। বিশ্বব্যাংক সব সময়ই বাংলাদেশের উন্নয়ন-সহযোগী।’ বাংলাদেশের অর্থনীতি ভালো করছে, দারিদ্র্যের হার কমছে এবং মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির হার ৬ শতাংশের ওপরে থাকছে বলেও উল্লেখ করেন ডিক্সন।

তবে বিশ্বব্যাংক বাজেট-সহায়তা দেবে কি দেবে না—এ ব্যাপারে ডিক্সন কিছু জানাননি।

সরকারের লক্ষ্যমাত্রা হচ্ছে দেশ থেকে দারিদ্র্য দূর করা—এ কথা উল্লেখ করে অর্থমন্ত্রী জানান, দারিদ্র্যের হার কমছে এবং দেশে কোনো দরিদ্র থাকবে না—এটাই সরকারের লক্ষ্যমাত্রা। আগামী ২০১৮ সালের মধ্যেই এ হার ১১-১২ শতাংশে নামিয়ে আনা হবে।

চলতি পঞ্জিকা বছরের মধ্যে আয় ও ব্যয় খানা জরিপ হবে জানিয়ে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘এই জরিপে দারিদ্র্যের হারের একটা চিত্র পাওয়া যাবে। আমার মনে হয়, এই হার ১২ শতাংশে নামিয়ে আনতে ২০১৮ সাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে না।’

পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের (জিইডি) হিসাব অনুযায়ী গত ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশের দারিদ্র্যের হার ২৪ দশমিক ৪৭ শতাংশ। আর চরম দারিদ্র্যের হার ১২ শতাংশের একটু বেশি।

দেশের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে বিশ্বব্যাংকের ভাইস প্রেসিডেন্টের সঙ্গে কোনো কথা হয়নি বলে নিজে থেকেই জানান অর্থমন্ত্রী। এ বিষয়ক কোনো প্রশ্ন করার আগেই তিনি বলেন, ‘আমাদের অত্যন্ত সুখকর আলোচনা হয়েছে। তবে বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে তিনি কোনো কথা তোলেননি, আমিও বলিনি।’

দারিদ্র্য হার কমানো কীভাবে সম্ভব জানতে চাইলে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘এই পরিস্থিতি টিকবে না, আমি নিশ্চিত।’

এমন পরিস্থিতির ৫০ দিন তো পার হচ্ছে—অর্থমন্ত্রীকে স্মরণ করিয়ে দিলে তিনি বলেন, ‘এটা মরে যাচ্ছে (ইটস ডাইং)। যেমন মফস্বলে হত্যাকাণ্ড কমছে। তবে ঢাকায় বাড়ছে।’

অন্যদিকে বাংলাদেশের চলমান পরিস্থিতি নিয়ে অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে কোনো আলোচনা হয়েছে কি না জানতে চাইলে ডিক্সন বলেন, ‘আমাদের আলোচনার বিষয় বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন, দারিদ্র্যের হার কমানো এবং কয়েক বছরের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হওয়া।’

সফর চলাকালে নিরাপত্তা বিষয়ে কিছু বলবেন কি না জানতে চাইলে জবাব না দিয়ে এড়িয়ে যান অ্যানেট ডিক্সন।