পাঁচ বছরে ২ লাখ ৬৯ হাজার কোটি টাকা খরচ হবে

মানবসম্পদ উন্নয়নে আগামী পাঁচ বছরে ২ লাখ ৬৯ হাজার ৮০ কোটি টাকা খরচ করতে চায় সরকার। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, শ্রম খাতসহ বেশ কিছু খাতে এ অর্থ খরচ হবে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে স্বাস্থ্য খাতে।
সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার খসড়া দলিলের মানবসম্পদ উন্নয়নের অধ্যায়ে এসব কথা বলা হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার এ খাতটির ওপর মত নেওয়ার জন্য আলোচনা সভার আয়োজন করে পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগ (জিইডি)। পরিকল্পনা কমিশনের এনইসি সম্মেলনকক্ষে অনুষ্ঠিত আলোচনায় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করে জিইডি সদস্য শামসুল আলম। এতে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী ও বিশেষজ্ঞরা উপস্থিত ছিলেন। এ সময় আলোচকেরা বলেন, অদক্ষ শ্রমিক নিয়ে প্রবৃদ্ধি ৮ শতাংশে উন্নীত করা যাবে না।
মূল প্রবন্ধ: মূল প্রবন্ধে বিভিন্ন সূচকের লক্ষ্য নির্ধারণের তথ্য দেওয়া হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, ২০২১ সালে দারিদ্র্যের হার ১৬ দশমিক ৬ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। আর মানুষের গড় আয়ু ৭২ বছরে উন্নীত হবে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির বার্ষিক হার ১ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্য ঠিক করা হয়েছে।
মানবসম্পদ উন্নয়নে স্বাস্থ্য খাতকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। তবে মূল প্রবন্ধে পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর সঙ্গে সরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের একটি তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরে হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, স্বাস্থ্য খাতের সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে ভারত, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার চেয়ে পিছিয়ে আছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশে প্রতি ১০ হাজার মানুষের জন্য চিকিৎসক, সেবিকা ও দন্ত চিকিৎসকের সংখ্যা গড়ে ৭ দশমিক ৭। এ সংখ্যা শ্রীলঙ্কায় ২১ দশমিক ৯, ভারতে ১৪ দশমিক ৬ শতাংশ ও পাকিস্তানে ১২ দশমিক ৬। তবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (এমডিজি) জন্য প্রতি ১০ হাজার মানুষের জন্য ২৩ জন চিকিৎসক, সেবিকা ও দন্ত চিকিৎসক থাকার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে। মূল প্রবন্ধে দক্ষ মানবসম্পদ গঠনে গুণগত মানসম্পন্ন শিক্ষাব্যবস্থা চালুর ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে।
আলোচনা: শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেন, ২০০৯ সালে মোট শিক্ষার্থীর মধ্যে কারিগরি শিক্ষার্থী ছিল ১ শতাংশ। এখন তা বেড়ে ৮ শতাংশ হয়েছে। ২০২০ সালের মধ্যে তা ২০ শতাংশে উন্নীত করতে হবে। কারিগরি শিক্ষার সিলেবাস যুগোপযোগী করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
বাজেটে বরাদ্দ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, ‘এ বছর মাত্র ৫৫ কোটি টাকা বাড়তি বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। অথচ আপনারা বলেন, শিক্ষাকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। আমি টাকা কোথায় পাব?’
পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, ‘আমরা এখন নিম্ন মধ্য আয়ের দেশে পরিণত হয়েছি। উচ্চ মধ্য আয়ের দেশে উন্নীত হতে হলে দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তুলতে হবে। এ জন্য শিক্ষানীতির সঙ্গে সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার যোগসূত্র রাখতে হবে।’ তিনি মনে করেন, শিক্ষার গুণগত মান ধরে রাখা যাচ্ছে না। এর কারণ শিক্ষকদের দক্ষতার অভাব। তবে শিক্ষার্থীরা আগের চেয়ে অনেক বেশি মনোযোগী।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন বলেন, ‘প্রতিবছর বিদেশি কর্মীদের বেতন-ভাতা হিসেবে ৪০০ কোটি ডলার দিতে হয়। তাহলে দেশের এত বিশ্ববিদ্যালয় কী করছে? কেন বিদেশ থেকে মানবসম্পদ আমদানি করতে হচ্ছে?’
ফরাসউদ্দিন বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাজেটের ৯ শতাংশ নিজস্ব তহবিল থেকে দেওয়া হয়, বাকিটা সরকার দেয়। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য ছিল গরিবেরা যাতে উচ্চশিক্ষা পায়। কিন্তু এ বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেকে মার্সিডিজ গাড়ি চড়ে পড়তে যায়। অথচ মাসে ২০ টাকা বেতন দেয় তারা। আমরা ৫৫ বছর আগেও মাসে ১২ টাকা বেতন দিতাম।’
মানবসম্পদ উন্নয়নে বরাদ্দ ও ব্যবস্থাপনার ওপর জোর দেওয়ার তাগিদ দেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধূরী। তিনি জানান, দেশের ১১ হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জরাজীর্ণ অবস্থায় রয়েছে। এর মধ্যে ২ হাজার প্রতিষ্ঠান বরাদ্দ পেয়েছে। তিনি বলেন, ‘প্রতিরক্ষা খাতে ১৬ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এটা মেনে নিতে পারছি না। সেনানিবাসে ঢুকলে মনে হয়, আমরা এ দেশে নেই। সেখানে জরাজীর্ণতা নেই। মানবসম্পদের সক্ষমতা নাকি সেনা সক্ষমতা বৃদ্ধি—এই প্রশ্নটা করতে চাই।’
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষণা পরিচালক বিনায়ক সেন বলেন, অদক্ষ শ্রমিক নিয়ে প্রবৃদ্ধি ৮ শতাংশে উন্নীত করা যাবে না। আগামী পাঁচ-সাত বছরে প্রবৃদ্ধি সেখানে নিয়ে যেতে দক্ষ মানবসম্পদ গঠনে পরিকল্পনা দলিলে আরও পরিষ্কার ব্যাখ্যা থাকা উচিত।
সভায় আরও বক্তব্য রাখেন প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রী মোস্তাফিজুর রহমান, যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী বীরেন শিকদার প্রমুখ।