চামড়াজাত শিল্পের বাজার বাড়ছে

চামড়াজাত পণ্য
চামড়াজাত পণ্য

বাংলাদেশে প্রস্তুত চামড়ার মান ভালো হওয়ায় আন্তর্জাতিক বাজারে এর চাহিদাও বেশ। আবার বড় প্রতিযোগী দেশগুলোতে উৎপাদন ব্যয় বেশি হওয়ায় ক্রেতাদের পছন্দের তালিকায় আছে বাংলাদেশের চামড়াপণ্য।
পাল্লা দিয়ে বাড়ছে এ দেশের পাদুকার চাহিদাও। দেশীয় অনেক প্রতিষ্ঠানই বিশ্বখ্যাত প্রতিষ্ঠানগুলোর পাদুকা তৈরি করছে। এসব বিষয় মাথায় রেখেই চামড়া ও চামড়াশিল্পজাত পণ্য উৎপাদনকারী অনেক প্রতিষ্ঠানই তাদের ব্যবসা সম্প্রসারণের উদ্যোগ নিয়েছে।
পাদুকা ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানিকারকদের বড় সংগঠন লেদারগুডস অ্যান্ড ফুটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (এলএফএমইএবি) বলছে, গত এক বছরে ১৫ থেকে ২০টি প্রতিষ্ঠান সমিতির সদস্য হয়েছে। এর মধ্যে আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানও আছে। এই প্রতিষ্ঠানগুলোর বেশির ভাগই নতুন গড়ে উঠেছে।
চামড়াশিল্প-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, এ শিল্পের ৯০ শতাংশ কাঁচামাল দেশেই পাওয়া যায়। পাদুকা ও অন্যান্য পণ্য তৈরিতে উৎপাদিত পাকা চামড়ার মাত্র ৫০ শতাংশ ব্যবহূত হয়। সেদিক থেকে চামড়াজাত পণ্য ও পাদুকাশিল্পের প্রসার দ্বিগুণ করা সম্ভব।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য অনুযায়ী, গেল ২০১২-১৩ অর্থবছরে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি থেকে আয় হয়েছিল ৫৬ কোটি ১০ লাখ ডলার। অন্যদিকে পাদুকা রপ্তানি থেকে আয় হয়েছে ৪১ কোটি ৯৩ লাখ ডলার। অর্থাৎ দেশের সার্বিক চামড়া খাতের রপ্তানি আয় হয় ৯৮ কোটি ডলারের কিছু বেশি। আগের বছরের চেয়ে এ সময় প্রস্তুত চামড়া রপ্তানিতে ২১ শতাংশ, চামড়াজাত পণ্যে ৬২ শতাংশ এবং পাদুকা রপ্তানিতে ২৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে।
সরকার চলতি ২০১৩-১৪ অর্থবছরে চামড়া খাতের রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছে প্রায় ১২১ কোটি ৫০ লাখ ডলার। প্রতিবছর যে হারে রপ্তানি বাড়ছে, তাতে এ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন কঠিন নয় বলে মনে করেন এ খাতের উদ্যোক্তারা। ইতিমধ্যে অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে রপ্তানি হয়েছে ৩১ কোটি ৪৭ লাখ ডলার।
বাংলাদেশ প্রস্তুত চামড়া, চামড়াপণ্য ও পাদুকা রপ্তানিকারক সমিতির (বিএফএলএলএফইএ) সভাপতি বেলাল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, বিশ্ববাজারে বাংলাদেশি চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের চাহিদা বাড়ছে। সে অনুযায়ী উৎপাদন করতে পারলে দু-এক বছরের মধ্যে এসব পণ্যের রপ্তানি ৫০ শতাংশ বাড়ানো সম্ভব। সে কারণে অনেক প্রতিষ্ঠানই এখন কারখানা ও ট্যানারি সম্প্রসারণ করছে। আগামী এক বছরের মধ্যে পাকিস্তান, ইন্দোনেশিয়া, আফ্রিকার কয়েকটি দেশ ও রাশিয়া প্রস্তুত চামড়ার নতুন বাজারে পরিণত হবে।
এ জন্য আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন ট্যানারি প্রয়োজন মন্তব্য করে বেলাল বলেন, সাভারের শিল্পনগরে এমন বেশ কয়েকটি ট্যানারি করা যাবে। তবে যেসব ট্যানারিমালিককে কম প্লট দেওয়া হয়েছে, তাঁদের পক্ষে মানসম্পন্ন ট্যানারি করা সম্ভব হবে না।
দেশে তৈরি পাদুকা এরই মধ্যে বিশ্বে নিজের অবস্থান দৃঢ় করেছে। প্রতিবছর বাড়ছে পাদুকা রপ্তানি। ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জাপান, কানাডা, অস্ট্রেলিয়াসহ কয়েকটি দেশে এ দেশের পাদুকা শুল্কমুক্ত ও কোটামুক্ত সুবিধা পায়। বিশ্বখ্যাত অনেক জুতা বাজারজাতকারী প্রতিষ্ঠানের জন্যই এখন পাদুকা তৈরি করছে দেশীয় একাধিক প্রতিষ্ঠান।
ইতালির বিডটজেডডট মোডা, পূর্ব ইউরোপের হিউম্যানিক, রিগ্যালের মতো ব্র্যান্ডের জন্য পাদুকা প্রস্তুত করে লেদারেক্স ফুটওয়্যার। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাজমুল হাসান প্রথম আলোকে বলেন, পাদুকা রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি ভালো। নতুন করে রাশিয়া ও পূর্ব ইউরোপে পাদুকার বাজার সম্প্রসারিত হয়েছে।
কানাডার অ্যালডো এবং ফ্রান্ডের জুলস ও সিলিও ব্র্যান্ডের জন্য জুতা প্রস্তুত করে সোনালি আশ ইন্ডাস্ট্রি। প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাহবুবুর রহমান পাটোয়ারী প্রথম আলোকে বলেন, পাদুকার কার্যাদেশ বেশ ভালো। তাদের পাদুকা জাপান, যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া ও ইউরোপের দেশগুলোতে রপ্তানি হচ্ছে।
মাহবুবুর রহমান আরও বলেন, ‘আমি নতুন একটা ইউনিট করার প্রস্তুতি নিয়েছি। আগামী বছরের মার্চ নাগাদ ওই ইউনিটে পাদুকা তৈরি শুরু হবে।’
তবে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে অনেক উদ্যোক্তাই এ বছর ব্যবসা সম্প্রসারণ করতে সাহস দেখাচ্ছেন না। লেদারেক্স ফুটওয়্যারের নাজমুল হাসান বলেন, ‘আমি নতুন একটা ইউনিট করব। সবকিছু ঠিক করে রেখেছি। কিন্তু দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি স্থিতিশীল হলেই তা আমি চালু করব।’
অবশ্য পাদুকা রপ্তানিতে কিছু সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছেন উদ্যোক্তারা। তাঁরা বলছেন, দেশীয় পাদুকার বড় বাজার জাপানে গত বছর রপ্তানি কমে গেছে। জাপানে এ দেশের পাদুকা অগ্রাধিকারমূলক বাজার-সুবিধা পায়। অন্যদিকে ভারত ও ভিয়েতনামের সঙ্গে দেশটি অর্থনৈতিক অংশীদারি চুক্তি (ইপিএ) করেছে। ফলে দেশ দুটিও পণ্য রপ্তানিতে বিশেষ সুবিধা পাচ্ছে। এতে বাংলাদেশের জুতা ওই সব প্রতিযোগী দেশের কাছে মার খাচ্ছে। আবার দক্ষিণ কোরিয়ায় শুল্কমুক্ত সুবিধা থাকার পরও গত বছর সেখানে তেমন পাদুকা রপ্তানি হয়নি।
নাজমুল হাসান সোহেল বলেন, ‘জুতা রপ্তানিতে বিশ্বব্যাপী আধিপত্য চীনের। চীন উচ্চ প্রযুক্তির শিল্পের দিকে যাওয়ায় দেশটির বাজারের একটি বড় অংশ আমরা দখল করতে পারতাম। কিন্তু ওই সব কার্যাদেশ চলে যাচ্ছে ভারত, ভিয়েতনাম আর মিয়ানমারের কাছে। রানা প্লাজার ঘটনার প্রভাবেই এমনটা হয়েছে।’
চামড়াশিল্প-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বড় প্রতিষ্ঠানগুলোর পাশাপাশি দেশে প্রায় সাড়ে চার হাজার ছোট পাদুকা প্রস্তুতকারী কারখানা রয়েছে। এসব কারখানায় বছরে ১৪ কোটি ৬৬ লাখ জোড়া জুতা প্রস্তুত হয়। এই তথ্য অবশ্য ২০০৮ সালের।
প্রক্রিয়াজাত চামড়া ও পাদুকার পাশাপাশি ব্রিফকেস, পার্স, উপহারসামগ্রী, হাতব্যাগ, বেল্ট, মোবাইল-ল্যাপটপ-ক্যামেরার কাভার, চাবির তোড়া, ওয়ালেট, ম্যাট, মানিব্যাগসহ নানা ধরনের চামড়াজাত পণ্য দেশে তৈরি হচ্ছে। এসব পণ্যের রপ্তানিও দ্রুত বাড়ছে।

চামড়া
চামড়া

বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিটিএ) ও বিএফএলএলএফইএর তথ্য অনুযায়ী, প্রতিবছর দেশে ২২ কোটি বর্গফুট চামড়া উৎপাদিত হয়। এসব চামড়ার ৫০ শতাংশই দেশের চামড়াজাত শিল্পে ব্যবহূত হয়। বাকিটা প্রক্রিয়াজাত করে রপ্তানি করা হয়। বাংলাদেশের চামড়া ইতালি, দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান, চীন, হংকং, তাইওয়ানে বেশি রপ্তানি হয়।
এই চামড়াটা প্রক্রিয়াজাত হয় ট্যানারিতে। সারা দেশে ট্যানারি আছে ২২০টি। রাজধানীর হাজারীবাগেই আছে ২০৬টি। এ খাতের সঙ্গে সরাসরি জড়িত আছেন সাত লাখ ৪১ হাজার মানুষ। বিটিএ বলছে, দেশের ট্যানারি কারখানাগুলোতে এ পর্যন্ত বিনিয়োগ হয়েছে ২৫০ কোটি টাকা।