রানা প্লাজা ধসে হতাহতদের ক্ষতিপূরণের জন্য প্রয়োজনীয় তিন কোটি মার্কিন ডলারের পুরোটাই তহবিলে পাওয়া গেছে। এ থেকেই ভুক্তভোগীদের ক্ষতিপূরণের বাকি অর্থ দেওয়া হবে। এ জন্য অবশ্য তাঁদের মাস খানেক অপেক্ষা করতে হবে। কারণ ক্ষতিপূরণের অঙ্ক নির্ধারণে বৈষম্য হয়েছে এমন কিছু অভিযোগের নিষ্পত্তির জন্য পুনরায় যাচাইয়ের কাজ করছে রানা প্লাজা সমন্বয় কমিটি।
এদিকে, ২৬ মাস পর ক্ষতিপূরণের বিষয়টি অবশেষে নিষ্পত্তি হতে যাচ্ছে—এমন খবরে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন একাধিক শ্রমিক নেতা। একই সঙ্গে তাঁদের আশঙ্কা, পুরো প্রক্রিয়াটিকে আইনি কাঠামোর মধ্যে আনা হয়নি। তাই ভবিষ্যতে কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে রানা প্লাজার এই বিশেষ ব্যবস্থাটি প্রযোজ্য হবে না, ফলে শ্রমিক ও তাঁদের পরিবারগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তাই ক্ষতিপূরণের একটি জাতীয় মানদণ্ড করার দাবি তাঁদের।
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) নেতৃত্বাধীন রানা প্লাজা সমন্বয় কমিটি গত ৮ জুন এক বিবৃতিতে জানায়, ভবন ধসের ঘটনায় আহত শ্রমিক ও নিহতের পরিবারের সদস্যদের ক্ষতিপূরণ দেওয়া জন্য প্রয়োজনীয় তিন কোটি মার্কিন ডলার রানা প্লাজা ট্রাস্ট ফান্ডে জমা হয়েছে। শিগগিরই ক্ষতিপূরণের ৩০ শতাংশ অর্থ দেওয়া হবে।
তহবিল থেকে গত বছর পাঁচ কিস্তিতে আহত ও নিহত শ্রমিক পরিবারের ২ হাজার ৭৭৭ জনকে তাঁদের প্রাপ্য ক্ষতিপূরণের ৪০ শতাংশ দেওয়া হয়। অবশ্য এ থেকে প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল প্রাপ্ত সহায়তা ও এককালীন দেওয়া ৫০ হাজার টাকা কর্তন করে রাখা হয়। পরে গত এপ্রিলে ক্ষতিপূরণের বাকি ৩০ শতাংশের অর্থ দেওয়া হয় ২ হাজার ৯৬৮ জনকে। এ ছাড়া ধসে যাওয়া রানা প্লাজায় থাকা নিউ ওয়েব বটমের ৬৬৮ শ্রমিকের ক্ষতিপূরণের অর্থ দেওয়ার কাজটি করছে প্রাইমার্ক।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সমন্বয় কমিটির কাছে ক্ষতিপূরণের অঙ্ক নির্ধারণে বৈষম্যের অভিযোগ তুলে লিখিত অভিযোগ করেছেন ক্ষতিগ্রস্ত ৩৩৯ জন। এর মধ্যে ৫০ জন আহত শ্রমিকের অভিযোগ আমলে নিয়ে তাঁদের দাবিনামাগুলো যাচাই-বাছাইয়ের কাজ গতকাল শনিবার শুরু করছে কমিটি। এটি শেষ করতেই চলতি মাস লেগে যাবে। তবে এখন পর্যন্ত ক্ষতিপূরণের অর্থ পাওয়ার ক্ষেত্রে ২ হাজার ৯৯৫ জনের নাম চূড়ান্ত হয়ে গেছে। এ ছাড়া আরও ১৮ জনের দাবিনামা যাচাইয়ের কাজ শেষের দিকে।
জানতে চাইলে সমন্বয় কমিটির সদস্য ও বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজ (বিলস) সহকারী নির্বাহী পরিচালক সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহম্মেদ গতকাল জানান, পুরো প্রক্রিয়া শেষ করে ক্ষতিগ্রস্তদের ব্যাংক হিসাবে ক্ষতিপূরণের অর্থ যেতে কমপক্ষে এক মাস লাগবে। তিনি জানান, যাচাই-বাছাই শেষে বলা যাবে এবার মোট কত টাকা ক্ষতিগ্রস্তদের দেওয়া হবে।
দেশের পোশাক খাতের সবচেয়ে বড় দুর্ঘটনাটি ঘটে ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল। নয়তলা রানা প্লাজা ধসে মারা যান ভবনটিতে অবস্থিত পাঁচ পোশাক কারখানার ১ হাজার ১৩৬ জন শ্রমিক। আহত হন দেড় হাজার শ্রমিক। গুরুতর আহত ছিলেন ৮১ জন। এ ঘটনার পর বিশ্বে আলোচনা ও সমালোচনার ঝড় ওঠে। পরে আন্তর্জাতিক চাপে পড়ে শেষ পর্যন্ত পোশাক কারখানার কর্মপরিবেশ উন্নয়নে কাজ শুরু করতে বাধ্য হন মালিকেরা। ক্ষতিপূরণের জন্য গঠিত হয় একটি সমন্বয় কমিটি।
জানা যায়, ক্ষতিপূরণের সর্বনিম্ন পরিমাণ কত হবে, সেটিও ইতিমধ্যে চূড়ান্ত করে ফেলেছে সমন্বয় কমিটি। ভবন ধসে নিহত শ্রমিক পরিবারের সদস্যরা সর্বনিম্ন ১০ লাখ টাকা পাবেন। এ ছাড়া আহত শ্রমিকদের মধ্যে যাদের ক্ষতিপূরণ দুই লাখ টাকার কম, তাঁদেরও ২০-৩০ শতাংশ অর্থ বাড়িয়ে দেওয়া হবে। আর সর্বোচ্চ একজন নিহতের পরিবারের সদস্যরা পাচ্ছেন ৭৮ লাখ টাকা। ২৫ লাখ টাকা করে পাচ্ছেন ৬১ নিহত শ্রমিকের পরিবার। এ ছাড়া দীর্ঘ মেয়াদে আহত শ্রমিকদের চিকিৎসার জন্য একটি তহবিল রাখছে কমিটি।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ গার্মেন্টস শ্রমিক সংহতির সমন্বয়ক তাসলিমা আখ্তার প্রথম আলোকে বলেন, সমন্বয় কমিটি ক্ষতিপূরণের বিষয়টি শেষের দিকে নিয়ে এসেছে। এটি ভালো। তবে শেষ পর্যন্ত এটি অনুদানই। এ ঘটনার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য করা গেল না। তিনি বলেন, সরকারের উচিত রানা প্লাজার এই বিশেষ ব্যবস্থাটিকে স্বীকৃতি দিয়ে আইন কাঠামোর মধ্যে নিয়ে আসা। অন্যথায় পোশাকশিল্পের ভাবমূর্তি প্রশ্নবিদ্ধই থাকবে।