বেকারমুক্ত বিশ্বের স্বপ্ন ড. ইউনূসের

ঢাকায় শেরেবাংলা নগরের বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে সামাজিক ব্যবসা দিবস, ২০১৫ উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে অতিথিরা l প্রথম আলো
ঢাকায় শেরেবাংলা নগরের বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে সামাজিক ব্যবসা দিবস, ২০১৫ উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে অতিথিরা l প্রথম আলো

দারিদ্র্য, বেকারত্ব ও কার্বন নিঃসরণ শূন্যের পর্যায়ে থাকবে, এমন এক বিশ্বের স্বপ্ন দেখেন নোবেল বিজয়ী ও গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এ রকম টেকসই বিশ্ব তৈরি করতে চারটি মহাশক্তিকে কাজে লাগানোর কথা বললেন তিনি। তাঁর মতে, এসব মহাশক্তি হলো তারুণ্য, প্রযুক্তি, সামাজিক ব্যবসা ও সুশাসন।
ড. ইউনূস বলেন, ‘বর্তমান পুঁজিব্যবস্থায় দারিদ্র্য নিরসন ও বেকারত্ব দূর করা যাচ্ছে না। এ ব্যবস্থায় সবাই মুনাফা চায়। এতে আয়বৈষম্য, সম্পদবৈষম্য সৃষ্টি হয়েছে। একজনের কাছে সম্পদ থাকবে, অন্যজনের কাছে থাকবে না—এভাবে উন্নয়ন টেকসই হতে পারে না। কিন্তু আমরা এ ব্যবস্থা চাই না। আমরা সবাইকে খাদ্য, শিক্ষা, সুস্বাস্থ্য দিতে চাই। মানুষ সুযোগহীন থাকতে পারে না। মানুষ তাঁর সৃজনশীলতা দিয়ে উদ্যোক্তা হিসেবে তৈরি হবে। এ উদ্যোক্তারা নিজেরা চাকরি খুঁজবে না, বরং অন্যদের চাকরি দেবে।’
রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে গতকাল বৃহস্পতিবার ইউনূস সেন্টার আয়োজিত সামাজিক ব্যবসা দিবসের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে এভাবেই নিজের স্বপ্ন, মানুষের সৃজনশীলতার সম্ভাবনা ও টেকসই উন্নয়নের কথা শোনালেন এ নোবেল বিজয়ী।
ষষ্ঠবারের মতো আয়োজিত এ অনুষ্ঠানে ৩০টি দেশের আড়াই শ অতিথি এসেছেন। দিবসটির মূল প্রতিপাদ্য হলো ‘আমরা চাকরিপ্রার্থী নই, আমরা চাকরিদাতা—বেকারদের উদ্যোক্তায় রূপান্তর’।
অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধে ড. ইউনূস বলেন, কর্মহীন থাকার জন্য মানুষের জন্ম হয়নি। সৃজনশীলতা দিয়ে মানুষ নিজেদের উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তুলবে। চাকরি দেওয়া, চাকরি করা ইত্যাদি ধারণা মানুষকে ভুল পথে নিয়ে গেছে। শুধু বাংলাদেশ নয়, সারা দুনিয়ায় বোঝানো হয়েছে, লেখাপড়া শিখে চাকরি করতে হবে। এতে দারিদ্র্য সৃষ্টি হয়েছে। ওপরের দিকে কিছু মানুষের সম্পদের পাহাড় হয়েছে। আর নিচের দিকে তৈরি হয়েছে সম্পদহীনতা।
ড. ইউনূস জানান, পৃথিবীর জনসংখ্যা ১০ লাখে উন্নীত হতে ৩০ লাখ বছর সময় লেগেছে। এর মাত্র ২০ হাজার বছর পরে ১৮০৪ সালে পৃথিবীর জনসংখ্যা দাঁড়ায় ১০০ কোটি। আর এখন ৭২৫ কোটি জনসংখ্যা। প্রতি ১২ বছরে জনসংখ্যা বাড়ছে ১০০ কোটি। ক্রমবর্ধমান এসব মানুষকে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, স্যানিটেশন-সুবিধা দিতে হবে।
বিদ্যমান বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের উপায়ও বাতলে দেন ড. ইউনূস। তিনি বলেন, মানুষকে তিনটি ‘শূন্যে’র দিকে যেতে হবে। ‘শূন্য’ দারিদ্র্য, ‘শূন্য’ বেকারত্ব ও ‘শূন্য’ কার্বন নিঃসরণ। এ জন্য প্রচলিত ব্যবস্থার বাইরে গিয়ে মানুষের চিন্তাকাঠামোয় চারটি মহাশক্তিতে প্রাধান্য দিতে হবে। প্রথমত, প্রতিবছর জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে তারুণ্যের ক্ষমতা প্রকাশের সুযোগও তৈরি হচ্ছে। প্রতিবছর শ্রমশক্তিতে যুক্ত হচ্ছে বিপুলসংখ্যক তরুণ-তরুণী। দ্বিতীয়ত, প্রযুক্তির ব্যবহারকে মানুষের উন্নয়নে কাজে লাগাতে হবে। তৃতীয়ত, সৃজনশীল সামাজিক ব্যবসার মাধ্যমে উদ্যোক্তা তৈরি ও কর্মসংস্থান করতে হবে। চতুর্থত, সামাজিক ন্যায়বিচারের জন্য প্রতিষ্ঠা করতে হবে সুশাসন।
সামাজিক ব্যবসা দিবসের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের সূচনা পর্বেই শুভেচ্ছা জানাতে মঞ্চে আসেন বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত মার্শা স্টিফেনস ব্লুম বার্নিকাট, যুক্তরাজ্যের হাইকমিশনার রবার্ট গিবসন, ফ্রান্সের রাষ্ট্রদূত সুফি অ্যাবার্ট, সুইডেনের রাষ্ট্রদূত জন ফ্রাইসেল, চীনের রাষ্ট্রদূত মা জিংজিয়ান, মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের পরামর্শক শরিফাহ হাপসা সাহাবুদ্দীন।
যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত মার্শা বার্নিকাট ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম ও ড. ইউনূসের প্রশংসা করেন। নিজ দেশে ক্ষুদ্রঋণের সাফল্য তুলে ধরে তিনি বলেন, ২০০৮ সালে গ্রামীণ আমেরিকা প্রতিষ্ঠার পর থেকে ১ লাখ ২৫ হাজার ক্ষুদ্রঋণ দিয়েছে। এ ঋণ ৪৭ হাজার নারীর কাছে পৌঁছেছে। এতে প্রায় ৫৭ হাজার লোকের কর্মসংস্থান হয়েছে।
পুঁজিবাদ দারিদ্র্য কমাতে পারছে না উল্লেখ করে রবার্ট গিবসন বলেন, টেকসই উন্নয়নের সমাধান হিসেবে সামাজিক ব্যবসা ধারণা এসেছে। আগামী ১০ বছরে ড. ইউনূসের মডেলটির ব্যাপক বিস্তার ঘটবে।
ক্লিনটন, শ্যারন স্টোনের ভিডিও বার্তা: অনুষ্ঠানের এক পর্যায়ে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন ও অভিনেত্রী শ্যারন স্টোন এবং জাতিসংঘের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল থমাস গাসের ভিডিও বার্তা দেখানো হয়। এসব ভিডিওতে তাঁরা শুভেচ্ছা জানান।
বিল ক্লিনটন তাঁর ভিডিও বার্তায় ড. ইউনূসের ভূয়সী প্রশংসা করেন। তিনি বলেন, ‘আপনার (ড. ইউনূস) অনুপ্রেরণায় লাখ লাখ মানুষ দারিদ্র্য থেকে বের হয়ে আসছে।’
অন্যদিকে শ্যারন স্টোন বলেন, ‘মানুষের জীবনমানের উন্নয়নে সামাজিক ব্যবসা বিশেষ ভূমিকা রাখছে।’
এরপর গ্রামীণ ব্যাংকের সদস্যদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মঞ্চে ডাকেন ড. ইউনূস। এ সময় তাহসিনা খাতুনের নেতৃত্বে গ্রামীণ ব্যাংকের নির্বাচিত নারী প্রতিনিধিরা মঞ্চে ওঠেন।
গ্রামীণ ব্যাংকের দ্বিতীয় প্রজন্ম: উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের পর ‘আমরা চাকরিপ্রার্থী নই, চাকরিদাতা’ শীর্ষক আলোচনায় ছয়জন উদ্যোক্তা নিজেদের সামাজিক ব্যবসার মডেল তুলে ধরেন। তাঁরা হলেন নাজনীন, লাভলী বেগম, মাফিয়া পারভীন, রেজাউল করিম, জান্নাতুল আফরিন ও ইব্রাহিম হোসেন। এঁরা বুটিক, তথ্যপ্রযুক্তি, দুগ্ধ ও কারুপণ্যের ব্যবসা করেন। নবীন উদ্যোক্তা কর্মসূচির আওতায় তাঁরা ঋণ নিয়ে কীভাবে ব্যবসা পরিচালনা করছেন, সেই অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন। এসব উদ্যোক্তার সবাই গ্রামীণ ব্যাংকের দ্বিতীয় প্রজন্ম। তাঁদের মায়েরা গ্রামীণ ব্যাংকের সদস্য।
এ ছাড়া দিনের ‘অভিজ্ঞতা বিনিময়: সারা বিশ্বে সামাজিক ব্যবসায়ের প্রসার’ শীর্ষক আলোচনায় বক্তব্য দেন গ্রামীণ ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা অ্যালেক্স কাউন্টস, স্থানীয় ইংরেজি দৈনিক দ্য ডেইলি স্টার-এর সম্পাদক মাহ্ফুজ আনাম, গ্রামীণ আমেরিকার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আন্দ্রে জাং, যুক্তরাষ্ট্রের বেকার কলেজের সভাপতি রবার্ট জনহন, জার্মানির ইউনূস সোশ্যাল বিজনেসের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সাসকিয়া ব্রাস্টেন, গ্রামীণ চীনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা জাও ঝান, জার্মানির গ্রামীণ ক্রিয়েটিভ ল্যাবের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হ্যান্স রিৎজ।
গতকাল সামাজিক ব্যবসা দিবসে মোট ১২টি কর্ম অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। এ ছাড়া অনুষ্ঠানস্থলে দিনভর নবীন উদ্যোক্তাদের তৈরি বিভিন্ন পণ্যের প্রদর্শনী হয়।